প্রশ্নঃ নিষেধাজ্ঞা কি? অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা ও অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পার্থক্য দেখাও। কখন আদালত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করতে পারে। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করার সময় আদালতকে কি কি নীতি বিবেচনায় নিতে হয়?

নিষেধাজ্ঞাঃ নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে আদালতের একটি নির্দেশ যদ্বারা কোন ব্যক্তিকে একটি অন্যায় কাজ করা হতে বিরত থাকতে অথবা তার দ্বারা কৃত একটি অন্যায় কাজ অপসারণ করতে বলা হয়৷

লর্ড হ্যালসবেরীর মতে, নিষেধাজ্ঞা হলো এমন একটি বিচার বিভাগীয় কার্যক্রম যদ্বারা কোন পক্ষকে নির্দিষ্ট কোন কাজ করা বা করা হতে বিরত থাকার নির্দেশ প্রদান করা হয়।


(Injunction is a judicial process where a party is ordered to refrain from doing or to do a particular act or thing. -Lord Halsbury)

অতএব সহজ ভাষায় বলতে গেলে নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে আদালতের একটি নির্দেশ, যা কোন ব্যক্তির উপর প্রদান করা হয় এবং সে ব্যক্তিকে আসন্ন কোন অন্যায় কার্য করা হতে নিবৃত্ত রাখা হয় অথবা তার দ্বারা কৃত কোন অন্যায় কার্যটি অপসারণ করা হয়। ইকুইটি হতে উদ্ভূত এ অন্যায় নিরোধক প্রতিকারটি বেশ কার্যকরী প্রতীয়মান হওয়ায় বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং প্রায় সকল আদালতই তাদের ইচ্ছাধীন ক্ষমতায় নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করে থাকেন।

অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা ও অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পার্থক্যঃ অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা ও অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার মধ্যে নিম্নোক্ত পার্থক্যগুলি বিদ্যমান-

১. সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৫৩ ধারা মোতাবেক অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে এমন একটি নিষেধাজ্ঞা যা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অথবা আদালত কর্তৃক পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কার্যকর থাকে। মামলার যে কোন পর্যায়ে ইহা মঞ্জুর করা যেতে পারে এবং দেওয়ানী কার্যবিধির ৩৯ অর্ডার বিধি ১ দ্বারা ইহা নিয়ন্ত্রিত হয়।

অন্তবর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে এমন একটি নিষেধাজ্ঞা যা অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার প্রার্থনা শুনানী এবং তবিষয়ে আদেশকাল পর্যন্ত কার্যকর থাকে।

২. অপর পক্ষের উপর কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়া এবং যথাযথভাবে নোটিশ জারী হওয়া ছাড়া অস্থায়ী নিষেধজ্ঞা মঞ্জুর করা যায় না৷

কিন্তু সাধারণত নোটিশ জারীর পূর্বেই এবং দরখাস্ত প্রদানের সাথে সাথেই অন্তবর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করা হয়। নোটিশ জারী হবার পূর্বেই অন্যায়কারী তার অন্যায় কার্য করে ফেলতে পারে এই আংশকায় তা রোধকল্পে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য এ ধরণের নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করা হয়।

৩. মূল মামলার বিষয়বস্তু হতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা উদ্ভুত হয়। কিন্তু অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন হতে অন্তবর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা উদ্ভুত হয়।

৪. অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা উভয় পক্ষের শুনানীর পর মঞ্জুর করা হয় বা প্রত্যাখ্যান করা হয়; কিন্তু অন্তবর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করার বিষয়ে উভয় পক্ষের শুনানীর প্রয়োজন হয় না।

৫. অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ সাধারণত মূল মামলার চূড়ান্ত শুনানী পর্যন্ত বলবত থাকে। কিন্তু অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা পর্যন্ত অন্তবর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা বলবত থাকে৷

৬. অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার মূল মামলার আরজি হতে পৃথক একটি আবেদন। কিন্তু অন্তবর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার জন্য সাধারণত পৃথক কোন আবেদনের প্রয়োজন হয় না।

৭. অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদনপত্র পেশ করার সাথে সাথে আদালত সুবিবেচনার দ্বারা অন্তবর্তী কালীন নিষেধাজ্ঞার আদেশ দিতে পারেন।

এইভাবে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা এবং অন্তবর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা হয়৷

কখন আদালত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করতে পারেঃ 

দেওয়ানী কার্যবিধির ৩৯ আদেশের ১ বিধিতে বলা হয়েছে যে, যদি কোন মামলায় এফিডেবিট দ্বারা কিংবা অন্য কোন ভাবে প্রমাণিত হয় যে,

(ক) মামলায় জড়িত কোন সম্পত্তি মামলার কোন পক্ষ কর্তৃক বিনষ্ট, ধ্বংস বা হস্তান্তরিত হবার আশংকা দেখা দিচ্ছে কিংবা কোন ডিক্রী জারির দরুন অবৈধভাবে বিক্রি করার চেষ্টা করা হচ্ছে, অথবা,

