প্রশ্নঃ চণ্ডীদাসের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
উত্তরঃ বৈষ্ণব পদাবলী বাঙালির প্রাণ-মনের সাহিত্য। পদাবলীর কবিদের মধ্যে চণ্ডীদাস আমাদের আত্মার আত্মীয়। তার পদের রসেশ্বর্য ও মাধুর্য তাকে জনপ্রিয় করেছে—
(i) সই কে বা শুনাইলো শ্যাম নাম
(ii) এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা
(iii) শ্যামের পিরীতি চন্দনের রীতি
ঘষিতে সৌরভময়।
(iv) ঘরের বাহিরে দণ্ড শতবার—
চণ্ডীদাসের এসব পদ মধ্যযুগের সীমানা ডিঙ্গিয়ে আজও আমাদের হৃদতন্ত্রীতে অনুরণন তুলে। জীবনে পিরীতির জ্বালায় জ্বলে পুড়ে চণ্ডীদাস রাধার কণ্ঠে কণ্ঠ রেখে বলেছিলেন- “সই আমার মরণ ভাল।
পদাবলীতে যেসব পদের অপরূপ সৌন্দর্য ও গাম্ভীর্য আমাদের মনে সিল গালা হয়ে আছে তার অধিকাংশ পদই চণ্ডীদাসের। চণ্ডীদাস চৈতন্য পূর্ববর্তী শ্রেষ্ঠ কবি। পূর্বরাগের শ্রেষ্ঠ পদকার। চণ্ডীদাস দুঃখের কবি। তিনি সহ্য করবার কবি। তিনি প্রেমকে জগৎ বলে জেনেছেন। তিনি সুখের মধ্যে দুঃখ ও দুঃখের মধ্যে সুখ পেতে চেয়েছেন। সুখে তার ভয় এবং দুঃখে তার অনুরাগ। চণ্ডীদাসের পদে যেমন নতুনত্ব আছে, তেমনি আছে ভাবের মহত্ত্ব ও আবেগের গভীরতা। তার প্রেম দুঃখের পথেই সুখের সন্ধান করে। তার ভাষা সহজ- সরল, ইঙ্গিতধর্মী ও ব্যঞ্জনাধর্মী ৷ অলঙ্কার পরিয়ে তিনি ভাবকে জটিল করেন নি। চণ্ডীদাসের গান সায়াহ্ন সমীরণের দীর্ঘ নিঃশ্বাস। তার সুর বেদনার। নিছক দেহকেন্দ্রিক মিলন তার পদে নেই। রাধাকৃষ্ণের মিলনে তার দেহহীন চামেলির লাবণ্য বিলাস ও অনুতপ্ত ইঙ্গিতই ফুটে উঠেছে অধিক। আনন্দের চেয়ে স্বপ্নভঙ্গের ব্যথাটাই বড়। চণ্ডীদাস অধ্যাত্মরসের কবি। ভাব সম্মিলনের পদে-
(i) বহুদিন পরে বধূয়া এলে।
দেখা না হইত পরাণ গেলে।
(ii) বধূ কি আর বলিব আমি
মরণে জীবনে জনমে জনমে
প্ৰাণনাথ হৈও তুমি।
(iii) শ্যাম অনুরাগে এ তনু বেচিনু
তিল তুলসী দিয়া।
চণ্ডীদাস গভীর এবং ব্যাকুল। চণ্ডীদাস ব্যঞ্জনাধর্মী। তার পদ নিরাভরণ বৈরাগ্যের গৈরিক শ্রী। শব্দঝংকারে নিঃস্ব, তার ভাণ্ডারে ছিল মেঠো ফুল। তিনি রাধার কণ্ঠে আধখানা কথা দিয়ে পাঠকের অন্তরে তার সহস্র প্রতিধ্বনি জাগিয়ে তুলেছেন।
আমার পরাণ যেমতি করিছে
সেমতি হউক সে।
চণ্ডীদাস শুধু সাধক নন, ভক্ত নন, কবিও। তবে তার পদ কৃচ্ছ্রসাধনা ও অনশনে প্রায়ই নীরক্ত দুর্বলতায় আচ্ছন্ন।
চণ্ডীদাসের কবি প্রতিভা একটি পরম বিস্ময়কে বাংলা সাহিত্যে সম্ভব করেছে এবং সে বস্তু চণ্ডীদাসেরই সাধ্য।
Leave a comment