সমাজতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর


প্রশ্নঃ সমাজতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, সমাজতান্ত্রিক সমাজের মূল বৈশিষ্ট্য সমূহ বিশেণ কর।

ভূমিকাঃ সমাজতাত্ত্বিক আলোচনার এক বিশাল অংশ জুড়ে সমাজতন্ত্র স্থান দখল করে আছে। বিশেষ করে ১৯১৭ সালে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বিশ্ব চেতনাকে বিপুলভাবে নাড়া দিয়েছে। ফলে পাশ্চাত্যের সমাজতাত্ত্বিকদের লেখায় এর পক্ষে-বিপক্ষে প্রচুর বক্তব্যের সমাবেশ ঘটে। এই সমাজতন্ত্র একটি মতাদর্শ ও কর্মপদ্ধতি হিসেবে রাজনৈতিক স্বার্থ ও মূল্যবোধ থেকে জন্ম নিয়েছে৷

সমাজতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্যঃ নিম্নে সমাজতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরা হলো-

(১) রাষ্ট্রীয় মালিকানাঃ এ সমাজে ব্যক্তিগত মালিকানা বলে কিছু থাকে না। ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় মালিকানা গড়ে ওঠে। এ সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং ব্যক্তিগত সম্পদ অর্জনের লাগামহীন প্রতিযোগিতার কোনো সুযোগ থাকে না। এ সমাজে সাম্য ও স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়।

(২) সমান সুযোগঃ সমাজতন্ত্রের মূল বাণী হলো ‘সকলের জন্য সমান সুযোগ’। সমাজতন্ত্রের প্রবক্তাগণ মনে করেন সকল প্রকারের অসাম্যই কৃত্রিম। সকলের জন্য তথা সমাজের প্রত্যেকের বস্তুগত সুবিধা পাওয়ার নৈতিক অধিকার আছে । আর এ কারণে এ সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তির সুবিধা ও অন্যান্য প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

(৩) রাজনৈতিক সাম্যঃ সমাজতান্ত্রিক সমাজের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো সমাজের মধ্যে রাজনৈতিক সাম্য। তবে সমাজতন্ত্রের প্রবক্তাগণ মনে করেন অর্থনৈতিক সাম্য ছাড়া রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। কোনো সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা হলে সে সমাজে রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হয়।

(৪) ব্যক্তিগত মুনাফার বিলোপঃ সমাজতান্ত্রিক সমাজে সকল অর্থনৈতিক কার্যক্রম রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। মুনাফা বণ্টনের ক্ষেত্রে এ নীতি কার্যকর। সমাজে মুনাফা ভোগের কোনো স্বীকৃতি থাকে না। এ সমাজে মনে করা হয় ব্যক্তিগত মুনাফার বিলোপ হলেই সমাজের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত হয়।

(৫) অর্থনৈতিক পরিকল্পনাঃ এ সমাজের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এখানে সঠিক ও কার্যকর অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কোন দ্রব্য কতটুকু উৎপাদিত হবে, কার জন্য উৎপাদিত হবে, কে কতটুকু ভোগ করবে এ ধরনের নীতিমালা অর্থনৈতিক পরিকল্পনাতে যুক্ত থাকে। এ সমাজের অর্থনীতিকে পরিকল্পিত এবং সুষম অর্থনীতি বলা হয়।

(৬) শোষন মুক্ত সমাজঃ সমাজতান্ত্রিক সমাজের মূল লক্ষ্য থাকে যে, এখানে একে অন্যের মাধ্যমে যেন শোষিত, নিপীড়িত এবং বঞ্চিত না হয়। আর এ কারণে এখানে শ্রেণিহীন এবং শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ সুনিশ্চিত হয়। সমাজতন্ত্রে জনগণের সকল অংশই সমান প্রাপ্যের অংশীদার হয়।

(৭) অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারঃ সমাজতান্ত্রিক সমাজে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সংস্কারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। উৎপাদনের উপাদানগুলোকে সমভাবে বণ্টন করার জন্য এ মতবাদ বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজি সংস্কার গ্রহণের পক্ষপাতী।

(৮) শ্রেণী সংগ্রামঃ সমাজতান্ত্রিক সমাজে শ্রেণি সংগ্রাম সংগঠিত হয়ে থাকে। কার্ল মার্কস তার বক্তব্যে বলেন, সল যুগেই অর্থনৈতিক কারণে মানুষ বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত হয়েছে। তার মতে, মানব সমাজের ইতিহাস শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। আর কোনো সমাজে যখন অর্থনৈতিক সচেতনতা তৈরি হয় তখন শ্রেণি সংগ্রাম শুরু হয়। শ্রেণি সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে বুয়ো শ্রেণি তাদের অস্তিত্বকে হারিয়ে ফেলে।

(৯) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাঃ পৃথিবীর সকল সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় না। সমাজতান্ত্রিক সজে সকল প্রকার বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তবে একটা সত্য যেকোনো সমাজে ব্যতি মালিকানা উচ্ছেদ করতে হলে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা দরকার।

(১০) দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদঃ কার্ল মার্কস তার সমাজ দর্শনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের কথা তুলে ধরেছেন। সমাজতন্ত্রবাদীদের ভাষায় প্রত্যেক বস্তুই একে অপরের সাথে সম্পর্কিত এবং নির্ভরশীল। আর এ কারণে সমাজে একটির পরিবর্তন অপরটিকে প্রভাবিত করে।

(১১) উৎপাদনের সুষ্ঠু ব্যবহারঃ সমাজতান্ত্রিক সমাজে ব্যক্তিগত মালিকানায় কোনো উৎপাদন হয় না। সেখানে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় উৎপাদন হয় বলে উৎপাদনের সকল উপাদানের ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত থাকে রাষ্ট্রের হাত। আর এ কারণে সমাজতান্ত্রিক সমাজে উৎপাদনের উপকরণসমূহ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও উপাদানসমূহের ব্যবহার নির্গত হয়। 

(১২) উদ্বৃত্ত মূল্যঃ উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্ব মার্কসের একটা অন্যতম প্রত্যয়। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব শ্রেণি সংগ্রামের ফলশ্রুতি হিসেবে অভিহিত করা হয়। উদ্বৃত্ত মূল্য হলো সেটিই শ্রমিকদের দেয় শ্রমের বিনিময় মূল্য এবং শ্রমের দ্বারা উৎপাদিত বিক্রয় মূল্যের মধ্যে যে ব্যবধান তাই উদ্বৃত্ত মূল্য।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা একটা গতানুগতিক সমাজ ব্যবস্থার বিপরত। যেখানে সকল অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে সকল নাগরিকের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হয়। উল্লেখ্য যে, এ সমাজে অর্থনৈতিক মুক্তির সার্বিক দিক তুলে ধরা হলেও এটি নানা ধরনের বিতর্কের জন্ম দেয়।