প্রশ্নঃ ট্রেডমার্ক বলতে কী বুঝ? ট্রেডমার্ক আইনের বিবর্তন আলোচনা কর।
What do you mean by Trademark? Discuss the evolution of Trademark Law.
ট্রেডমার্কঃ ট্রেডমার্ক হচ্ছে উৎপাদনকারী কর্তৃক তার উৎপাদিত পণ্য বা বিক্রয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক তাদের বিক্রিতব্য পণ্যের ওপর দেওয়া একটা চিহ্ন যা দেখে ভোক্তাসাধারণ সংশ্লিষ্ট উৎপাদনকারী বা বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক সুনাম বা বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে তাদের ইতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হলে সেই চিহ্ন দেখে পণ্যের অর্ডার দেওয়া বা ক্রয় করে। উৎপাদনকারী বা বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের খোঁজখবর নেওয়ার পরিবর্তে সেই চিহ্নের সাথে পরিচিত হওয়াটাই বেশি প্রচলিত ও বেশি সুবিধাজনক। একই জাতীয় পণ্যের উৎপাদনকারী বা বিক্রেতা অনেক ট্রেডমার্ক স্বতন্ত্র হওয়ায় এ ট্রেডমার্ক দেখেই ক্রেতা সাধারণ তাদের কাঙ্ক্ষিত পণ্য সংগ্রহ করে থাকে। ফলে ট্রেডমার্কের সাথে উৎপাদনকারী বা বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং ট্রেডমার্কের সুনাম প্রতিষ্ঠিত হলে সংশ্লিষ্ট উৎপাদনকারী বা বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক সাফল্য নিয়ে আসে। কাজেই ট্রেডমার্কে একটা স্বার্থ বা অধিকার অর্জিত হয় যা আইন দ্বারা রক্ষা করা প্রয়োজন। প্রাচীনকাল থেকেই সকল দেশে ট্রেডমার্কের ব্যবহার হয়ে আসছে এবং কমল ল’ দ্বারা সেগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। পরবর্তীকালে বিধিবদ্ধ আইন প্রণয়ন করে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অনিবন্ধিত ট্রেডমার্ক কমন ল’ দ্বারা এবং নিবন্ধিত ট্রেডমার্ক বিধিবদ্ধ আইন দ্বারা এগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ২০০৯ সালের ট্রেডমার্ক আইন বলবৎ আছে এবং এর পূর্বে ১৯৪০ সালের ট্রেডমার্ক আইন প্রচলিত ছিল।
কমন ল’ অনুসারে ট্রেডমার্ক হচ্ছে একটি শব্দ, কৌশল বা লেবেলের আকাশে দৃশ্যমান কোন প্রতীক যা ব্যবসায়িক পণ্যের ওপর লাগানো হয় এ উদ্দেশ্যে যে, ক্রয়েচ্ছু জনগণকে বুঝানো যে ঐ পণ্য চিহ্ন প্রদানকারী বিশেষ ব্যক্তি কর্তৃক উৎপাদিত বা বিক্রীত যা অনুরূপ পণ্য অন্যান্য উৎপাদনকারী যা বিক্রেতা হতে স্বতন্ত্র। [A trade mark is a visual symbol in the from of a word, a device or a label applied to articles of commerce with a view to indicate to the purchasing public that they are the goods manufactured or otherwise dealt is by a particular or person as distinguished from similar goods manufactured or dealt in by other persons]
বাংলাদেশের ‘ট্রেডমার্ক’ আইন ২০০৯ এর ২ (২৩) ধারায় বলা হয়েছে যে, মার্ক হচ্ছে কোন ডিভাইস, ব্রান্ড, শিরোনাম, লেবেল, টিকেট, নাম, স্বাক্ষর, শব্দ, অক্ষর, প্রতীক, সংখ্যা, রং বা এগুলোর যেকোনো সমন্বয়, ২ (৮) ধারায় বলা হয়েছে যে, ‘ট্রেডমার্ক অর্থ কোন নিবন্ধিত ট্রেডমার্ক অথবা কোন পণ্যের সহিত ব্যবহৃত এমন কোন মার্ক যাতে ব্যবসায়িক উক্ত পণ্যের ওপর মার্ক ব্যবহারকারী স্বত্বাধিকারীর অধিকার রয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়; কোন সেবার সহিত ব্যবহৃত এমন কোন মার্ক যাতে ব্যবসায়িক উক্ত সেবার ওপর মার্ক ব্যবহারকারীর স্বত্বাধিকারীর অধিকার রয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়। সেবার সহিত ব্যবহৃত মার্ককে সার্ভিস মার্ক বলে। যেমন- হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বিমান, লঞ্চ, ভাড়ায় চালিত কার, এজেন্সি ইত্যাদি।
