অথবা, দেহ মনের সম্পর্ক প্রসঙ্গে লাইবনিজের মতবাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।
ভূমিকাঃ দর্শনের বিভিন্ন সমস্যাবলির মধ্যে দেহ ও মনসম্পর্কিত সমস্যাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। আধুনিক কালের দার্শনিকদের মধ্যে কেউ কেউ দেহ ও মনকে আলাদা দ্রব্য হিসেবে স্বীকার করেছেন, আবার কেউ কেউ দেহ ও মনকে একই দ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তবে যা-ই হোক না কেন, দেহ ও মন পরস্পর নির্ভরশীল। কেননা দেহ সুস্থ থাকলে মন সুস্থ ও সতেজ থাকে। আবার দেহ অসুস্থ হয়ে পড়লে মনও দুশ্চিন্তা ও দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়। দেহ ও মনের সম্পর্ক বিষয়ে দর্শনের ইতিহাসে বিভিন্ন মতবাদ লক্ষ্য করা যায়, যার একটি হলো পূর্বস্থাপিত বা পূর্বপ্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাবাদ। নিম্নে এই পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলাবাদ ব্যাখ্যায়িত হলোঃ
দেহ-মনের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণাঃ দেহ-মন সম্পর্কিত এসব মৌলিক প্রশ্নকে কেন্দ্র করে আধুনিককালে দর্শনে এ বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। যেসব দার্শনিক এ বিতর্কে অংশ নেন, তাদের মধ্যে রেনে ডেকার্ট, নিকোলাস ম্যালেবাসে, আর্নল্ড গিউলিনকস, বেনেডিক্ট স্পিনোজা; উইলিয়াম গটফ্রাইড লাইবনিজ, টমাস হাকলে প্রমুখ অন্যতম। ডেকার্ট অভিমত প্রকাশ করেন যে, দেহ ও মন পরস্পর দু’টি ভিন্নধর্মী দ্রব্য। দেহের স্বরূপ বিস্তৃতি এবং মনের স্বরূপ চিন্তন। পরস্পর ভিন্নধর্মী দ্রব্য হলেও, ডেকার্টের মতে, দেহ-মনের পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপিত হয়। দেহ-মনের সম্বন্ধ বিষয়ক ডেকার্টের এ মতবাদ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ নামে পরিচিত। গিউলিনকস ও ম্যালেবাসে বিশ্বাস করেন যে, দেহ ও মন দু’টি পৃথক দ্রব্য। এবং পৃথক ও ভিন্নধর্মী দ্রব্য বলেই এদের মধ্যে কোনো কারণিক সম্বন্ধ নেই বা একে অন্যের ওপর কোনো প্রকার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করতে সক্ষম নয়। তবে দেহ ও মনের মধ্যে অবশ্যই সম্পর্ক রয়েছে এবং এ সম্পর্ক প্রয়োজন অনুসারে স্থাপিত হয় ঈশ্বরের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে।
দেহ ও মনের সম্পর্ক সম্বন্ধে বিভিন্ন মতবাদঃ বিভিন্ন দার্শনিক দেহ ও মনের সম্পর্ক সম্বন্ধে যে বিভিন্ন মতবাদ দিয়েছেন সেগুলোর মধ্যে নিম্নলিখিত মতবাদ অন্যতম প্রধান। যথা- (১) ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ, (২) প্রয়োজনবাদ, (৩) সমান্তরালবাদ, (৪) পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলাবাদ, (৫) উপ-বস্তুবাদ, (৬) বিজ্ঞানবাদ, (৭) পরব্রহ্মবাদ, (৮) স্বেচ্ছামূলক ভাববাদ, (৯) সৃজনবাদ, (১০) উন্মেষবাদ।
