প্রশ্নঃ মামলা প্রমাণের এবং সাক্ষ্য উপস্থাপনের দায়িত্বের মধ্যে পার্থক্য দেখাও। মামলা প্রমাণের দায়িত্ব কার উপর বর্তায়? কখন অভিযুক্ত ব্যক্তির উপর প্রমাণের দায়িত্ব অর্পিত হয়? বৈধ সন্তানের চূড়ান্ত প্রমাণ কি?
[Distinguish between the burden of establishing a case and the burden of introducing evidence. On whom does the burden of proof lie? When does the burden of proof lie on the accused? What is the conclusive proof of Legitimacy?]
উত্তরঃ মামলা প্রমাণের দায়িত্ব এবং সাক্ষ্য উপস্থাপনের দায়িত্বের মধ্যে পার্থক্যঃ মামলার পক্ষগণ আদালতে যে বক্তব্য পেশ করেন তার সাক্ষ্য প্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। শুধু মুখের কথার উপর বিশ্বাস করে আদালত কোন প্রতিকার দিতে পারে না । বাদীর বক্তব্য যে সঠিক তা সাধারণত: বাদীকেই প্রমাণ করতে হয়। কতিপয় ক্ষেত্রে অবশ্য বাদীর উপর প্রমাণের দায়িত্ব থাকে না, বাদীর বক্তব্য খণ্ডন করার দায়িত্ব থাকে বিবাদী বা অভিযুক্ত ব্যক্তির উপর। সে যদি তা খণ্ডিত করতে ব্যর্থ হয় তবে প্রকারান্তরে বাদীর বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
কিন্তু সাক্ষ্য উপস্থাপন বিষয়টি বেশ ব্যাপক। একটি মামলার বিষয় প্রমাণ ছাড়াও এর পরিধির মধ্যে রয়েছে অনুমান বা প্রত্যয়, প্রতিবন্ধকতা, সাক্ষীর জবানবন্দী, জেরা ইত্যাদি সম্পর্কিত বিধিমালা ও আদালতে প্রকাশ করা হতে অব্যাহতি সম্পর্কিত বিধি।
কাজেই দেখা যায় যে, সাক্ষ্য উপস্থাপনের মধ্যে মামলা প্রমাণের দায়িত্ব অন্তর্ভুক্ত থাকলেও মামলা প্রমাণের দায়িত্বের মধ্যে সাক্ষ্য উপস্থাপন অন্তর্ভুক্ত নয়। অর্থাৎ মামলা প্রমাণের বিষয়টি সাক্ষ্য উপস্থাপনের একটি শাখাবিশেষ।
মামলা প্রমাণের দায়িত্বঃ সাক্ষ্য আইনের ১০১ হতে ১১৪ ধারায় প্রমাণের ভার সম্পর্কে যে বিধান রয়েছে তা নিম্নরূপ-
১। ১০১ ধারায় বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি যদি কোন ঘটনার অস্তিত্বের দাবি করে তার উপর ভিত্তিশীল কোন আইনগত অধিকার বা দায় সম্পর্কে আদালতের রায় কামনা করে তার সে ঘটনার অস্তিত্ব তাকেই প্রমাণ করতে হবে।
উদাহরণ: ক একটি অপরাধ করেছে বলে খ দাবি করে এবং সে মোতাবেক ক এর শাস্তি কামনা করে। এক্ষেত্রে ক যে অপরাধ করেছে তা খ কেই প্রমাণ করতে হবে। খ দাবি করতে পারে না যে ক প্রমাণ করুক যে, সে অপরাধ করেনি।
২। ১০২ ধারার বিধান মতে কোন দেওয়ানী মামলায় বা কার্যক্রম কোন পক্ষ হতে সাক্ষ্য প্রমাণ দাখিল না করলে যে পক্ষ পরাজিত হবে মামলার বিষয়বস্তু প্রমাণ করার দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত।
উদাহরণ: একটি খত মূলে পাওনা টাকা দাবি করে খ এর বিরুদ্ধে ক মামলা দায়ের করে। খ বলে যে, প্রতারণামূলকভাবে এ খত সম্পাদন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোন পক্ষ সাক্ষ্য উপস্থাপন না করলে ক জয়লাভ করবে, কেননা খতের বিষয় স্বীকৃত অথচ প্রতারণার সাক্ষ্য নেই।
