উত্তরঃ বাংলাদেশের প্রধান কথাসাহিত্যিকদের অন্যতম সেলিনা হােসেন (জন্ম ১৯৪৭)। তার সাহিত্যের বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে বহমানকাল, রাষ্ট্র ও মানবজগৎ। তার উপন্যাসে রাজনৈতিক সময় বা আন্দোলন অধিকতর পরিপ্রেক্ষিত অর্জন করে। বাঙালির অহঙ্কার ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তার লেখায় নতুন মাত্রা অর্জন করে। নারীর শাশ্বত দৃষ্টি, সনাতন আদর্শ বজায় থাকে তার লেখায়। এক্ষেত্রে তিনি স্বদেশ ও স্বজাতির ঐতিহ্যের প্রতি দৃঢ় এবং দায়িত্বশীল। এমন প্রত্যয়ে গৌরবােজ্জ্বল পর্বগুলাে উন্মােচিত হয় কাহিনিগাত্রে; জাতীয় চরিত্র প্রতীকায়িত হয় আদর্শের আশ্রয় থেকে। এভাবে তার রচনাসম্ভার হয়ে উঠেছে অনবদ্য এবং অভিনব।
‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ (১৯৮৯) উপন্যাসে তেভাগা আন্দোলনের বিষয়াদি উপস্থাপিত হলেও এ উপন্যাসে সাঁওতালদের বিদ্রোহের কথা সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। জোতদারি প্রথায় কৃষকদের সার্বিক পরিস্থিতি উপস্থাপিত হয়েছে। ভারতবর্ষে সাঁওতাল বিদ্রোহের এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে। জুলুমে-জুলুমে তাদের শরীর গজিয়ে উঠেছিল। অন্যায়-অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে তারা নিজেদেরকে সংঘটিত করতে থাকে।
১৮৫৫ সালের ৭ জুলাই এই দিন তারা প্রথম বিদ্রোহ ঘােষণা করে। অত্যাচারী জমিদার, জোতদার, শাসকশ্রেণি অস্ত্র নিয়ে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ- ওরা বারবার প্রাণ দিয়েছে কিন্তু কোনাে অবস্থাতেই তারা দমেনি। জীবিকার কারণে ওরা জায়গা বদল করেছে বিভিন্ন সময়ে, বদল করেছে শান্তির নীড় গড়ে তােলার আশায়। এই বিদ্রোহের পর ওদের এক অংশ এসে মালদহ জেলার চাপাইনবাবগঞ্জের নাচোল এবং আশেপাশে বসতি গড়ে তােলে। অন্য অংশ জলপাইগুড়ি, রংপুর, দিনাজপুর প্রভৃতি জায়গায় চলে যায়। কিন্তু যে আশার নীড়ের সন্ধানে ঘুরে বেড়িয়েছে, সে আশা ওদের পূরণ হয়নি। উত্তরবঙ্গের জোতদারদের পীড়নে জীবন অতিষ্ঠ হয়েছে। বর্গাদার চাষি হয়ে খেটেছে ওদের জমিতে। নিজের খরচে, নিজের শ্রমে ফসল ফলিয়ে তার অর্ধেক নিজের খরচে তুলে দিয়ে আসত জোতদারদের গােলায়। এছাড়াও ছিল নানা ধরনের বেগার পরিশ্রম। তার বড় ভয় করতাে জোতদারদের খেয়ালখুশিকে। কেননা যখন-তখন বিনা কারণে জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার ভয় থাকতাে।
১৯২৯ সালে বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক মন্দার হাত থেকে রেহাই পায়নি ভারতবর্ষ। সে ধাক্কা এসে লাগে কৃষকের মধ্যেও, ফসলের দাম যায় কমে। জোতদাররা এই বােঝা চাপাতে চাইল বর্গাচাষিদের ওপর। দাবি করলাে ফসলের তিনভাগের দু’ভাগ- বর্গাচাষিদের পক্ষে এ বােঝা বহন করা ছিল অসম্ভব। তারা প্রতিবাদ করলে জমি থেকে উচ্ছেদ করা শুরু হলাে। নিরুপায় চাষির বুকে জ্বলে ওঠে আগুন। এই অযােক্তিক দাবি তারা মানতে চাইলাে না। ১৯৩২ সালের দিকে মালদহ এবং দিনাজপুরে দু’হাজার সাঁওতাল সংগঠিত হয়ে শুরু করে সংগ্রাম। লেখক এরপর জানাচ্ছেন-
“ওদের আক্রমণে জোতদারদের ধানের গােলা পুড়ে যায়, পুড়ে যায় বাড়িঘর, ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয় কিংবা লুট হয়ে যায়। এই অবস্থা তাে বেশিদিন চলতে পারে না। জোতদাররা কি আর চুপচাপ থাকবে? ওরা প্রতিরােধ শুরু করলাে। বন্দুকের সামনে টিকতে না পেরে এরা পান্ডুয়া আদিনা মসজিদে জমা হয়।”
