প্রশ্নঃ ছুটি খান সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখ।

উত্তরঃ বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ প্রায় পুরোটাই ছিল মুসলমানদের শাসন আমল। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলা জয় করার পর থেকে প্রায় দেড় বছর বাংলা সাহিত্য সৃষ্টিতে যথেষ্ট মন্দা ভাব ছিল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সর্বৈব উন্নতি সাধিত হয় সুলতানী আমলে। এ সময় বিভিন্ন শাসক পৃষ্ঠপোষকতা করে কবিদের দিয়ে কাব্য রচনা করান। সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের (১৪৯৩-১৫১৮) সময় বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। হুসেন শাহ নিজে বাংলা সাহিত্য চর্চায় পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন এবং তার সেনাপতি পরাগল খাঁকেও পৃষ্ঠপোষকতায় অনুপ্রাণিত করেছেন। হুসেন শাহ চট্টগ্রাম জয় করার পর তাঁর সেনাপতি পরাগল খাঁকে চট্টগ্রামের শাসন ক্ষমতা অর্পণ করেন। পরাগল খাঁ চট্টগ্রামের দায়িত্ব পাওয়ার পর কবীন্দ্র পরমেশ্বরকে মহাভারতের কাহিনী সংক্ষেপে রচনা করতে নির্দেশ দেন।

পরাগল খাঁর মৃত্যুর পর তার ছেলে ছুটি খান (অর্থাৎ ছোট খাঁ) চট্টগ্রামের শাসনকর্তা হয়ে পিতার পদ অধিকার করেন। ছুটি খানও তার পিতার মত বিদ্যোৎসাহী ছিলেন এবং হিন্দুর কাব্যাদি শুনতে ভালবাসতেন। ছুটি খানের সভাকবি ছিলেন শ্রীকর নন্দী। ছুটি খান শ্রীকর নন্দীকে মহাভারতের অনুবাদ করতে আদেশ দেন। ছুটি খানের কাছে পাণ্ডবদের যজ্ঞাদি ও ঐশ্বর্য গৌরব লাভের কাহিনী তার বড়ই প্রীতিকর ছিল। তখন শ্রীকর নন্দী ছুটি খানের নির্দেশে বেদব্যাসের মহাভারত পরিত্যাগ করে জৈমিনি ভারত অবলম্বন করে মহাভারতের অশ্বমেধ পর্ব অনুবাদ করেন। এ মহাভারত ছুটিখানী মহাভারত নামে পরিচিত। মহাভারত, রচনায় পৃষ্ঠপোষকতা করে ছুটি খান মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য বাসরে স্বতন্ত্রভাবে উচ্চারিত।

প্রশ্নঃ পরাগলী মহাভারতের পরিচয় দাও।

উত্তরঃ দ্বাদশ শতাব্দী থেকে বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের শুরু। মধ্যযুগের প্রথম পাদে খিলজী শাসনামলে রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চাষবাস তেমন জমে না উঠলেও সুলতানী আমলে (১৩৪২-১৫৭৫) গৌড়ের শাহী দরবার বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠে। এ আমলের বিভিন্ন শাসক সুলতান সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, হিন্দি ভাষার বিভিন্ন কাব্য অনুবাদের জন্য যোগ্য কবি-পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা করে সমৃদ্ধ এক অনুবাদ সাহিত্য গড়ে তোলেন।

বাংলার সুলতান হুসেন শাহের সেনাপতি লস্কর পরাগল খাঁ চট্টগ্রাম জয় করেন এবং সেখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। পরাগল খাঁর সভাকবি ছিলেন কবীন্দ্র পরমেশ্বর । বিদ্যোৎসাহী সাহিত্যানুরাগী পরাগল খাঁ হিন্দুদের ধর্ম গ্রন্থাদির প্রতিও অনুরক্ত ছিলেন। তিনি তার সভাকবি এমনভাবে মহাভারত লিখতে বললেন যাতে পরাগল খাঁ একদিনের মধ্যে সমস্ত মহাভারত শুনতে সমর্থ হন। পরাগল খাঁর নির্দেশে কবীন্দ্র পরমেশ্বর খুব সংক্ষেপে মহাভারতের অনুবাদ করেন। অনুবাদ সাহিত্যের বাসরে কবীন্দ্র পরমেশ্বর কর্তৃক অনূদিত ও পরাগল খাঁ কর্তৃক নির্দেশিত মহাভারত পরাগলী মহাভারত নামে পরিচিত।

পরাগলী মহাভারতখানি মূলের অতি সংক্ষিপ্ত অনুবাদ। কিন্তু প্রধান ঘটনা প্রায় কিছুই বাদ পড়ে নি। মহাভারতের তত্ত্বকথা মুসলমান লস্করের মনোরঞ্জন করতে পারবে না আশঙ্কা করে পরমেশ্বর শুধু কাহিনী অনুসরণ করেছেন, কিন্তু মূল্যবান তত্ত্বকথা বেমালুম বাদ দিয়ে গেছেন। পরমেশ্বর কর্তৃক অনূদিত পরাগলী মহাভারতই প্রথম অনূদিত মহাভারত। পরাগলী মহাভারতের ভাষাভঙ্গি সরল হলেও কাব্যগুণান্বিত নয়, মূল মহাভারতের কোন আস্বাদ এ অনূদিত কাব্য হতে পাওয়া যায় না।

