প্রশ্নঃ হিন্দু আইনের বিভিন্ন মতবাদসমূহ সৃষ্টির কারণসমূহ বর্ণনা কর এবং দায়ভাগ ও মিতাক্ষরা মতবাদের মধ্যে পার্থক্য দেখাও।  

উত্তরঃ বিভিন্ন মতবাদের কারণঃ হিন্দু আইনের প্রধান মূল উৎস শ্রুতি ও স্মৃতি। ঋষি-মুনিদের নিকট প্রেরিত ঈশ্বরের বাণী হচ্ছে শ্রুতি। মুনিবর কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ এগুলি সংকলিত করেন এবং এগুলি মহাধর্মগ্রন্থ বেদ নামে খ্যাত। শ্রুতির পরেই গুরুত্বপুর্ণ উৎস হচ্ছে স্মৃতি। সে যুগে লেখার প্রচলন ছিল না তাই গুরু শিষ্য পরস্পরায় ধর্মীয় নির্দেশাবলী মুখে মুখে বহন করতেন। স্মৃতির অর্থই হচ্ছে যা মনে রাখা হয়েছে। পরবর্তীকালে স্মৃতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ভাষ্যকারগণের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠিত প্রথার ভিত্তিতেই তারা ব্যাখ্যা প্রদান করতে থাকেন। এক শ্রেণীর পণ্ডিতগণ কিছুটা রক্ষণশীল মনোভাবের পরিচয় দেন এবং অপর শ্রেণীর পণ্ডিতগণ কিছুটা উদারপন্থীর পরিচয় দেন। এর ফলে দুটি প্রধান শিবিরের সৃষ্টি হয়। রক্ষণশীল মনোভাবের শিবিরকে বলা হয় মিতাক্ষরা মতবাদ এবং উদারপন্থী শিবিরের নাম দায়ভাগ মতবাদ। মিতাক্ষরা হচ্ছে যাজ্ঞবন্ধের বিধানের ভাষ্য যা একাদশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানেশ্বর কর্তৃক প্রণীত হয়েছে। জিমূতবাহন নামক অপর একজন পণ্ডিত ত্রয়োদশ-চতুৰ্দশ শতাব্দীর মধ্যে দায়ভাগ বিধান প্রণয়ন করেন। প্রচলিত সকল বিধি-বিধানের উপর ভিত্তি করে দায়ভাগ লিখিত হয়েছে। মিতাক্ষরাকে প্রাচীন শাস্ত্রপন্থী এবং দায়ভাগ বিধানকে প্রগতিশীল হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দায়ভাগ এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে মিতাক্ষরা মতবাদ প্রচলিত আছে। ভারতের বিভিন্ন এলাকায় আবার কিছু কিছু ছোট খাট বিষয় নিয়ে মতানৈক্য দেখা দেয়, বিশেষ করে দত্তক গ্রহণ ও উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে বৈসাদৃশ্য দেখা দেয়, এর ফলে মিতাক্ষরা পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এগুলি হচ্ছে (১) বানারস বা কাশীপন্থী, (২) মিথিলপন্থী, (৩) বোম্বাই পন্থী, (৪) মাদ্রাজপন্থী ও (৫) পাঞ্জাব পন্থী।

জন প্রখ্যাত রামানন্দ (কালেক্টর অব মাদুরা বনাম মুত্তু) মামলায় প্রিভি-কাউন্সিলের বিচার বিভাগীয় কমিটি এ সকল বিভিন্ন মতবাদ সৃষ্টির কারণ সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা প্রদান- করেছেন। তাদের মতে, বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত স্মৃতিশাস্ত্র হিন্দু আইনের প্রাচীনতম মূলসূত্র হিসেবে স্বীকৃত। এর উপর ভিত্তি করেই হিন্দু আইন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু অঞ্চল হিসেবে শাস্ত্রীয় আইনের পরবর্তীকালে ব্যাখ্যার মধ্যে বৈসাদৃশ্য দেখা যায়। এক অঞ্চলের প্রতিষ্ঠিত আইনের ভাষ্য অন্য অঞ্চলের ভাষ্যকারগণ মেনে নেন না। শাস্ত্রীয় বিধানের ব্যাখ্যার ব্যাপারে ভাষ্যকারগণ ঐকমত্য পোষণ করেন নাই হেতু বিভিন্ন মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। তবে সকল ক্ষেত্রে স্থানীয় বা আঞ্চলিক প্রথা এ সকল মতবাদকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে, কৈননা প্রথার সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করেই এ সকল বিভিন্ন বিধান প্রবর্তিত হয়।

দায়ভাগ ও মিতাক্ষরা মতবাদের মধ্যে পার্থক্যঃ হিন্দু সমাজের মূল দুটি শিবির দায়ভাগ ও মিতাক্ষরার মধ্যে নিম্নোক্ত পার্থক্যগুলি বিদ্যমানঃ

(১) উদ্ভবঃ ত্রয়োদশ-চতুর্দশের মধ্যে জিমূতবাহন নামক একজন পণ্ডিত দায়ভাগ মতবাদ প্রবর্তন করেন। মনু, যাজ্ঞবল্ক ও নারদ কর্তৃক সংকলিত তিনটি স্মৃতিশাস্ত্রের সারাংশ হচ্ছে এই মতবাদ। তাই একে প্রগতিশীল বিধান হিসেবে গণ্য করা হয়।

