অথবা, নীতিবিদ্যার আলোকে অধিকার প্রত্যয়টি বিশ্লেষণ কর।
ভূমিকাঃ নীতিবিদ্যার আলোচনায় “অধিকার” এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কম-বেশি সব নীতিবিদ্যাই অধিকার সম্পর্কে তাদের মতবাদ পেশ করেছেন। William Illy তার Introduction to ethics গ্রন্থে বলেন— “নৈতিক ভিত্তির উপর নির্ভর করে কোনো কিছু পাওয়ার কাজ করার যুক্তিসম্মত দাবিকে অধিকার বলা হয় মূলত অধিকার হলো সমাজ বা রাষ্ট্রে অপর কাউকে আঘাত না করে তাকে বাঁচতে দেয়ার অধিকার। তাই বলা যায়, নৈতিক অধিকারের মাধ্যমেই ব্যক্তি মানুষ যেমন তার অপন স্বার্থ রক্ষা করে। তেমনি আবার এ পথেই সে সামাজিক কল্যাণ সাধন করে। নিচে নীতিবিদ্যার অধিকার সম্পর্কে আলোকপাত করা হলোঃ
অধিকারঃ সমাজে’ বসবাস করতে গেলেই অধিকারের বিষয়টা আসে। সমাজ ও মানুষের জন্য অধিকার একান্ত প্রয়োজন। কেননা অধিকার ছাড়া কেউ তার স্বাধীন বিষয় লাভ করতে পারে না। সমাজ থেকে আমরা যেমন অধিকার পাই তেমনি এসব অধিকারের বিনিময়ে আমরা আবার কর্তব্য পালন করি। তাই বলা যায়- অধিকার পেতে হলে কর্তব্য পালন আবশ্যক। তাই আমরা এ কথা বলতে পারি অধিকার ও কর্তব্য পাশাপাশি বাস করে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে বসবাস করতে হলে অধিকার প্রয়োজন। অনেক দার্শনিক অধিকার সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। নিচে তা বর্ণনা করা হলোঃ
Prof. Laski বলেন, “বস্তুত অধিকার হলো সমাজ জীবনের সেসব অবস্থা, যেগুলো ছাড়া কোনো মানুষ সাধারণভাবে তার পরিপূর্ণ বিকাশে সচেষ্ট হতে পারে না।”
T. H. Green বলেন, “সমষ্টিগত নৈতিক কল্যাণ সম্পর্কে চেতনা ছাড়া অধিকারের অস্তিত্ব অসম্ভব।” Gilchrist point out that- “Rights arise the fact that man is social and political being.”
Hob House এর মতে, “প্রকৃত অধিকার বলতে সামাজিক কল্যাণ সাধনের কতগুলো শর্তকে বুঝায় এবং বিভিন্ন অধিকারের বৈধতা সমাজের সর্বাঙ্গীন উন্নতি বিধানের উপর নির্ভরশীল।
Bosanauet বলেন, “অধিকার হলো সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত এবং রাষ্ট্র কর্তৃক প্রযুক্ত দাবি।”
Barker -এর মতে, “অধিকার হলো ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী সুবিধা। যা রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত।
সুতরাং, অধিকার বলতে আমরা বুঝি যে, সুযোগ-সুবিধা প্রত্যেকে ব্যক্তিত্ব বিকাশের সহায়ক হবে এবং রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হবে।
অধিকারের স্বরূপঃ আইনসম্মত ভিত্তির উপর নির্ভর করে কোনো কিছু পাওয়ার যুক্তিসম্মত দাবিকে অধিকার বলে। আমরা আরো বলতে পারি অধিকার হলো- যা একটা সমাজ বা রাষ্ট্র অপর কাউকে আঘাত না করে তাকে বাঁচতে দেয়া। তাই বলা যায়— নৈতিক অধিকারের মাধ্যমেই ব্যক্তি, মানুষ যেমন তার আপন স্বার্থ রক্ষা করে। তেমনি আবার এ পথেই সে সামাজিক কল্যাণ সাধন করে।
মানুষের অধিকারঃ নৈতিকতা বিকাশের ক্ষেত্রে অধিকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নৈতিকতা নিজের যেমন কল্যাণ করে তেমনি সমাজেরও কল্যাণ সাধন করে। সমাজে বসবাসের জন্য মানুষের কতগুলো মৌলিক অধিকার আছে। যেমন— বাঁচার অধিকার, কাজ করার অধিকার, স্বাধীনতার, সম্পত্তির অধিকার, শিক্ষার অধিকার, চুক্তির অধিকার ইত্যাদি। নিচে এ অধিকার সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ
১. বাঁচার অধিকারঃ মানুষের অধিকারের মধ্যে বাঁচার অধিকার গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক। সমাজে বসবাস করতে হলে মানুষকে প্রথমে বাঁচার অধিকার দিতে হয়। মানুষ যদি তার বাঁচার অধিকার না পায় তবে সুস্থ জীবন-যাপন সম্ভব নয়। ফলে ব্যক্তি যেমন নিজের কল্যাণ করতে পারে না, তেমনি সে সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধন করতে পারে না। কল্যাণের জন্য যা দরকার তা হলো- মানুষের বাঁচার অধিকার দেয়া। বাঁচার অধিকার না থাকলে সমাজের কল্যাণ সাধন সম্ভব নয়। কোনো ব্যক্তি যদি তার নিজের বাঁচার অধিকার ভোগ করে তবে সে অপরের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে। সমাজের এক ব্যক্তির যেমন— বাঁচার অধিকার আছে, তেমনি অপর ব্যক্তিরও বাঁচার অধিকার আছে।
