প্রশ্নঃ সমালােচনাসহ বিচারমূলক বাস্তববাদ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, বিজ্ঞানসম্মত বাস্তববাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।

অথবা, বৈজ্ঞানিক বাস্তববাদের সাথে এ মতবাদের কোন মিল আছে কি?

ভূমিকাঃ আধুনিক দর্শনে সুবিচার বা বিচারমূলক বাস্তববাদ একটি বিশেষ মতবাদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ১৯২০ সালে সান্টায়ান, ড্রেক, প্র্যাট, লাভজয়, রজার্স, সেলার্স প্রমুখ মার্কিন দার্শনিক এ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। প্রের্দিক এ মতবাদকে বৈজ্ঞানিক বাস্তববাদ থেকে আলাদা করার জন্য এর নাম দেন নব্য বৈচারিক বা বিচারমূলক বাস্তববাদ। নব্য বাস্তববাদের দোষগুলােকে আলােচনা ও যুক্তিতর্কের মাধ্যমে দূরীভূত করে নিজেদের নতুন মত দেয়াই নব্য বিচারমূলক বাস্তববাদের কাজ।

বিচারমূলক বাস্তববাদঃ বাস্তববাদ অনুসারে জ্ঞেয়বস্তু জ্ঞাতার ওপর নির্ভরশীল নয়। জ্ঞেয়বস্তুর জ্ঞাতার মন-নিরপেক্ষ স্বতন্ত্র সত্তা আছে। কোনাে বস্তুর জ্ঞান লাভ করার মানে এই নয় যে আমরা এটি জেনেছি বলেই বস্তুটি সৃষ্টি হলাে। আসলে বস্তুটি ছিলাে বলেই আমরা তা জানতে পেরেছি। মােটামুটি সব বাস্তববাদী মনে করেন যে, বস্তুর জ্ঞাননিরপেক্ষ অস্তিত্ব রয়েছে, বস্তুর সাথে জ্ঞানের কোনাে অভ্যন্তরীণ সম্বন্ধ নেই এবং বস্তু সংখ্যায় একাধিক। কিন্তু বস্তু জ্ঞান থেকে কতটুকু স্বতন্ত্র এবং কিভাবে বস্তুকে জানা যায় এ নিয়ে বাস্তববাদীদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। আবার বস্তুর দ্রব্য যে একান্তভাবেই জ্ঞানাতিরিক্ত, এ বিষয়ে বাস্তববাদীদের মধ্যে মতবিরােধ না থাকলেও বস্তুর গুণগুলাে সবই জ্ঞানাতিরিক্ত, না কিছু কিছু গুণ জ্ঞানসাপেক্ষ-এ নিয়ে তাদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। যারা বস্তুর দ্রব্যত্ব ও সব গুণকে জ্ঞানাতিরিক্ত বলে মনে করেন, তারা সরল বাস্তববাদী দার্শনিক নামে পরিচিত এবং তাদের মতবাদ সরল বাস্তববাদ নামে অভিহিত। আবার যারা বিশ্বাস করেন যে, দ্রব্যত্ব এবং কিছু গুণ জ্ঞানাতিরিক্ত হলেও অন্য কতগুলাে গুণ জ্ঞানসাপেক্ষ, তারা বৈজ্ঞানিক বাস্তববাদী দার্শনিক বলে খ্যাত। এরা প্রতীকবাদী নামেও পরিচিত। এদের মতবাদ দর্শনের ইতিহাসে বৈজ্ঞানিক বাস্তববাদ বা প্রতীকবাদ নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে কিছুসংখ্যক দার্শনিক যেমন- মুর, হল্ট, মারভিন ও প্যারি আরেক ধরনের বাস্তববাদ প্রচার করেন, যা নব্য-বাস্তববাদ নামে পরিচিত। ড্রেক, লাভজয় ও ভ্যাট অন্য আরেক প্রকারের বাস্তববাদ প্রতিষ্ঠা করেন, এদের মতবাদ নব্য-বিচারমূলক বাস্তববাদ নামে খ্যাত।

বস্তুকে সরাসরি জানি নাঃ নব্য বাস্তববাদ অনুসারে বস্তুকে আমরা সরাসরি জানতে পারি। নব্য বিচারমূলক বাস্তববাদ অনুসারে একথা মিথ্যা। নব্য বিচারমূলক বাস্তববাদীদের মতে, বস্তুকে আমরা সরাসরি জানি না, কোনাে কিছুর মাধ্যমে জানি। বস্তু যদি সােজাসুজি জ্ঞানের বিষয় হয় তবে কখনাে ভ্রান্ত জ্ঞানের সৃষ্টি হতাে না। কিন্তু আমাদের ভ্রান্ত জ্ঞানের অভাব নেই। অন্ধকারে আমরা দড়িকে সাপ মনে করি, ছায়াকে মানুষ- এ রকম আরাে কত কী! এভাবে আমাদের ভ্রান্ত জ্ঞানের অভাব নেই। এভাবে আমাদের ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ হয় এবং আমরা ভ্রান্ত জ্ঞানলাভ করি। কাজেই একথা ঠিক যে, বস্তুকে কখনও সরাসরি জানা যায় না।

জ্ঞানের বিষয়ই জ্ঞান হয় নাঃ নব্য বাস্তববাদীরা মনে করেন, জ্ঞানের বিষয়ই জ্ঞান। কিন্তু নব্য বিচারমূলক বাস্তববাদীরা মনে করেন, যদি জ্ঞানের বিষয়ই জ্ঞান হয় তাহলে একই বস্তু বিভিন্ন জ্ঞানাকারে বিভিন্ন লােকের কাছে প্রকাশিত হতে পারে। আবার একই লােকের একই বস্তুর বিভিন্ন প্রত্যক্ষণও হতে পারে। বাগানে ফুটন্ত গােলাপটিকে আমরা সবাই দেখতে পাই। সে ফুলটি যদি রামের জ্ঞান হয়, তবে তা আবার রহিমের জ্ঞান হবে কী করে? আসলে নব্য বাস্তববাদীরা এ সমস্যার সমাধান করতে পারেননি।