(খ) বিবাদী তার পাওনাদারকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে তার সম্পত্তি অপসারিত বা হস্তান্তরিত করার ইচ্ছা প্রকাশ বা প্রচেষ্টা চালায় তাহলে, আদালত অনুরূপ কার্য রোধ করার জন্য অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ দিতে পারবেন। অথবা মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত উক্ত সম্পত্তি বিনষ্টকরণ, ধ্বংসকরণ, হস্তান্তর, বিক্রি বা অপসারণ, স্থগিত ও রোধ করার জন্য উপযুক্ত অন্য কোন আদেশ দিতে পারেন।

২ নম্বর বিধি মতে, বিবাদীকে চুক্তিভঙ্গ বা অন্য কোনরূপ ক্ষতিকর কার্য হতে বিরত রাখার মামলায় ক্ষতিপূরণ দাবি করা হোক বা না হোক বাদী মামলা রুজু হবার পর এবং রায় ঘোষণার পূর্বে বা পরে যে কোন সময়ে নালিশী চুক্তিভঙ্গ বা ক্ষতিকর কার্য হতে অথবা সংশ্লিষ্ট চুক্তির দরুণ উদ্ভূত সংশ্লিষ্ট সম্পত্তি বা অধিকারের সহিত সম্পর্কযুক্ত কোন ক্ষতিকর কার্য হতে বিবাদীকে নিবৃত্ত করার জন্য অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার প্রার্থনা করে আদালতে আবেদন করতে পারবে।

নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ, হিসাব রক্ষণ, জামানত, দান ইত্যাদি সম্পর্কে উপযুক্ত শর্তসাপেক্ষে আদালত নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করে আদেশ দিতে পারবেন। উক্ত শর্তসমূহের কোন একটি অমান্য করা হলে নিষেধাজ্ঞা দানকারী আদালত শর্ত ভঙ্গকারীর সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দিতে পারেন এবং উক্ত ব্যক্তিকে অনধিক ৬ মাসের দেওয়ানী কারাগারে আটক রাখার নির্দেশ দিতে পারেন।

এখানে আরো বলা হয়েছে যে, কোন সম্পত্তি ক্রোক করা হলে তা এক বছরের অধিককাল বলবত থাকবে না। এক বছর অতিক্রান্ত হবার পরও যদি শর্ত খেলাপ অব্যাহত থাকে তবে ক্রোককৃত সম্পত্তি নিলামে বিক্রি করা হবে এবং বিক্রিলব্ধ অর্থ হতে আদালত উপযুক্ত পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দানের নির্দেশ দিতে পারবেন। অবশিষ্ট অর্থ, যদি থাকে প্রকৃত অধিকার সম্পন্ন পক্ষকে ফেরত দিতে পারেন।

৩ নম্বর বিধি অনুযায়ী কোন নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করার পূর্বে আদালত নিষেধাজ্ঞার আবেদন সম্পর্কে বিপরীত পক্ষকে নোটিশ দিবেন। তবে বিলম্বের ফলে নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে এরূপ মনে হলে নোটিশ দেওয়ার প্রয়োজন হয় না।

নিষেধাজ্ঞার আদেশের বলে অসন্তুষ্ট কোন পক্ষের আবেদনক্রমে আদালত উক্ত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, পরিবর্তন বা রদ করতে পারেন।

সর্বোপরি, ৫ নম্বর বিধিতে বলা হয়েছে যে, কোন সমিতিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রদত্ত নিষেধাজ্ঞা কেবল উক্ত প্রতিষ্ঠানের উপরই প্রযোজ্য হবে না এর সকল সদস্য ও কর্মচারীদের উপরও তা প্রযোজ্য হবে।

এভাবে আদালত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত ক্ষমতাবলী প্রয়োগ করে থাকেন।

অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুরের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত নীতিঃ

নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করা বা না করা আদালতের ইচ্ছাধীন ক্ষমতা। তাই বলে আদালত তার খেয়াল খুশী মত এ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে না। এ সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠিত নীতিসমূহ অনুসরণ করতে হয়। অন্যায়কে প্রতিহত করা নিষেধাজ্ঞার অন্যতম লক্ষ্য হলেও একটা স্বচ্ছ ও প্রকৃত আইনগত অধিকার সুসংহত করাই নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুরের প্রধান লক্ষ্য। আদালত যখন নিশ্চিত হবেন যে, এর প্রয়োগ ফল সম্পূর্ণরূপে যে কোন পক্ষের প্রতি অন্যায় অথবা অবিচার ছাড়াই হবে তখন নিষেধাজ্ঞা সমর্থনযোগ্য হবে।

এগুলি ছাড়াও নিষেষধাজ্ঞা মঞ্জুর করা বা না করার ব্যাপারে নিম্নোক্ত বিষয়গুলির প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতে হয়ঃ-

১. আপাতদৃষ্টিতে একটি মামলা থাকতে হবে। (Existence of a prima facie case)

২. সেই মামলায় বাদীর জয় লাভের সম্ভাবনা থাকবে। 

৩. নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করা না হলে বাদীর অপূরণীয় বা মারাত্মক ক্ষতির আংশকা থাকবে।

৪. নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুরের ফলে বিবাদীর ক্ষতি এবং না মঞ্জুরের ফলে বাদীর ক্ষতি এই দুই ক্ষতির ভারসাম্য বাদীর অনুকূলে থাকবে।( Balance of inconvenience in favour of the plaintiff)

৫. নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুরের ফলে তৃতীয় ব্যক্তির ক্ষতির কোন আশংকা নেই তা নিশ্চিত হতে হবে।