৩। যে পক্ষ কোন ঘটনার অস্তিত্ব আদালতকে বিশ্বাস – করাতে চায়, সে ঘটনার অসিত্ব প্রমাণ করার দায়িত্ব সে পক্ষের উপর।
উদাহরণ: ক চুরির দায়ে খ কে ফৌজদারীতে সোপর্দ করে। খ আদালতকে বলে যে, খ তার চুরির কথা গ এর নিকট স্বীকার করেছে। গ এর স্বীকৃতির বিষয় ক কে প্ৰমাণ করতে হবে। খ যদি আদালতকে বিশ্বাস করাতে চায় যে, ঐ ঘটনার সময় সে দূরে অন্য এক স্থানে ছিল তবে ঐ ঘটনার প্রমাণ তাকে করতে হবে।
৪। কোন ব্যক্তি কোন ঘটনার সাক্ষ্য দিতে চাইলে সে . ঘটনা যদি অন্য একটি ঘটনার উপর নির্ভরশীল হয় তবে ঘটনাটি প্রমাণের ভারও সেই ব্যক্তির উপর বর্তাবে।
উদাহরণ: রহিম একটি মামলায় করিমের মৃত্যুকালীন ঘোষণা প্রমাণ করতে চায়। এমতাবস্থায় করিমের যে মৃত্যু হয়েছে সেটাও রহিমকে প্রমাণ করতে হবে।
৫। ১০৫ ধারা অনুযায়ী কোন ব্যক্তি কোন বিশেষ অপরাধে অভিযুক্ত হলে বাংলাদেশ দণ্ডবিধিতে বর্ণিত সাধারণ ব্যতিক্রমসমূহের আওতায় বা অন্য কোন শর্তের আওতায় পড়ে বলে সে ব্যক্তি দাবী করলে সে বক্তব্য সমর্থনের প্রমাণ তাকে করতে হবে।
উদাহরণ: হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ক দাবি করে যে, মানসিক অসুস্থতার দরুন সে তার কৃতকর্মের প্রকৃতি সম্পর্কে বুঝতে অক্ষম ছিল। এটা প্রমাণের দায়িত্ব ক এর উপর ন্যস্ত।
৬। ১০৬ ধারা মোতাবেক কোন ঘটনা যখন বিশেষ কোন ব্যক্তির অবগতির মধ্যে থাকে তখন সে ঘটনা প্রমাণ করার দায়িত্ব ক ব্যক্তির উপরই ন্যস্ত থাকে।
উদাহরণ: বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণের দায়ে ক অভিযুক্ত হলেন। এক্ষেত্রে ক এর কাছে যে টিকিট ছিল তা প্রমাণের দায়িত্ব ক এর উপর ন্যস্ত।
৭। যখন কোন ব্যক্তি জীবিত না মৃত এমন প্রশ্ন উঠলে এবং এমন প্রতীয়মান হলে যে বিগত ৩০ বছরের মধ্যে সে ব্যক্তি জীবিত ছিলেন, তখন যে ব্যক্তি তাকে মৃত বলে দাবি মেণ, উক্ত ব্যক্তি যে মৃত তা প্রমাণের দায়িত্ব ১০৭ ধারার মতে সে ব্যক্তির উপর ন্যস্ত।
৮। যখন প্রশ্ন উঠে যে, কোন ব্যক্তি জীবিত না মৃত এবং প্রমাণিত হয় যে, সেই ব্যক্তি জীবিত থাকলে স্বাভাবিকভাবে যারা তার সংবাদ পেতো তারা বিগত ৭ বছর যাবৎ তার কোন সংবাদ পায় নি তখন উক্ত ব্যক্তি জীবিত বলে যে দাবী করবে ১০৮ ধারা মোতাবেক তাকেই তা প্রমাণ করতে হবে।
৯। যখন প্রশ্ন উঠে যে, পক্ষগণ পরস্পর অংশীদার কি-না কিংবা জমিদার ও প্রজা কি-না অথবা মালিক ও এজেন্ট কি না এবং প্রতীয়মান হয় যে, তারা অনুরূপভাবে কাজ করে আসছে, তখন যে ব্যক্তি দাবি করে যে, উপরি-উক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অনুরূপ সম্পর্ক নেই অথবা সেই সম্পর্কের অবসান হয়েছে, তাহলে তা প্রমাণ করার দায়িত্ব ১০৯ ধারা অনুসারে সেই ব্যক্তির উপরই ন্যস্ত হয়।
১০। যখন প্রশ্ন উঠে, যে ব্যক্তির দখলে কোন সম্পত্তি আছে সে ব্যক্তি এর মালিক কি-না, তখন যে ব্যক্তি দাবি করে যে, দখলকারী ব্যক্তি সেই সম্পত্তির মালিক নয়, তাহলে ১১০ ধারা মতে তাকেই তা প্রমাণ করতে হবে।
১১। পক্ষগণের মধ্যে লেনদেনের ব্যাপারে সরল বিশ্বাসের প্রশ্ন উঠলে একপক্ষ যদি অপর পক্ষের সক্রিয় বিশ্বাসের পাত্র হয়, তবে যে পক্ষ সক্রিয় বিশ্বাসের পাত্র তার উপরই ১১১ ধারা মতে বিশ্বাস প্রমাণের দায়িত্ব বর্তাবে।
