প্রশ্নঃ “শ্রীচৈতন্যের হাত ধরে বাঙালি জাতি মানবপ্রেমে দীক্ষিত হয়”—মন্তব্যটির যাথার্থ্য নির্ণয় কর।
অথবা, শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব বাঙালির ও বাংলা সাহিত্যের রেনেসাঁর যুগ।—মন্তব্যটি পর্যালোচনা কর।
অথবা, “বাংলার ধর্ম ও সমাজের ক্ষেত্রেই শুধু নয়, সাহিত্যের ক্ষেত্রেও চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে বিপ্লব ঘটেছিল।”— এ উক্তির আলোকে বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণববাদের অবদান আলোচনা কর।
অথবা, “শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব ষোড়শ শতকের রেনেসাঁ।”—আলোচনা কর।
উত্তরঃ বিশ্ব প্রগতির ইতিহাসে বিভিন্ন যুগে ও দেশে এমন কিছু কালজয়ী ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটে যারা সমাজ চৈতন্যে বিশেষ পরিবর্তন সাধন করে জাতির কাছে হয়ে ওঠে নমস্য ও পূজনীয় মাইকেল মধুসূদন দত্ত যেমন এককভাবে আধুনিক যুগের প্রবক্তা, তেমনি শ্রীচৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩) বাংলার ধর্ম, সমাজ ও সাহিত্য ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধন করে নতুন জীবন প্রবাহের সঞ্চার করেন।
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাব অপরিসীম। বৈষ্ণবধর্মের ব্যাপক সম্প্রসারণের মাধ্যমে তিনি এদেশে হিন্দু-সমাজে যে নব চেতনার সঞ্চার করেছিলেন তার ব্যাপক প্রভাব ধর্মের সীমানা অতিক্রম করে এদেশের সমাজ ও সাহিত্যে সম্প্রসারিত হয়ে তাঁকে অমর করে রেখেছে। তার প্রভাবে বৈষ্ণব সাহিত্যের বিচিত্রমুখী বিকাশ ছাড়াও সাহিত্যের অপরাপর শাখায় যথেষ্ট অভিনবত্ব দেখা দিয়েছিল। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চৈতন্যদেবকে মুসলিম যুগে উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ এবং বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ বলে উল্লেখ করেছেন।
বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমনের ফলে হিন্দু সমাজে ভাঙন ধরে এবং ধর্মে নামে ধস। কারণ ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচারে নিম্নবিত্ত হিন্দুরা অতিষ্ঠ হয়ে দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। চৈতন্যদেব সে ভাঙন রোধ করার জন্য প্রেমধর্মের প্রচার করেন এবং অস্পৃশ্যতার অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্ত করতে প্রয়াসী হন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করে একটি অখণ্ড ভ্রাতৃ-সমাজের প্রতিষ্ঠা তিনি বৈষ্ণব ধর্মের ছায়াতলে গড়ে তোলেন। তার প্রচারিত প্রেমধর্ম, প্রেমকথা বাঙালির জীবন চেতনায় অভূতপূর্ব আনন্দ ও জাগরণ এনে দিল। ফলে বাঙালির আচারসর্বস্ব দেবদেবী নির্ভর সমাজজীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়৷
চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে যে প্রভাব লক্ষ্য করা যায় তা হচ্ছে, ঐতিহাসিক ও সামাজিক দিক থেকে দেশ জাতি মুক্তির পথের সন্ধান পায়, মানবপ্রেমে সমৃদ্ধ বৈষ্ণব দর্শন ও ধর্ম সম্প্রদায় গড়ে ওঠে এবং অধ্যাত্মভাব, চিত্ত সৌন্দর্য ও মধুর প্রেমরসের এক সমৃদ্ধ বৈষ্ণব সাহিত্য সৃষ্টি হয়। ‘বাঙালির হিয়া অমিয় মথিয়া নিমাই ধরেছে কায়া।’— চৈতন্য প্রভাবের স্বরূপ সম্পর্কে কবির এই উক্তি থেকে তাৎপর্য সহজেই অনুধাবন করা যায়। এতে বাঙালির ভৌগোলিক সংকীর্ণতা দূরীভূত হয় এবং সারা ভারতের সাথে সংযোগ ঘটে। এতে নীলাচল, বৃন্দাবন ও মথুরা বাঙালির তীর্থে পরিণত হয়। প্রেমভক্তির দিক ছাড়াও ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতির বিচারে চৈতন্য প্রভাব বাংলাদেশের জন্য সীমাহীন গুরুত্ব বহন করে। তিনি ধর্মের ক্ষেত্রে বিপ্লব এনেছেন। সমাজের ক্ষেত্রে পরিবর্তন সূচিত করেছেন, তেমনি সাহিত্য ক্ষেত্রেও অবদান রেখেছেন, তবে তা প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষভাবে। তিনি