প্রশ্নঃ আইনের উৎস সম্পর্কিত ধারণা তুমি কিভাবে ব্যাখ্যা করবে? আইনবিজ্ঞানের বিভিন্ন মতবাদগুলো কি কি? আইনের আইনগত উৎস এবং ঐতিহাসিক উৎসের মধ্যে পার্থক্য কর।
উত্তরঃ আইনের উৎস সম্পর্কিত ধারণার ব্যাখ্যা : সাধারণ অর্থে উৎস বলতে উৎপত্তিস্থল বুঝায় অর্থাৎ আইনের উৎস বলতে বুঝায় আইন কোথা হতে সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আইন বিজ্ঞানীগণ এই সহজ অর্থ গ্রহণ না করে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে এর ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। কারো মতে, আইনের উৎস বলতে সার্বভৌম ক্ষমতা বা রাষ্ট্রকে বুঝায়, কেননা এখান থেকেই আইন শক্তি বা বৈধতা লাভ করে । কারো মতে আইনের কারণসমূহই আইনের উৎস।
প্রখ্যাত আইনবিজ্ঞানী গারভিচ (Gurvitch) বলেন যে, আইনের বৈধতা বিবেচনা করাই হলো আইনের উৎস নিরূপণের একমাত্র উদ্দেশ্য। অর্থাৎ আইনের উৎস সম্পর্কে গুরুত্ব আরোপ করার একমাত্র কারণ আইনের প্রকৃতি নির্ণয় করা নয়, মূলতঃ আইনের বৈধতা বিচার করাই এর প্রধান উদ্দেশ্য।
অস্টিন তিন অর্থে আইনের উৎস শব্দটির ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। প্রথমতঃ আইন প্রণয়ন ক্ষমতা অর্থাৎ দেশের সার্বভৌম ক্ষমতা। দ্বিতীয়তঃ এটা ঐতিহাসিক দলিলকে বুঝায় যেমন, রোমানদের টুয়েল টেবলস-যা থেকে আইন জানা যায়। তৃতীয়তঃ যে সব ঘটনা থেকে কোন বিধি আইনের রূপ লাভ করে তাই হচ্ছে আইনের উৎস। যেমন, প্ৰথা ৷
কিটন বলেন, আইনের উৎস বলতে ঐ সকল বিষয়কে বুঝায় যার দ্বারা আদালতের কার্যক্রমের মাধ্যমে আইন সৃষ্টি হয়।
এ্যালেনের মতে, যার দ্বারা মানুষের আচরণবিধি আইনের মর্যাদা লাভ করে তাই হচ্ছে আইনের উৎস।
ওপেন হেইমের মতে, আইনের উৎস হলো একটি ঐতিহাসিক ঘটনা যার দ্বারা আচরণবিধির সৃষ্টি হয় এবং আইনের মর্যাদা লাভ করে। আবার কারো মতে, সৃষ্টিকর্তা বা প্রকৃতি হচ্ছে আইনের উৎস।
আইনের উৎসগুলির মধ্যে সবগুলিই বাধ্যতামূলক নয়। আইন ও আদালত কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সকল উৎসই বাধ্যতামূলক। যেমন, সংবিধান প্রণীত আইন স্বীয় দেশের বিচার বিভাগীয় পূর্ব-দৃষ্টান্ত ইত্যাদি বাধ্যতামূলক উৎস। কিন্তু প্রথা, ধর্মীয় অনুশাসন, বিদেশী আদালতের পূর্ব-সিদ্ধান্ত, প্রখ্যাত আইনবিদদের প্রণীত গ্রন্থসমূহ বাধ্যতামূলক উৎস নয়। আদালত এগুলি বিবেচনা করেন বটে তবে তা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকেন না।
আইন বিজ্ঞানের মতবাদঃ সাধারণ অর্থে আইনের উৎস, উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি সম্পর্কে মৌল তত্ত্বের ধারাবাহিক আলোচনা ও বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা হচ্ছে আইনবিজ্ঞানের কাজ। কিন্তু এ কার্যে আইনবিশারদগণ ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেন নাই। তারা নিজ নিজ ধারণা ও মতাদর্শের দৃষ্টিতে এগুলি ব্যক্ত করেছেন। তাই সকলের গ্রহণযোগ্য এবং বিতর্কের ঊর্ধে কোন সংজ্ঞা প্রদান করা সম্ভবপর হয় নাই। আইনবিজ্ঞানীদের প্রদত্ত মতামতগুলি শ্রেণীবিন্যাস করা হয়েছে এবং এগুলিকেই আইনবিজ্ঞানের মতবাদ বলে। এই মতবাদগুলি প্রধানতঃ নিম্নোক্ত তিনটি শ্রেণীতে বিভক্তঃ