একাদশ শতাব্দীতে অপর এক পণ্ডিত বিজ্ঞানেশ্বর, মিতাক্ষরা মতবাদ প্রবর্তন করেন। যাজ্ঞবল্ক কর্তৃক সংকলিত স্মৃতিশাস্ত্রের ইহা হচ্ছে এক ধারাবাহিক ব্যাখ্যা। একে প্রগতিশীল বিধান না বলে রক্ষণশীল বিধান হিসেবে গণ্য করা হয়।

(২) প্রয়োগঃ দায়ভাগ মতবাদ বাংলাদেশের ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সমাজের উপর প্রয়োগ করা হয়।

পক্ষান্তরে, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের হিন্দুগণ মিতাক্ষরা মতবাদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অবশ্য এক অঞ্চলের হিন্দু অন্য অঞ্চলে গমন করলে তিনি তার নিজস্ব মতবাদ অনুসরণ করতে পারবেন।

(৩) উত্তরাধিকারের নীতিঃ দায়ভাগ মতে, মৃত ব্যক্তির শ্রাদ্ধে যারা পিণ্ডদানের অধিকারী হন তারাই মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী হবার যোগ্য। কিন্তু মিতাক্ষরা মতে, মৃত ব্যক্তির সাথে রক্তের সম্পর্কিত ব্যক্তিগণ উত্তরাধিকারী হন।

(৪) উত্তরাধিকারীদের শ্রেণীঃ দায়ভাগ মতে, তিন শ্রেণীর উত্তরাধিকারী রয়েছে। যথাঃ সপিণ্ড, সকুল্য ও সমানোদক।

পক্ষান্তরে, মিতাক্ষরা মতে যে শ্রেণীর উত্তরাধিকারী আছেন তারা হলেন, সপিণ্ড সমানোদক ও বন্ধু।

(৫) সম্পত্তি ন্যস্ত হওয়াঃ দায়ভাগ মতে কেবলমাত্র উত্তরাধিকারীদের উপর মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি ন্যস্ত হয়।

মিতাক্ষরা মতে, উত্তরাধিকার ছাড়াও উত্তরজীবি পন্থা অনুসরণ করা হয়। যে সম্পত্তি বিভিন্ন হাত বদলের পর শেষ অধিকারীর হাতে আসে সেক্ষেত্রে উত্তরজীবি নীতি প্রয়োগ করা হয়। যেমন, ক ও খ দুই ভাই এর মধ্যে তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি ভাগ হবার পূর্বেই ক দুই পুত্র গ ও ঘ কে রেখে মারা যায়। এমতাবস্থায় উক্ত সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে খ এর উপর এবং উত্তরজীবি সূত্রে গ ও ঘ এর উপর ন্যস্ত হবে। উত্তরজীবি হিসেবে অবশ্য শুধু পুরুষ সদস্য সম্পত্তি পেয়ে থাকে।

(৬) অসতীত্বের কারণে সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হওয়াঃ অসতীত্বের কারণে দায়ভাগ মতে সকল মহিলা উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হয়।

পক্ষান্তরে, মিতাক্ষরা মতে কেবলমাত্র বিধবাই উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হয়।

(৭) যৌথ পারিবারিক সম্পত্তির ক্ষেত্রেঃ দায়ভাগ মতে, পিতার মৃত্যুর পর তার সম্পত্তিতে সন্তানেরা অধিকার লাভ করে। কাজেই পিতা তার জীবদ্দশায় ইচ্ছানুযায়ী স্বীয় সম্পত্তি বিক্রয়, দান, উইল, ইত্যাদি দ্বারা হস্তান্তর করতে পারেন। সম্পত্তি ভাগ করার জন্য পুত্র দাবী করতে পারে না।

পক্ষান্তরে, মিতাক্ষরা মতে একজন সহ উত্তরাধিকারীর একটি পুত্র জন্মগ্রহণের সাথে সম্পত্তিতে অধিকার লাভ করে। কতিপয় বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া পিতা ইচ্ছামত তার সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন না। ইহা ছাড়া পুত্র পিতার সম্পত্তি বাটোয়ারা করে নিতে পারে এবং যৌথ সম্পত্তির আয় ব্যয়ের হিসাব দাবী করতে পারে।

(৮) বাটোয়ারার পূর্বেই হস্তান্তরঃ দায়ভাগ বিধান অনুযায়ী যৌথ পরিবারের কোন সদস্য ভাগ-বাটোয়ারার পূর্বেই তার অংশের সম্পত্তি বিক্রি বা অন্যভাবে হস্তান্তর করতে পারে।

কিন্তু মিতাক্ষরা মতে যৌথ পরিবারের কোন সদস্য ভাগ বাটোয়ারার পূর্বে তার সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারে না।

(৯) ফ্যাকটাম ভ্যালেটঃ দায়ভাগ বিধানে ফ্যাক্‌টাম ভ্যালেট নীতি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হয়। যদিও নৈতিকতা বিরোধী বা অবৈধ কাজে এর প্রয়োগ চলে না।

মিতাক্ষরা মতে ফ্যাকটাম ভ্যালেট এর স্বীকৃতি থাকলেও এর প্রয়োগ খুবই সীমিত।

এগুলিই হচ্ছে দায়ভাগ ও মিতাক্ষরা মতবাদের মধ্যে প্রধান পার্থক্য। যদিও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আরও পার্থক্য অনেক রয়েছে।