সাঁওতাল কৃষকের এই বিদ্রোহকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার জোতদারদের পক্ষ অবলম্বন করে। প্রথম দিকে অল্প পরিসরে এই ক্ষুদ্র নৃগােষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এই আন্দোলন। নেতৃত্ব দিচ্ছিল জিতু বােটকা এবং সামু। ওদের সাহস ছিল অপরিসীম। কিন্তু শুধু সাহস দিয়ে অনেকসময়ই কিছু হয় না- সেদিন সাঁওতালেরা স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়েছিল। দীর্ঘ সংঘর্ষের পর সাঁওতালেরা পরাজিত হয়। কিন্তু তারা পরাজিত হলেও তাদের ক্ষোভের আগুন শেষ হয় না।
এখানে স্মরণীয় যে- ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আসার পরেই ঘটে গেল পঞ্চাশের মন্বন্তর, অনাহারে মরতে লাগল হাজার হাজার মানুষ আর মুনাফালােভী জোতদার আর চোরাকারবারির দল সেই সুযােগে সর্বস্বান্ত করতে চাইল খেটে খাওয়া মানুষদের। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নাৎসীবাদের চূড়ান্ত পরাজয় ও দুনিয়াব্যাপী নতুন যুগের সম্ভাবনাময় পরিস্থিতিতেই তেভাগার সূচনা। নিপীড়িত, অত্যাচারিত কৃষক সমাজের উপর জোতদারদের জোরজুলুম বন্ধ করার দাবি নিয়ে এসেছিল তেভাগা। সারা বছরের হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে ধান কাটা, জোতদারদের খােলানে কাটা ধান বহন করা, ঝাড়াই মাড়াই করা আর গােলাভর্তি করে বেগার খেটে যৎসামান্য ধান নিয়ে নিজের ভরণপােষণ করাই ছিল চাষিদের কাজ। কিন্তু এ ক্ষোভের মেঘ পুঞ্জিভূত হতে হতে বিশাল আন্দোলনের আকার নেয় এবং স্লোগান ওঠে ধান কেটে ঘরে তােলাে এবং দখল রেখে চাষ করাে এবং আধির বদলে তেভাগা চাই।
অর্থাৎ মােট উৎপন্ন ফসলের দুভাগ পাবে চাষি এবং একভাগ পাবে জমির মালিক। এমনি করে প্রচলিত অন্যায় ব্যবস্থাকে গুড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে চলল মেহনতি মানুষের মিছিল- এটাই তেভাগা আন্দোলন। এ আন্দোলনের প্রত্যক্ষ প্রভাব থেকে তখনাে পূর্ব পাকিস্তানের কৃষক সমাজ দূরেই ছিল, কারণ দেশ-বিভাজনের বিষবাষ্প তখনাে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। ক্রমে ক্রমে ফাটল ধরল, মুসলিম কৃষকদের মধ্যে থেকেও তেভাগার ডাক আসতে লাগল। মানুষ বুঝতে শিখল মুসলমান জোতদার আর হিন্দু জোতদারদের মধ্যে যেমন পার্থক্য নেই তেমনি মুসলমান আর হিন্দু কৃষকের মধ্যেও কোনাে পার্থক্য নেই। ধর্মের গণ্ডিকে মানুষ সহজেই পেরিয়ে এসে বলল- ‘দাড়ি টিকি ভাই ভাই, লড়াই এর ময়দানে জাতভেদ নাই।’
মূলত ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ লাভের অধিকার থেকেই কৃষকসম্প্রদায় তেভাগা আন্দোলনের সূচনা করে। উল্লেখ্য- তেভাগা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে সাঁওতালরা। এদের নেতৃত্বে আসে মাতলা সর্দার এবং হরেকের মতাে সাহসী সাঁওতাল যুবকেরা। সে মাতলা মাঝি চাপা স্বভাবের লােক। বয়ােজ্যষ্ঠ, কালাে পেটানাে শরীর। সে কেবল প্রচণ্ড সাহসী নয়, জোতদারদের বিরুদ্ধে সেই সবচেয়ে সোচ্চার। মাতলা চাষবাস করে। পাশাপাশি পাটির কাজ। সে ভালাে বক্তৃতা করে। ঘরােয়া সভা করে। পায়ে গােদ হয়েছে। ব্যথায় কষ্ট পায়। হাঁটতে কষ্ট হয়। ভেষজ ওষুধ লাগায়। তবু পাটির কাজের নেশায় সে আচ্ছন্ন। কর্মতৎপরতার গুণে সে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ পায়। তার বাড়ি একটা ক্যাম্প করা হয়। সেখানে ছেলেদের তীরধনুক ও বর্শী চালানাে শেখানাে, পুলিশি তৎপরতার মখে নিজেদের বাচাননা, আত্মগােপনে থাকা ইত্যাদি শেখানাে হয়। তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রের দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে। সাঁওতালদের চেতনাসঞ্চারী মানসিকতা। লেখকের ভাষায়