(১) বিশ্লেষণমূলক মতবাদ (Analytical School)
(২) ঐতিহাসিক মতবাদ (Historical School)
(৩) নৈতিক মতবাদ (Ethical School)
এগুলি ছাড়াও নিম্নোক্ত তিনটি মতবাদ পরিলক্ষিত হয়ঃ
(১) সমাজতান্ত্রিক মতবাদ (Sociological School)
(২) দার্শনিক মতবাদ (Philosphical School)
(৩) তুলনামূলক মতবাদ (Comparative School)
১। বিশ্লেষণমূলক মতবাদঃ ব্রিটিশ আইনবিজ্ঞানী স্যার জন অষ্টিন কর্তৃক প্রবর্তিত এই মতবাদ আইনের আদর্শ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে না, বরং রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত আইনের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দ্বারা এর কার্যকারিতা যথার্থ ভাবে এবং নিশ্চিতভাবে বলবৎ করাই হচ্ছে এর মুখ্য উদ্দেশ্য। এই মতবাদকে সুনিশ্চিত আইনের মতবাদ, অবশ্য পালনীয় মতবাদ ও পজিটিভিজম হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়।
২। ঐতিহাসিক মতবাদঃ অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ হতে জার্মানীতে সর্ব প্রথম আইন-বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক মতবাদের উদ্ভব ঘটে। জার্মান আইন-বিজ্ঞানী স্যাভাইনি এই মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা। হেনরী মেইন (Henry Main-এর মতে মন্টেস্কু (Montes Quien) এই মতবাদের প্রথম প্রবক্তা। এই মতবাদ অনুসারে একটি জাতির অতীত ইতিহাস হতে তার আইনের মূল বিষয়বস্তু গৃহীত হয়। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্মধারার সাথে আইন অলংঘনীয় নিয়মে গ্রথিত। কিরূপে সামাজিক আচরণের নিয়ন্ত্রণবিধি ক্রম-বিবর্তনের ধারায় আইনের অনুশাসন দ্বারা আদিকাল হতে নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে এবং কিরূপে বিভিন্ন অবস্থায় তা পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপে বিকাশ লাভ করেছে, সেগুলি অনুসন্ধান করাই ঐতিহাসিক মতবাদের লক্ষ্য।
৩। নৈতিক মতবাদঃ নৈতিক মতবাদ ন্যায়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। কোন বিশেষ আইন কি উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রণীত হয়েছে তা অনুসন্ধান করে এই মতবাদ। সামাজিক মঙ্গলই হচ্ছে আইনের লক্ষ্য। তাই রাষ্ট্রীয় শক্তির সাহায্যে আইন প্রয়োগ করে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করাই হচ্ছে আইনের উদ্দেশ্য এই মতবাদে বিশ্বাসী আইনবিজ্ঞানীগণ মনে করেন যে, নীতিগতভাবে আইনের যে সকল ত্রুটি রয়েছে, সেগুলি সম্পর্কে যথাযথভাবে পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় সংশোধন করতঃ এর অসম্পূর্ণতা দূর করা হচ্ছে এর উদ্দেশ্য। মোটের উপর আইনের নীতিগত আদর্শ কিরূপ হওয়া উচিত, তা নির্ধারণ করাই এই মতবাদের উদ্দেশ্য।
৪। সমাজতান্ত্রিক মতবাদঃ আইনের প্রকৃত সার্থকতা সামাজিক শৃঙ্খলা ও উন্নয়ন সাধন। সামাজিক এ স্বার্থ সংরক্ষণে সুচিন্তিত বিধি বিধান সৃষ্টি এই মতবাদের লক্ষ্য ব্যক্তিস্বার্থের সহিত সমষ্টিগত স্বার্থের সমন্বয় সাধন করার আইনগত কৌশল উদ্ভাবনের পর্যালোচনা করা আইনবিজ্ঞানের কাজ। কোন্ সমাজে কোন্ আইন কিভাবে প্রয়োগযোগ্য হবে, আইনবিজ্ঞান তা পর্যালোচনা করতঃ সঠিক ও সুষ্ঠু কৌশল প্রদান করে থাকে।