দেহ ও মনের সম্পর্কঃ দেহ ও মনের মধ্যে যে নিবিড় সম্পর্ক তা বিভিন্নভাবে প্রকাশ করা যায়। মানুষ রেগে গেলে তার দৈহিক পরিবর্তনগুলোতে রাগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন- চোখ-মুখ লাল হয়ে যায়, রক্তের চাপ বেড়ে যায়, দেহে কম্পন দেখা যায় ইত্যাদি। আবার মস্তিষ্কে কোনো গুরুতর আঘাত লাগলে চেতনাশক্তি লোপ পায়। মস্তিষ্কের বৈকল্য অনেক প্রকার মানসিক রাগের কারণ।
দেহ-মনের প্রকৃতি/স্বরূপঃ ফরাসি দার্শনিক ডেকার্টের সময় থেকে দেহ-মনের প্রকৃতি এবং এদের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে গভীর অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ শুরু হয়। এই আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের জনক সর্বপ্রথম দেহ-মনের প্রকৃতি নির্ণয়ে প্রয়াসী হন। তিনি দেহ ও মনকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দু’টি দ্রব্য বলে মনে করেন। তার মতে, দেহের বিস্তার আছে, কিন্তু মনের কোনো বিস্তৃতি নেই। মন আধ্যাত্মিক ও প্রজ্ঞাদীপ্ত। মন প্রজ্ঞা দ্বারা পরিচালিত, কিন্তু দেহ জড়ীয়।
মানুষের দেহ ও মন দু’টি আলাদা জিনিস হলেও এ দু’য়ের সমন্বয়েই মানুষ। দেহ থেকে মন আলাদা হয়ে গৈলে, দেহ হয়ে পড়ে জড় পদার্থ। মনে যদি কাজ করার ইচ্ছা না থাকে তবে দেহ নিশ্চল হয়ে পড়ে। কারণ মানুষ শুধু জড়দেহের অধিকারী নয়, বরং চেতনা, চিন্তন ও কল্পনার অধিকারী। এক মানুষের মধ্যেই দেহ ও মনের আবাসস্থল। তাই ব্যক্তির দেহ ও মনকে কিছুতেই পৃথক করা সম্ভব নয়।
অপরপক্ষে স্পিনোজা মত প্রকাশ করেন যে, দেহ ও মনের মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, কিন্তু এ সম্পর্ক একে অন্যের ওপর কোনো প্রকার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট নয়। আসলে দেহ ও মন দু’টি সমান্তরাল সরলরেখার মতো পাশাপাশি চলমান। দেহে কোনো প্রকার পরিবর্তন ঘটলে সমান্তরালভাবে মনেও পরিবর্তন ঘটে এবং বিপরীতক্রমে মনে কোনো প্রকার পরিবর্তন ঘটলে দেহেও পরিবর্তন দেখা দেয়। দেহ-মনসম্পর্কিত স্পিনোজার এ মতবাদ সমান্তরালবাদ নামে পরিচিত । লাইবনিজ দেহ ও মনের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার করে অভিমত ব্যক্ত করেন যে, এ দু’টি দ্রব্য বা চিৎপরমাণুর মধ্যে পূর্বস্থাপিত সম্পর্ক বিদ্যমান। লাইবনিজের এ মতবাদ দর্শনে পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলাবাদ নামে পরিচিত। দার্শনিক হাক্সলে দেহ ও মনের সম্পর্ক বিষয়ক সমস্যাটি জড়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করেন। তার মতে, মনের কোনো স্বাধীন সত্তা নেই। এটি মস্তিষ্কের তথা দেহের উপবস্তু বিশেষ। দৈহিক ক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে মানসিক পরিবর্তন ঘটে কিন্তু বিপরীতক্রমে নয়। দেহ-মনসম্পর্কিত হাক্সলের এ মতবাদ উপ-বস্তুবাদ নামে পরিচিত।
