সিভিল ড্রাফটিংঃ সিভিল মামলা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় দলিলপত্র প্রস্তুত করাকে সিভিল ড্রাফটিং বলা হয়। যেসব মামলায় মানুষের সিভিল রাইটের প্রশ্ন উত্থাপিত হয় এবং যা ফৌজদারী মামলার অন্তর্ভুক্ত নয় তা হচ্ছে সিভিল মামলা। কোন বিষয়গুলি সিভিল প্রকৃতির তা বলা হয়েছে দেওয়ানী কার্যবিধির ৯ ধারায়। দেওয়ানী কার্যবিধি অনুসরণ করে সিভিল কোর্টে এ ধরনের মামলা নিষ্পত্তি হয়। আরজি, জবাব, আদালতের বিভিন্ন দরখাস্ত পেশ করা যেমন অগ্রক্রয়ের আবেদন, নিষেধাজ্ঞার আবেদন, আপীল, রিভিউ, রিভিশন-এর জন্য প্রার্থনা ইত্যাদি হচ্ছে সিভিল মামলা সংক্রান্ত দলিল পত্র। এ সকল দলিলপত্র লেখার কলাকৌশলকে সিভিল ড্রাফটিং বলে।
সিভিল ড্রাফটিং করার পূর্বপ্রস্তুতিঃ একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি অন্যের অন্যায়-আচরণ, কিংবা কোন সংগঠন বা কর্তৃপক্ষের বা সরকারের আচরণে ক্ষতির শিকার হলে আইনগত প্রতিকারের জন্য তাকে আদালতের শরণাপন্ন হতে হয় এবং এজন্য এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে একজন আইনজীবীর দ্বারস্থ হয়। একজন আইনজীবী হিসেবে তাকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি করতে হয়ঃ
(১) ক্লায়েন্ট ইন্টারভিউঃ একজন মক্কেল আগমনের সময় তাকে মোটামুটিভাবে স্বাগত জানাতে হবে অর্থাৎ খুব আধিক্য নয় কিংবা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য নয় এমনভাবে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে হবে। মক্কেলের আসার কারণ এবং তার কাছ থেকে কিরূপ সহায়তা বা সেবা প্রত্যাশা করে তা জানতে হবে।
অতঃপর তার ঘটনার বিবরণ মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে এবং তার বক্তব্যের সমর্থনে কোন লিখিত প্ৰমাণ আছে কিনা জেনে নিতে হবে। থাকলে একনজর দেখে নিতে হবে। সাক্ষী থাকলে সেটা জেনে নিতে হবে।
মক্কেল কিভাবে সংক্ষুব্ধ হচ্ছে অর্থাৎ কোন আইনগত অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে তা জেনে নিতে হবে। সিভিল মামলায় টর্টয়ের নীতি ‘Injuria Sine Damno’ প্রতিকারযোগ্য কিন্তু ‘Damnum Sine Injuria’ প্রতিকারযোগ্য নয়, সেটা মক্কেলকে বুঝিয়ে দিতে হবে।
(২) ঘটনার বিন্যাস (Marshalling of facts): ঘটনার বিবরণ বিশ্লেষণ করে সেগুলির বিন্যাস করতে হবে এবং কোন আইনে কথিত অধিকার স্বীকৃত তা যাচাই করতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট আইনের বই দেখাশুনা করতে হবে।
(৩) আদালত নির্বাচন (Choice of forum): কোন আদালতে প্রতিকার পাওয়া যাবে তা যাচাই করে নিতে হবে। যেমন জমির স্বত্বের জন্য সিভিল কোর্টে, কোম্পানীর বিষয়, বিট ইত্যাদির জন্য হাইকোর্ট বিভাগে পারিবারিক বিষয় হলে পারিবারিক আদালতে, চাকুরী সংক্রান্ত বিষয় হলে এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনালে, শ্রমিক সংক্রান্ত বিষয় হলে শ্রম আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে।
(৪) নালিশের কারণ: নালিশের কারণ উদ্ভব হয়েছে কখন তা জেনে নিতে হবে, কেননা তখন থেকে তামাদি আইনের প্রয়োগ হবে।