ট্রেডমার্ক আইনের বিবর্তনঃ ‘ট্রেডমার্ক’ শব্দটি ব্যবসায় জগতে বিশেষ করে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রচলিত। যদিও এর ধারণা অতি প্রাচীন কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দী হতে এর প্রচলন বর্তমান আকারে দৃশ্যমান হতে দেখা যায়। কতিপয় পণ্যের উৎস জানানোর উদ্দেশ্যে ইট, চামড়াজাত দ্রব্য, তৈজসপত্র, বইপত্র ইত্যাদি জাতীয় পণ্যের ওপর বিভিন্ন অক্ষর বা চিহ্ন দেওয়ার প্রচলন প্রাচীনকালেও ছিল। এমনকি গবাদি পশু পালনকারীরা তাদের পণ্যকে চিহ্নিত করার জন্য উত্তপ্ত লোহার ছ্যাঁক দিয়ে দাগ করে রাখত। ইংরেজরা একে ব্যান্ড বলত যা ট্রেডমার্কের সমার্থক। যে সকল ব্র্যান্ডের পণ্য বাজারে বেশি চাহিদা ছিল ঐ জাতীয় পণ্য প্রস্তুতকারী ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যের ঐ ধরনের ব্র্যান্ড অসৎ উপায়ে ব্যবহার করত। এভাবে ব্র্যান্ডের নকল করার প্রবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইংল্যান্ডের শেফিল্ডের উৎপাদিত চাকু, ছুরি, চামচ, কাঁটা চামচ ইত্যাদি এক সময়ে খুব জনপ্রিয় হয়ে পড়ে। এ সুযোগে অন্যান্য অঞ্চলের ঐ জাতীয় পণ্যের উৎপাদনকারী বা ব্যবসায়ীরা তাদের উৎপাদিত সস্তা ও নিম্নমানের পণ্যগুলো শেফিল্ডের উৎপাদিত বলে চালানো শুরু করে। এভাবে নকলজাত পণ্যের বাজারজাতকরণের ফলে পণ্যের প্রকৃত ও আসল উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে থাকে এবং পণ্য উৎপাদনে তারা উৎসাহ হারাতে থাকে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের কোন সহজ উপায় ছিল না। কমন ল’য়ে পাশিং অফ’ নামে প্রতিকার দেওয়া হতো। কিন্তু এতেও পরিস্থিতির বিশেষ উন্নতি হলো না।
শিল্প বিপ্লবের পর সমগ্র ইউরোপে এক নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। অতি দ্রুত ব্যাপক পরিমাণ শিল্পজাত পণ্য উৎপাদন, দেশে-বিদেশে সেরূপ পণ্যের বিতরণ এবং গণমাধ্যমে প্রচারণার ফলে ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এক জটিল সমস্যা দেখা দেয়। কোন পণ্য কোন কোম্পানির উৎপাদিত বা পরিবেশিত তা জানা সহজ ছিল না। যে সকল বাজারজাত পণ্য বেশি ক্রেতা আকৃষ্ট করতে পারত সেগুলোর উৎপাদনকারী বা পরিবেশক চিহ্নিত করার প্রয়োজন ও আগ্রহ দেখা দেয়। তখন উৎপাদনকারীরা তাদের উৎপাদিত পণ্যে যে চিহ্ন বা ব্র্যান্ড ব্যবহার করত তা রক্ষার জন্য এবং একজনের চিহ্ন যেন অন্য কেউ ব্যবহার করতে না পারে তার জন্য উপযুক্ত আইনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ব্রিটিশ কমন লয়ে পাশিং অফের প্রতিকার অনেক অনিশ্চিত, কালক্ষেপণকারী ও ব্যয়বহুল ছিল। ইতিমধ্যে প্যারিস কনভেনশন, ১৮৮৩ নামে ট্রেডমার্কসহ সকল শিল্পজাত সম্পত্তি রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক কনভেনশন হয়। পরে ১৮৯১ সালে মাদ্রিদ এগ্রিমেন্ট নামে আর একটি কনভেনশন হয় যেখানে ট্রেডমার্ক রক্ষার জন্য রেজিস্ট্রশনের বিধান করার ব্যাপারে মতৈক্য হয়। রেজিস্ট্রেশনের বিধান রেখে ১৯৩৬ সালে জার্মানিতে, ১৯৩৮ সালে ইংল্যান্ডে, ১৯৪২ সালে ইতালিতে এবং ১৯৪৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রেডমার্ক এ্যাক্ট পাস করা হয় যা মূলত ইংল্যান্ডের আইনের আদলে প্রণয়ন করা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হবার পর এটাই এখানে বহাল থাকে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ হবার পরও দীর্ঘদিন এ আইনটি এদেশে বলবৎ ছিল। ২০০৮ সালে অধ্যাদেশ আকারে পরে ২০০৯ সালে বাংলাদেশে ট্রেডমার্ক এ্যাক্ট পাস করা হয় যা এখন বলবৎ আছে। বর্তমানে কমন ল-এর পাশিং অফ-এর পাশাপাশি বিধিবদ্ধ আইন বলবৎ আছে এবং নিবন্ধিত ট্রেডমার্ক লঙ্ঘনের প্রতিকার আছে।
Leave a comment