বাংলা সাহিত্য রচনা বা চর্চা করেন নি, কিন্তু সাহিত্য রচনার উপাদান সৃষ্টি করেছেন, পরিবেশ গড়ে তুলেছেন এবং সৃষ্টির আনন্দ তার ভক্ত ও অনুচরদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তার পূর্বে বাংলা সাহিত্যে কাহিনীকাব্য ছিল, কিন্তু তারই প্রভাবে বিচ্ছিন্ন পদ রচিত হয়েছে। চৈতন্যদেবের পূর্বে রাধাকৃষ্ণের প্রেম ছিল বটে, তবে তা ছিল ঈশ্বর ও লোকজ প্রেম। তাতে ভোগের অবকাশ ছিল। বৈষ্ণব পদাবলী আধ্যাত্মিক ধর্মসংগীত হিসেবে একটি পরিচ্ছন্ন কামগন্ধহীন প্রেমের প্রেক্ষাপটে মানবিক প্রেমরসেরও আধার ছিল। বৈষ্ণব ধর্ম যেমন সমাজে ব্যাপকতা লাভ করেছে, তেমনি পদাবলী সাহিত্যও জনপ্রিয়তা পায়। এর অসাম্প্রদায়িক প্রেমবার্তার কারণে হিন্দু-মুসলমান উভয় শ্রেণীর কবিরাই পদাবলী রচনা করেছিলেন। চৈতন্যদেব তার পদাবলী সাহিত্যের মাধ্যমে সব মানুষকে যে খোলা হাওয়ার চলাপথে ডাক দিলেন-তাতে ব্রাহ্মণ-শূদ্র, হিন্দু-মুসলমান, ধনী-দরিদ্র এক সঙ্গে জুটতে সংকোচ বোধ করে নি। চৈতন্যদেব একদিকে অভিজাতদের মধ্যে ম্লেচ্ছাচার রোধ করে, অন্যদিকে জনসাধারণকে সংকীর্তন ও নামধর্মের সাহায্যে প্রেমধর্মে সমান অধিকার দান করেন। এভাবে হিন্দুসমাজের উচ্চ ও নিম্নবর্ণকে এক ধর্মাচরণে ও ভাবাদর্শে পরস্পরের সন্নিকট করে চৈতন্যদেব এক আত্মীয় ভাবাপন্ন হিন্দুসমাজ গড়ে তুলতে সহায়তা করেন। এই সাংস্কৃতিক সামাজিক জাগরণে বাঙালির চেতনা সাহিত্য সংগীতে দর্শনে নানাদিকে অপূর্ব ভাবৈশ্বর্যে মূর্ত হয়ে ওঠে।
চৈতন্যদেবের প্রভাবে এদেশে যে নবজাগরণ দেখা দিয়েছিল তাকে কেউ কেউ ‘চৈতন্য রেনেসাঁ’ বলে অভিহিত করেছেন। বাংলা সাহিত্যে এই নব জাগরণের নিদর্শন বিদ্যমান। চৈতন্যের প্রভাবেই বাংলা সাহিত্য তুচ্ছ মঙ্গলকাব্য ও নাথসাহিত্যের জাল ছিন্ন করে উদারতার পরিমণ্ডলে সম্প্রসারিত হল। চৈতন্যের সাক্ষাৎ প্রভাবে ও অলোকসামান্য আদর্শে পরিকল্পিত চৈতন্যজীবনী গ্রন্থগুলো এ বিষয়ে দীপবর্তিকার মতই সাহায্য করে থাকে। তবে চৈতন্য জীবনচরিতগুলো বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করলেও চৈতন্য প্রভাবের সর্বোৎকৃষ্ট ফসল পদাবলী সাহিত্য। চৈতন্য প্রভাবেই বাংলা ভাষা গোঁড়া ব্রাহ্মণের নিকটও সংস্কৃতের ন্যায় আদরণীয় হয়ে ওঠে। বৈষ্ণব সাহিত্য ও জীবনী সাহিত্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যকে গতানুগতিকতার ধূলিধূসর পথ থেকে প্রেম সৌন্দর্যেও মানবিকতার আলোক তীর্থে নিয়ে গেছে। চৈতন্যদেবের বড় অবদান হচ্ছে-সুফিধর্মের প্রভাবে ভক্তিধৰ্মকে প্রেমধর্মে উন্নীত করা। জৈন বৌদ্ধ ঐতিহ্যের দেশে সুপ্ত সাম্যচেতনা ও মানব মর্যাদাবোধ ইসলামের স্পর্শে চৈতন্যদেবের জীবনে ও বাণীতে নবরূপে পুনর্জাগ্রত হয়েছে। চৈতন্য প্রভাবে বর্ণাশ্রিত হিন্দু সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষ যারা শূদ্রাদি অস্পৃশ্য মানুষকে গৃহপোষ্য পশুর বেশি মর্যাদা দিত না, কুল-গৌরব, আভিজাত্যবোধ, বর্ণবর্গ, বিদ্যাভিমান, সংস্কৃতি চেতনা ও কুলবাচি স্বেচ্ছায় ও সানন্দে পরিহার করে ভক্ত মানুষের ভিড়ে মিশে স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে হল ধন্য— কৃতাৰ্থ।
চৈতন্যদেবের প্রভাবে পদাবলী সাহিত্য ছন্দের বৈচিত্র্যে, অলংকরণের পারিপাট্যে, রূপ নির্মিত, চিত্রকল্প সৃষ্টিতে, উপমা, রূপক, উৎপেক্ষা, রচনায়— একটি মাত্র ভাব অবলম্বনে গড়ে ওঠা শিল্প তাজমহল। তাছাড়া তারই প্রভাবে এতদিনের দেব আরাধনা পরিত্যাগ করে মানুষের জীবন নিয়ে অর্থাৎ চৈতন্যদেবের জীবনভিত্তিক গড়ে ওঠে সাহিত্যের এক নতুন ধারা। ফলে বলা যায়, চৈতন্যদেবের সময়কাল অর্থাৎ ষোল শতক সর্বার্থেই অবিশেষ বাঙালি জীবনে রেনেসাঁর যুগ। বস্তুত বাঙালির মনে-মননে, সমাজে, ধর্মমতে উদার মানবিকবোধজাত প্রীতিসুন্দর বিনয়মধুর বাসন্তী হাওয়ায় স্পর্শ লাগল, যার ফলে সাহিত্যে সংস্কৃতিতে ফলেছিল সোনালি ফসল।
Leave a comment