২. কাজ করার অধিকারঃ কাজ করার অধিকার ও বাঁচার অধিকার অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বাঁচার অধিকারের মধ্যেই কাজ করার অধিকার আছে। মানুষকে বাঁচতে হলে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান দরকার। আবার এগুলোর জন্য কাজ করার দরকার। তাই বলা যায়— মানুষকে জীবন-যাপন করতে হলে বাঁচার অধিকার দিতে হবে।
৩. স্বাধীনতার অধিকারঃ মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা নৈতিকতার ক্ষেত্রে অপরিহার্য শর্ত। ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মাধ্যমেই মানুষ তার কল্যাণ অর্জন করতে পারে। নৈতিকতার জন্য ব্যক্তি-স্বাধীনতার একান্ত প্রয়োজন। ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রকৃত অর্থেই নিজের স্বাধীনতা ও স্বকীয়তাকে রক্ষা করার জন্য অপরের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করে তার স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধারভাব পোষণ করা ৷
স্বাধীনতার অধিকারের সাথে সাথে আমাদের মনে এমন এক নৈতিক বাধ্যতাবোধ জেগে উঠে, যার ফলে নিজের স্বাধীনতার সাথে সাথে অপরের স্বাধীনতাকেও আমরা রক্ষা করার চেষ্টা করি।
৪. সম্পত্তির অধিকারঃ বাঁচার অধিকার, কাজ করার অধিকার স্বাধীনতার অধিকার থেকে সম্পত্তির অধিকার পাওয়া যায়। নৈতিকতার জন্য যেমন— স্বাধীনতার অধিকার দরকার তেমনি সম্পত্তিরও অধিকার দরকার। মানুষ তার শ্রমের মাধ্যমে যে সম্পদ অর্জন করে তাকে ভোগ করার জন্য অধিকার দিতে হয়। এটাকে সম্পত্তির অধিকার বলে । সম্পদ নিজের মঙ্গলের পাশাপাশি অপরেরও মঙ্গল করে।
৫. শিক্ষার অধিকারঃ মানবিক যে অধিকার আছে তার মধ্যে শিক্ষার অধিকার বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মানুষকে মানুষের মতো বাঁচার জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষার অধিকার মানুষকে আলোকিত করে তোলে। ফলে সমাজ রাষ্ট্র আলোকিত হয়। মানুষ শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে সমাজ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। শিক্ষিত মানুষ যেমন নিজের কল্যাণ করতে পারে, তেমনি অপরেরও কল্যাণ করে। মানুষ সুশিক্ষিত হওয়ার পরই কেবল সদগুণাবলি অর্জন করতে পারে। ফলে সে নিজের ও অপরের মঙ্গল সাধন করতে পারে। তাই সক্রেটিস বলেন- জ্ঞানই সদগুণ। তাই বলা যায়- নিজের আত্মোপলব্ধি ও সমাজের কল্যাণের জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নাই। কেননা “Education is the backbone of a nation.”
৬. চুক্তির অধিকারঃ মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে সুস্থভাবে জীবন-যাপনের জন্য চুক্তির অধিকার থাকা জরুরি। নৈতিকতা আমাদের বাঁচার অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার সম্পত্তির অধিকার, শিক্ষার অধিকারের উপর নির্ভর করে। এই সব অধিকারের জন্য আমাদের অপরের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হতে হয়। কোনো কাজ সঠিকভাবে করার জন্য চুক্তি খুবই আবশ্যক। নৈতিক চুক্তির মাধ্যমে অনৈতিক অধিকার দূর হয়। আদিম সমাজে কোনো অধিকার ছিল না। মানুষ অন্যান্য অধিকারের সাথে সাথে চুক্তির অধিকারও স্বীকৃত হয়, যাতে মানুষ চুক্তির অধিকারকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, অধিকার সমাজ জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অধিকার ছাড়া কোনো মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারে না। বাঁচার অধিকার মানুষকে বাঁচতে শেখায়। কাজ করার অধিকার মানুষকে কাজের স্বাধীনতা দেয়। স্বাধীনতার অধিকার মানুষকে স্বাধীনভাবে চলতে শেখায়। সম্পত্তির অধিকার একমাত্র রাষ্ট্রের। শিক্ষার অধিকার মানুষকে আলোকিত করে তোলে। আর আমরা যাবতীয় অধিকার চুক্তির মাধ্যমেই সম্পাদন করি। তাই চুক্তির অধিকারেরও বেশ গুরুত্ব আছে। তাই বলা যায়— অধিকার সম্পর্কে যে আলোচনা করা হয়েছে তা সুন্দরভাবে আমরা বুঝতে পারি। তাই নীতিবিদ্যার আলোচনায় মানুষের অধিকারের গুরুত্ব অপরিসীম।
Leave a comment