৫। দার্শনিক মতবাদঃ দার্শনিক মতবাদের ভিত্তি হলো প্রকৃতি, ধর্ম এবং বিবেক। প্রাকৃতিক, নৈতিক বা অধিবিদ্যা — এই তিন ধরনের অনুশাসন দ্বারা মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রাকৃতিক জগতের কোন অনিয়মের কারণে যেমন প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে, তেমনি মনুষ্য সমাজের স্বাভাবিক নিয়ম বা বিবেক বিরুদ্ধ আচরণের ফলে সামাজিক অনাচার ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। গ্রীক দার্শনিকগণ তাই প্রকৃতিকে অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
৬। তুলনামূলক মতবাদঃ আইনবিজ্ঞানের তুলনামূলক মতবাদটি সাম্প্রতিক কালের চিন্তাধারার একটি প্রতিচ্ছবি। এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন আইন ব্যবস্থা সম্পর্কে অধ্যয়ন করা হয় এবং তুলনামূলক বিশ্লেষণ দ্বারা সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যগুলি চিহ্নিত করা হয়। এ্যালেন, জেরেমি বেনথাম, হল, প্যাটারিজ ও শোলিঞ্জার এই মতবাদের সমর্থক।
আইনগত উৎস এবং ঐতিহাসিক উৎসের মধ্যে পার্থক্যঃ যে সকল আইন দ্বারা স্বীকৃতি এবং আদালত কর্তৃক প্রয়োগ করা হয়ে থাকে সেগুলি হচ্ছে আইনগত উৎস। কিন্তু যেগুলি আইন কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করেনি কিংবা আদালত কর্তৃক প্রয়োগের ব্যাপারে কোন বাধ্যবাধকতা নেই, কিন্তু আইন বিকাশে যেগুলির যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে সেগুলিকে ঐতিহাসিক উৎস বলে।
আইনগত উৎস এবং ঐতিহাসিক উৎসের মধ্যকার পার্থক্য প্রকৃত অর্থে শুধু তত্ত্বীয় ব্যাপার মাত্র। প্রতিটি আইনগত উৎসের ভিত্তি ঐতিহাসিক উৎসের উপর গ্রথিত। দেশের বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তকে আইনগত উৎস হিসেবে সেদেশের আদালত তা বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োগ করে থাকে। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সময় আদালত কোন বিদেশী আদালতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকতে পারেন কিংবা কোন অইন বিশারদের গ্রন্থ হতে সংগ্রহ করতে পারেন যা ঐতিহাসিক উৎস হিসেবে পরিগণিত। একটি নতুন আইন প্রণয়নের সময় বিভিন্ন দেশের আইন, প্রখ্যাত আইন গ্রন্থাবলী এবং বিভিন্ন আদালতের মতামত বিবেচনা করা হয়। এগুলি সবই ঐতিহাসিক উৎস, কিন্তু প্রণীত আইন হচ্ছে আইনগত উৎস। আইনগত উৎস এবং ঐতিহাসিক উৎসের মধ্যে হয়।
পার্থক্য থাকলেও একটি অপরটি হতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র নয়; বরং একটি অপরটির সম্পূরক। এদের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা হয় আইনের বৈধতা বিচার করার জন্য, আইনের প্রকৃতি নির্ণয় করার জন্য নয়। আইনের কার্যকারিতা ও প্রয়োগযোগ্যতা বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, আইনগত উৎসই সর্বক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আইনের সমৃদ্ধি ও সামগ্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক উৎসগুলিই প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে।
Leave a comment