(৫) অপরিহার্য পুস্তকসমূহ : আরজি প্রস্তুত করার পূর্বে নিম্নোক্ত বইগুলি ভালো করে পড়ে নিতে হবে –
তামাদি আইন, ১৯০৮, ০ স্যুট ভ্যালুয়েশন এ্যাক্ট, ১৮৮৭, ০ কোর্ট ফিস এ্যাক্ট, ১৮৭০, ০ সিভিল রুল্স এন্ড অর্ডারস (সি আর ও), ০ সিভিল কোর্ট এ্যাক্ট ১৮৮৭ যা ২০০১ সালে সংশোধিত হয়েছে। ০ সংশ্লিষ্ট আইন যেমন চুক্তি আইন, টর্ট আইন, সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন, সম্পত্তি হস্তান্তর আইন ইত্যাদি।
এছাড়াও সিপিসির ১৫- ২০ ও ২৬ ধারা ও ১, ২, ৩, ৬ ও ৭ অর্ডারগুলি ভালোভাবে রপ্ত করে নিতে হবে।
আরজি প্রস্তুতকরণ : একটি আরজি লেখার সময় এর নিম্নোক্ত ৮টি অংশের কথা স্মরণ রাখতে হবে-
(১) মামলার শিরোনাম (Cause Title); (২) নালিশের কারণ উদ্ভবের বিবরণ; (৩) কোন তারিখে নালিশের কারণ উদ্ভূত হয়েছে তার বর্ণনা; (৪) আদালতের এখতিয়ার সম্পর্কে বক্তব্য; (৫) প্রার্থিত প্রতিকার; (৬) মূল্যমান; (৭) স্থাবর সম্পদের ক্ষেত্রে তার তফসিল; (৮) সত্যপাঠ (Verification)।
লিখিত জবাব : আরজিতে যে বক্তব্য প্রদান করেছে তার লিখিত জবাব দেয়ার জন্য নিম্নোক্ত প্রস্তুতি গ্রহণের প্রয়োজন-
(১) ক্লায়েন্ট ইন্টারভিউ-এর মাধ্যমে তার বক্তব্য শুনতে হবে; (২) তার বক্তব্যের সমর্থনে সাক্ষ্য প্রমাণ কি আছে তা জেনে নিতে হবে; (৩) ঘটনার বিন্যাস করতে হবে; (৪) ঘটনার প্রেক্ষিতে আইনের প্রয়োগযোগ্যতা পরীক্ষা করার জন্য বর্ণিত অপরিহার্য পুস্তকসমূহ ভালভাবে রপ্ত করতে হবে। (৫) আইনের দৃষ্টিতে বাদী কর্তৃক দায়েরকৃত মামলা চলতে পারে না তা প্রথম জবাবেই আপত্তি জানােেত হবে; (৬) বাদী কর্তৃক উত্থাপিত বিষয়গুলির মধ্যে যেগুলি বিবাদী স্বীকার করে না তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। (৭) টাকা উদ্ধারের মামলায় বিবাদীদের সেট অফ বা প্রতিদাবীর বিষয় উত্থাপন করতে হবে যদি সে এ বিষয়ে দাবী করে; (৮) প্যারা অনুয়ায়ী অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করতে হবে।
আরজি পেশ : আরজির সাথে নিম্নোক্তগুলি জমা দিতে হবে-
(ক) বিবাদীর সংখ্যানুযায়ী আরজির কপি ও মূল কপি; (খ) সমর্থন করার মতো সংযুক্ত দলিলের তালিকা যা ফিরিস্তি ফরমে দিতে হবে; (গ) প্রসেস ফি; (ঘ) প্রতি বিবাদীর জন্য ৩ কপি সমন (১ কপি পিয়াদা কর্তৃক, ১ কপি ডাক মারফত জারী করতে হবে); (ঙ) এ, ডি. বা স্বীকৃতিপত্রসহ রেজিস্টার্ড পত্রের ডাক স্ট্যাম্প; (চ) ওকালতনামা।
লিখিত জবাব পেশ : লিখিত জবাবের সাথে নিম্নোক্তগুলি জমা দিতে হবে-
(ক) লিখিত জবাব; (খ) ফিরিস্তি ফরমে সংযুক্ত দলিলপত্রের বিবরণ; (খ) ওকালতনামা।
আরজি জমা হলে আদালত দেখবেন যে, এটা দেওয়ানী কার্যবিধির বিধান অনুসারে লিখিত হয়েছে কিনা; যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা ও কোর্ট ফি দেয়া হয়েছে কিনা এবং এতে সেই আদালতের এখতিয়ার আছে কিনা; নালিশের কারণ বহাল আছে না তামাদি হয়ে গিয়েছে এবং আপাতদৃষ্টিতে সাক্ষ্য আইন দ্বারা সবগুলি প্রমাণযোগ্য কিনা। তদন্তের পর আদালত সুন্তুষ্ট হলে আরজিটি নিবন্ধন করবেন এবং একটা নম্বর দিবেন, যা মামলার নম্বর হিসেবে পরিচিত হবে। তখন বলা যাবে যে, মামলাটি চালু হয়েছে।
Leave a comment