প্রশ্নঃ ভারতচন্দ্র-এর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

উত্তরঃ মঙ্গলকাব্যের এবং মধ্যযুগেরও সর্বশেয় কবি ভারতচন্দ্র। তার জীবনকাল ১৭১২-১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ। তিনি হুগলী জেলার পেড়োয় জন্মগ্রহণ করেন। কবি ধনী ঘরের সন্তান ছিলেন। তার পিতা ছিলেন ভুরসুট পরগনার জমিদার। বর্ধমানরাজের দেয়া অনাদায়ে তার পিতার তালুকটি খাস করে নেয়। বর্ধমানরাজ কীর্তিচাঁদ ভুরসুট অধিকার করে নিলে ভারতচন্দ্রের পিতা নরেন্দ্র রায় হৃতসর্বস্ব হয়ে পড়েন। বর্ধমানে প্রতিবিধানের চেষ্টা করতে এসে কবি কারাবন্দী হন”। পাহারাদারকে ঘুষ দিয়ে কবি সেখান থেকে পালিয়ে কাশী চলে যান৷

ভারতচন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও কৌতূহলী। মাত্র বিশ বছর বয়সের মধ্যে তিনি বাংলা, সংস্কৃত ও ফারসি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। কবি নিজ উদ্যোগে চৌদ্দ বছর বয়সে বিয়ে করায় পারিবারিক বিভ্রাট দেখা দেয় এবং এক পর্যায়ে ভারতচন্দ্র গৃহত্যাগ করেন। বিশ বছর বয়সে বাড়ি ফিরে বিষয়কর্ম দেখাশুনা করেন। এ সময়ই বাবার সঙ্কট সমাধানে তিনি কারারুদ্ধ হয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যান, এবং কিছুদিন পুরী, বৃন্দাবন প্রভৃতি তীর্থে কাটিয়ে এক সময় দেশে ফিরে গার্হস্থ্য কর্মে আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় জীবিকার জন্য চন্দননগরের ফরাসি সরকারের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর শরণাপন্ন হন। এই ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর সহায়তায় তিনি কৃষ্ণনগরের রাজসভায় কবি হিসেবে স্থান পেয়েছিলেন। অতঃপর মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কবিকে মূলাজোড় গ্রাম দান করেন। এই মূলাজোড় গ্রামেই কবি অবশিষ্ট জীবন অতিবাহিত করেন।

নবদ্বীপের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ভারতচন্দ্রের কবিতা শুনে মুগ্ধ হয়ে তাকে ‘রায়গুণাকর’ উপাধি দেন। সেই থেকে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর নামে পরিচিত হন। কৃষ্ণচন্দ্রের আদেশে তিনি তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘অন্নদামঙ্গল’ রচনা করেন। বিবর্তনের পথ ধরে মঙ্গলকাব্যের ধারা এবং বাংলা ভাষা তার হাতে আশ্চর্য পরিণতি লাভ করে। তার মত শব্দকুশলী ভাষাশিল্পী কবি শুধু মধ্যযুগে কেন, সমগ্র বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দুর্লভ। নতুন জীবনের উল্লাস তার ভাষায়, ছন্দে এবং কাহিনী নির্মাণে ও চরিত্র সৃষ্টিতে গতানুগতিকতা পরিহারে। তাঁর রচনায় সমকালীন জীবনের অবক্ষয়ের ছবি স্পষ্ট প্রকাশ পেয়েছে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার অন্তঃসারশূন্য চাকচিক্য ও বিকৃত রুচির পরিচয় ভারতচন্দ্রের কাব্যে পরিদৃশ্যমান। প্রতিভাশালী কবি ভারতচন্দ্রের কাব্যে বাগবৈদগ্ধের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন নাগরিক কবি। তার বাগবৈদগ্ধ, যুক্তিবুদ্ধি, নব-নির্মিত আর্থ-সামাজিক ও বাংলার উত্থান-পতন তার মঙ্গলকাব্যে স্থান করে নিয়েছে। নতুন জীবনের উল্লাস তার ভাষায়, ছন্দে, কাহিনী নির্মাণে ও শিল্পবোধে। সেই সঙ্গে ভারতচন্দ্রের কাব্যে ব্যঙ্গ ও রঙ্গরস প্রচুর। তার ব্যঙ্গরস সর্বদাই উইট এর খেল। তার হাস্যরসের মধ্যে দীপ্তবুদ্ধি ও বাক-চাতুর্যের খেলা লক্ষ্য করা যায়। ফারসি ভাষায় পাণ্ডিত্যের কারণে তিনি যাবনী মিশাল বাংলা ভাষার অবতারণা করেছিলেন।

ভারতচন্দ্র সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরীর চিরস্মরণীয় উক্তি— “Bharat Chandra as a supreme literary craftsman, will ever remain a master to us writers of the Bengali language.” রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “রাজ সভাকবি ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল গান রাজকণ্ঠের মণিমালার মত, যেমন তাহার উজ্জ্বলতা তেমনি তাহার কারুকার্য।”

তিনি ‘সত্যপীরের পাঁচালী’, ‘রসমঞ্জরী’, ‘নাগাষ্টক’, ‘অন্নদামঙ্গল’, ‘চণ্ডীনাটক’ প্রভৃতি কাব্য ও বিবিধ কবিতা রচনা করেছেন।