উত্তরঃ সেলিনা হােসেনের ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ উপন্যাসের প্রদত্ত উক্তিটি আজিজের; সে মাটির প্রতি সাঁওতালদের অধিকার এবং ভালােবাসা বুঝতে এমন বলেছে।
ভারতবর্ষে সাঁওতাল বিদ্রোহের এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে। জুলুমে-জুলুমে তাদের শরীর গজিয়ে উঠেছিল। অন্যায় অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে তারা নিজেদেরকে সংঘটিত করতে থাকে। ১৮৫৫ সালের ৭ জুলাই এই দিন তারা প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে। অত্যাচারী জমিদার, জোতদার, শাসকশ্রেণি অস্ত্র নিয়ে ওদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ওরা বারবার প্রাণ দিয়েছে কিন্তু কোনাে অবস্থাতেই তারা দমেনি। জীবিকার কারণে ওরা জায়গা বদল করেছে বিভিন্ন সময়ে, বদল করেছে শান্তির নীড় গড়ে তােলার আশায়। এই বিদ্রোহের পর ওদের এক অংশ এসে মালদহ জেলার চাপাইনবাবগঞ্জের নাচোল এবং আশেপাশে বসতি গড়ে তােলে। অন্য অংশ জলপাইগুড়ি, রংপুর, দিনাজপুর প্রভৃতি জায়গায় চলে যায়। কিন্তু যে আশায় নীড়ের সন্ধানে ঘুরে বেড়িয়েছে, সে আশা ওদের পূরণ হয়নি। উত্তরবঙ্গের জোতদারদের পীড়নে জীবন অতিষ্ঠ হয়েছে। বর্গাদার চাষি হয়ে খেটেছে ওদের জমিতে। নিজের খরচে, নিজের শ্রমে ফসল ফলিয়ে তার অর্ধেক নিজের খরচে তুলে দিয়ে আসত জোতদারদের গােলায়। এছাড়াও ছিল নানা ধরনের বেগার পরিশ্রম। তারা বড় ভয় করতাে জোতদারদের খেয়ালখুশিকে। কেননা যখন-তখন বিনা কারণে জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার ভয় থাকতাে।
১৯২৯ সালে বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক মন্দার হাত থেকে রেহাই পায়নি ভারতবর্ষ। সে ধাক্কা এসে লাগে কৃষকের মধ্যেও, ফসলের দাম যায় কমে। জোতদাররা এই বােঝা চাপাতে চাইল বর্গাচাষিদের ওপর। দাবি করলাে ফসলের তিনভাগের দুভাগ, বর্গাচাষিদের পক্ষে এ বােঝা বহন করা ছিল অসম্ভব। তারা প্রতিবাদ করলে জমি থেকে উচ্ছেদ করা শুরু হলাে। নিরুপায় চাষির বুকে জ্বলে ওঠে আগুন। এই অযােক্তিক দাবি তারা মানতে চাইলাে না। ১৯৩২ সালের দিকে মালদহ এবং দিনাজপুরের দুহাজার সাঁওতাল সংগঠিত হয়ে শুরু করে সংগ্রাম।“ওদের আক্রমণে জোতদারদের ধানের গােলা পুড়ে যায়, পুড়ে যায় বাড়িঘর, ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয় কিংবা লুট হয়ে যায়। এই অবস্থা তাে বেশিদিন চলতে পারে। জোতদাররা কি আর চুপচাপ থাকবে? ওরা প্রতিরােধ শুরু করলাে। সাঁওতাল কৃষকের এই বিদ্রোহকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার জোতদারদের পক্ষ অবলম্বন করে। প্রথম দিকে অল্প পরিসরে এই ক্ষুদ্র নৃগােষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এই আন্দোলন নেতৃত্ব দিচ্ছিল জিতু বােটকা এবং সামু। ওদের সাহস ছিল অপরিসীম। কিন্তু শুধু সাহস দিয়ে অনেকসময় কিছু হয় না- সেদিন সাঁওতালেরা, স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়েছিল। দীর্ঘ সংঘর্ষের পর সাঁওতালেরা পরাজিত হয়। কিন্তু তারা পরাজিত হলেও তাদের ক্ষোভের আগুন শেষ হয় না। এর অনেকদিন পর আবার দৃশ্যপটে দেখা যায়- তেভাগা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে সাঁওতালরা। এদের নেতৃত্বে আসে মাতলা সর্দার, শত্রু মাডাং এবং হরেকের মতাে সাহসী সাঁওতাল যুবকেরা। শুক্কু মাডাং হেড়ে গলায় গান ধরে- তার গানের গলা ভালাে নয়। কিন্তু গানের সুর যে কাউকে কাছে, টেনে নেবে। আজিজ তাদের সম্পর্কে তথ্য দেয়- এই মাটি ওদের জন্ম-জন্মান্তরের। সাঁওতালদের মধ্যে ভিনদেশি। পূর্বপুরুষদের অহঙ্কার নেই। তাই এ মাটি সবার আগে তাদের বেশি নিজের।
মূলত মা-মাটি-মানুষের প্রতি সাঁওতালদের যে ভালােবাসা তা বুঝাতে লেখক আজিজের জবানিতে এমন উক্তি পরিবেশন করেছেন।
Leave a comment