লাইবনিজের মতবাদঃ লাইবনিজ দর্শনের ইতিহাসে মোনাড বা চিৎপরমাণু মতবাদের স্রষ্টা। তার মতে, এই বিশ্বজগত স্বনির্ভর এবং গবাক্ষহীন মোনাড দ্বারা গঠিত। এই অসংখ্য মোনাডই জগতের মূল উপাদান এবং ঈশ্বর হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ মোনাড। সর্বশ্রেষ্ঠ মোনাড হিসেবে ঈশ্বর জগতের অন্যান্য মোনাডগুলোকে সৃষ্টি করেন এবং সৃষ্টির সময়েই এগুলোর মধ্যে একটা শৃঙ্খলা বা সঙ্গতি বিধান করে দেন। এই শৃঙ্খলা অনুসরণ করেই জগৎ সুশৃঙ্খল, সুসংবদ্ধ এবং পরম ঐক্যপূর্ণ।
প্যাট্রিক-এর ভাষায় লাইবনিজের মতবাদঃ লাইবনিজ যেখানে দেহ ও মন মোনাড দ্বারা গঠিত এবং ঈশ্বর সৃষ্টির সময়েই দেহ ও মনের মধ্যে এক ধরনের শৃঙ্খলা স্থাপন করেছেন। এই শৃঙ্খলা অনুযায়ী দেহ ও মন পরস্পরের মধ্যে সব সময় সঙ্গতি রক্ষা করেছে। ডেকার্টের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া মতবাদকে অস্বীকার করে লাইবনিজ বলেন, “That Monad which we call the mind does not act upon those Monads which compose, the body, but the apparent harmony between them is a harmony preestablished from the beginning by the divine relation” (Patrick, Introdurtion to philosopy p-295)
প্রয়োজনবাদীদের মতবাদ অনুযায়ী ঈশ্বর বারবার দেহ ও মনের সম্পর্ক বিধানের জন্য হস্তক্ষেপ করেন, কিন্তু লাইবনিজ বারবার হস্তক্ষেপে বিশ্বাসী নন। তার মতে বারবার হস্তক্ষেপ ঈশ্বরের ক্ষমতাকে সীমিত করে। তাই সৃষ্টির সময় মাত্র একবার হস্তক্ষেপ করেই তিনি দেহ ও মনের নিত্য সঙ্গতির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এটাই হলো লাইবনিজ কথিত ঈশ্বরের পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলা।
লাইবনিজ তার পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলা মতবাদকে বোধগম্য করতে গিয়ে দু’টো ঘড়ির উপমা দিয়েছেন। তার মতে, দেহ ও মন দু’টো ঘড়ির মতো। এ ঘড়ি দু’টো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলার কারণে তার সবসময় একই সময় দিয়ে থাকে। এর ফলেই দৈহিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক পরিবর্তন এবং মানসিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দৈহিক পরিবর্তন ঘটা সম্ভব হয়। এভাবেই ঈশ্বর কর্তৃক বিধান করা পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলা দেহ-মন সম্পর্কে একটি কার্যকর ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, দেহ ও মনের সম্পর্কের স্বরূপ সম্পর্কিত আলোচনায় পূর্বপ্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাবাদ নামক মতবাদে কিছু ত্রুটি লক্ষ করা গেলেও এটাকে একেবারে মূল্যহীন বলা যায় না। কেননা, জগতের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে অসঙ্গতি থাকলেও অনেক বিষয়ই নিয়ম-শৃঙ্খলা অনুযায়ী চলছে। আর এ চলার পেছনে আগে থেকে কোনো কিছু প্রতিষ্ঠিত বিষয় না থেকে পারে না। এ ছাড়া ধর্মতাত্ত্বিক দিক থেকেও যদি বিষয়টি বিবেচনা করা হয় তাহলেও তার এ মতবাদ খুবই সন্তোষজনক বলে মনে হয়। শুধু তা-ই নয়, বিংশ শতাব্দীর চিন্তার পেছনে লাইবনিজের এই মতবাদ যথেষ্ট সহায়তা করেছে।
Leave a comment