–
“ওর সামনে বসে মাতলা যখন জোতদারদের শােষণের বিরুদ্ধে কথা বলে, আন্দোলন গড়ে তােলার পরিকল্পনা দেয়। ও মনে মনে গৌরব বােধ করে। এমন মানুষই ও দেখতে চায়, যারা অধিকারের প্রশ্নে সােচ্চার, যারা নিজেদের পায়ের নিচে শক্ত মাটির ভিত চায়।”
মাতলার তৎপরতায় কষক আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। সাঁওতালদের মধ্যে আন্দোলনের প্রাণ সঞ্চার করে সে। তেভাগা আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় তার বিরুদ্ধেও হুলিয়া জারি হয়। পুলিশি নির্যাতন এবং কৌশলগত কারণে পিছিয়ে আসার বিষয়েও তার আছে জোরালাে যুক্তি-
“আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়েছি, আমরা পরাজিত হয়েছি, কিন্তু মাথা নিচু করিনি। আবার আমরা শক্তি সঞ্চয় করব, আবার আমরা লড়ব। মনে রেখাে, আমরা শােক করব না।”
এ গােটা নাচোলের ষাট ভাগেরও বেশি সাঁওতাল কৃষক। প্রথম তেভাগার বীজ ওদের মধ্যেই রােপিত হয়েছে। আর সেই সাঁওতালদের একত্রিত করেছে- নেতৃত্ব দিয়েছে মাতলা সর্দার- সেই তেভাগা আন্দোলনের প্রাণশক্তি হিসেবে বিবেচিত। তাছাড়া হরেকও আরেক সাঁওতাল যুবক- যে নিজের জীবনের বিনিময়ে তেভাগা আন্দোলনকে সার্থক করে তুলতে চায়। যেমন-
“হরেক দরকার হলে পার্টির জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারে। তারপর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে চলে যায়।…ইলা নিজের ভুল বুঝতে পারে। এরা একরােখা, আপসহীন এদের চরিত্র। সাঁওতালগুলাে এ অঞ্চলের শক্তি, আন্দোলনের প্রাণবিন্দু।”
এরপর দেখা যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে জোতদার বিরােধী আন্দোলন এবং তেভাগার পক্ষে জোরালাে আন্দোলন শুরু হয়। রাঙা মিয়া, চরণ মাঝি ও এছান মিয়ার খােলান থেকে ধান নিয়ে আসা হয়েছে। ওরা তেভাগা ও সাত আড়ি জিন মেনে নেয়নি। আজ ধান ভাগ করে ওদের হিস্যা জোতদারদেরকে পৌছে দেওয়া হয়। মাতলার তত্ত্বাবধানে সব ব্যবস্থা নিখুঁত হয়- কোথায় কোনাে বিশৃঙ্খলা লক্ষ করা যায় না। অন্যদিকে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর দায়িত্ব পালন করে শেখ আজহার হােসেন। তাদের বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রত্যেকে রাতে এলাকার প্রতি গ্রাম থেকে দুজন করে স্বেচ্ছাসেবক সারারাত পাহারায় থাকে। প্রায় তিন-চারশাে স্বেচ্ছাসেবক ক্যাম্পের আশেপাশে থাকে। নাচোল এখন মুক্ত অঞ্চল নিজেদের শাসন চালু হয়েছে- জমিদার- জোতদাররা টু শব্দ করতে পারে না। আইনমতাে ধান ভাগ হয়ে চলে যায় যার যার বাড়িতে। চাষিরা ধান খােলানে তুলে ভূস্বামীকে খবর দেয়। ভূস্বামী উপস্থিত হলে তার সামনেই ভাগ হয়। উপস্থিত না হলে ধান তিন ভাগ করে দুই ভাগ কৃষকের জন্য রেখে এক ভাগ গরুর গাড়িতে করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মালিকের বাড়িতে। কৃষকদের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা দেখা যায়- সুদিনের প্রত্যাশায়।
সুতরাং আমরা সার্বিক আলােচনা থেকে বলতে পারি- ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ উপন্যাসে তেভাগা আন্দোলনের কথা বর্ণিত হলেও এখানে একটি প্রধান অংশ জুড়ে আছে সাঁওতাল বিদ্রোহ এবং সেই বিদ্রোহ-আন্দোলনের গতি-প্রকৃতির নানা দিকসমূহ। ফলে উপন্যাসে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সঁওতালবিদ্রোহের স্বরূপ।
Leave a comment