১২। পিতামাতার বৈধ বিবাহিতা সময়কালে বা বিচ্ছেদের ২৮০ দিনের মধ্যে মাতার আবার বিয়ে না হয়ে থাকলে সেমতাবস্থায় কোন সন্তানের জন্ম হলে সে যে তাদের বৈধ সন্তান এ বিষয়ে তা চূড়ান্ত প্রমাণ। কেউ যদি উক্ত সন্তানের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তবে ১১২ ধারা মতে তাকেই প্রমাণ করতে হবে যে, সংশ্লিষ্ট সন্তানের সম্ভাব্য জন্মকালের কোন সময়ে তার মাতার সহিত উক্ত পিতার মিলনের সুযোগ ছিল না।
১৩। কোন ভূখণ্ডের স্বত্ব সমর্পণের প্রমাণ সম্পর্কে ১১৩ ধারাটি বর্তমানে বিলুপ্ত রয়েছে।
১৪। স্বাভাবিক ঘটনাবলীর সাধারণ গতিধারা, মানবিক আচরণ এবং সরকারী ও বেসরকারী কার্যাবলীর স্বাভাবিক নিয়মাবলী বিবেচনা করে আদালত যদি মনে করেন যে বিষয়টি ঘটে থাকতে পারে। তবে ১৪৪ ধারা বিধান অনুসারে আদালত এর অস্তিত্ব ধরে নিতে পারেন। যেমন, চুরির অব্যবহিত পরেই চোরাই মাল যে ব্যক্তির দখলে থাকে সে যদি তার দখলের উপযুক্ত কারণ দর্শাতে না পারে, তবে ঐ ব্যক্তি চুরি করেছে অথবা চোরাই মাল জানা সত্ত্বেও তা গ্রহণ করেছে এরূপ ধরে নেয়া যায়৷
বস্তুতঃ এগুলিই হচ্ছে প্রমাণের ভার সংক্রান্ত সাক্ষ্য আইনের বিধি-বিধান।
অভিযুক্ত ব্যক্তির উপর প্রমাণের দায়িত্বঃ উপরি-উক্ত আলোচনা হতে দেখা যায় যে, নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রভাব প্রমাণের দায়িত্ব থাকে-
(ক) অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি কোন ঘটনার অস্তিত্ব আদালতকে বিশ্বাস করাতে চায়, তাহলে সে ঘটনার অস্তিত্ব প্রমাণ করার দায়িত্ব তার উপর। (ধারা ১০৩)
(খ) সাধারণ ব্যতিক্রম বা অন্য কোন শর্তের আওতায় অব্যাহতি দাবী করলে ১০৫ ধারা অনুযায়ী এ বক্তব্যের সমর্থন তাকে প্রমাণ করতে হবে।
(গ) কোন বিশেষ ঘটনা অভিযুক্ত ব্যক্তির অবগতির মধ্যে থাকলে যে ঘটনা প্রমাণের ভার ১০৬ ধারা মোতাবেক তার উপর ন্যস্ত থাকে।
বৈধ সন্তানের চূড়ান্ত প্ৰমাণঃ কিছু কিছু বিষয় রয়েছে যা প্রমাণ ব্যতিরেকেই সত্য বলে ধরে নেয়া যায়। এগুলিতে অনুমান বা প্রত্যয় বলে। এগুলি কতকগুলি খন্ডনীয় আর কতকগুলি অখন্ডনীয়। অখন্ডনীয় অনুমানগুলিকে চূড়ান্ত প্রমাণ বলা হয়৷ সাক্ষ্য আইনের ৪১, ১১২ ও ১১৩ ধারায় এরূপ চুড়ান্ত প্রমাণের বিধান রয়েছে। ১১২ ধারাটি বৈধ সন্তানের চূড়ান্ত প্রমাণ সম্পর্কিত। এখানে বলা হয়েছে স্বামী স্ত্রীর বৈধ বিবাহিত জীবনকালে কিংবা তাদের মধ্যে বিচ্ছেদের ২৮০ দিনের মধ্যে স্ত্রীর আবার বিয়ে না হয়ে থাকলে সে সময়কালে জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেক সন্তান ঐ দম্পতির বৈধ সন্তান। এটাই চূড়ান্ত প্রমাণ যদিও তাদের মধ্যে যৌন মিলনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কোন মিলন হয়নি বলে দাবী করা হয়। তবে সম্ভাব্য জন্মকালের কোন সময়ে তাদের মধ্যে কোনরূপ মিলনের সুযোগ ছিলনা বলে দাবী করলে তাকেই তা প্রমাণ করতে হবে; অন্যথায় তা বৈধ হিসেবে গণ্য হবে।
Leave a comment