ভাববাদীদের বিরােধিতাঃ বিচারমূল বাস্তববাদীরা শুধু যে নব্য বাস্তববাদীদের মতকে অস্বীকার করেছেন তা নয়। ভাববাদীদের সঙ্গেও তাদের মতের অমিল রয়েছে। তারা যদিও বলেন প্রত্যক্ষের বিষয় মন বহির্ভুত নয়, তবুও তা নিছক মনের ধারণা মাত্রও নয়। তবে প্রশ্ন ওঠে— তা কী? তা হলাে বাহ্য বস্তু থেকে পাওয়া এক প্রকার ভারবিশেষ। এ যে বস্তুর প্রভাব যাকে আমরা সােজাসুজি জানি তাকে নাম দিয়েছেন ‘অন্তরসত্তা’। এটা জড়ও নয় আবার চেতনও নয়। এগুলাে বুদ্ধিগ্রাহ্য পদার্থবিশেষ। এগুলােকে গ্রহণ করার পর মানুষ বহির্জগতে এদের বাস্তব উৎসকল্পনা করে নেয়। এ কল্পনা যেখানে যথার্থ প্রত্যক্ষ সেখানে যথার্থ। যেখানে অযথার্থ কল্পনা সেখানে ভ্রান্ত।

জ্ঞানের ত্রয়ীঃ বিচারবাদী বাস্তববাদীরা মনে করেন, প্রত্যক্ষকারী মন, ইন্দ্রিয়ােপাত্ত বা অন্তরস এবং বহির্জগৎ জ্ঞানের ত্রয়ী বা তিনটি জিনিস। জ্ঞান হতে এ তিনটি জিনিসের প্রয়ােজন। মন সরাসরি অন্তরসত্তাকে জানে এবং অন্তর সত্তা থেকে বস্ত কল্পনা করে। তাদের মতে, জ্ঞানের বিষয়বস্তু এবং জ্ঞাতা বা মন এক হতে পারে না।

সমালােচনাঃ বিচারমূলক বাস্তববাদীদের মতামত নব্য বাস্তববাদীদের বিরােধিতার মাধ্যমে গড়ে উঠলেও এই মতবাদের ত্রুটি বিদ্যমান। নিচে এগুলাে আলােচনা করা হলাে-

(১) বস্তুর অস্তিত্ব সংশয়পূর্ণঃ বিচারমূলক বাস্তববাদীদের মতে, আমরা সরাসরি অন্তরসত্তা জানি এবং তা থেকে বস্তুকে কল্পনা করি। কল্পনা সব সময় সংশয়পূর্ণ। কাজেই বিচারমূলক বাস্তববাদীদের মতে, বস্তুর অস্তিত্বও সংশয়পূর্ণ।

(২) এটা স্পষ্ট নয়ঃ বুদ্ধিগ্রাহ্য, অন্তরসত্তার মাধ্যমে যদি বস্তুর জ্ঞান হয় তবে নিশ্চয়ই এর সাথে বস্তুর সম্পর্ক আছে। অন্তরসত্তার সাথে এ সম্পর্কের বিষয় বৈচারিক বাস্তববাদীদের স্পষ্ট কিছু স্বীকার করেন না।

(৩) এটা জটিলঃ বিচারমূলক বাস্তববাদীদের অন্তরসত্তা, ইন্দ্রিয়ােপাত্ত, স্বভাব বিমিশ্র ইত্যাদি শব্দের অর্থ বড়ই দুর্বোধ্য এবং রহস্যাবৃত।

(৪) জটিল শব্দের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গেঃ বিচারমূলক বাস্তববাদে অন্তর সত্তা, ইন্দ্রিয়ােপাত্ত, স্বভাব বিমিশ্র ইত্যাদি শব্দগুলাের অর্থ খুবই দুর্বোধ্য এবং রহস্যাবৃত।

বৈজ্ঞানিক বাস্তববাদঃ নিম্নে বৈজ্ঞানিক বাস্তববাদ সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে-

বৈজ্ঞানিক বাস্তববাদ লৌকিক বাস্তববাদের ত্রুটি নির্দেশ করে। লৌকিক বাস্তববাদের ত্রুটি নিরসনের জন্য লক বৈজ্ঞানিক বা প্রতিরূপী বাস্তববাদের প্রবর্তন করেন। এ মতবাদ সরল বাস্তববাদের মতাে বস্তুর স্বতন্ত্র মননিরপেক্ষ অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। তবে এ মতবাদ মনে করে যে, বস্তু প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে জ্ঞাত হয় না। প্রত্যক্ষ প্রতিভাত হয় বস্তুর প্রতিরূপ। আর এদিক থেকে এ মতবাদকে প্রতিরূপী বাস্তববাদ বলা হয়। মন কেবল প্রত্যক্ষভাবে ধারণাকে জানতে পারে এবং ধারণার মাধ্যমে পরােক্ষভাবে বস্তু সম্পর্কে জ্ঞাত হয়। বস্তু সাক্ষাৎভাবে জ্ঞাত হয় না। তিনি বস্তুর গুণাবলিকে দুইভাগে ভাগ করেন। যথা- (i) মূখ্য গুণ (Primary Qualities) (ii) গৌণ গুণ (Secondary Qualities)।

যে গুণগুলাে বস্তুতেই থাকে তাদের তিনি মুখ্য গুণ বলেছেন। যেমন- বস্তুর আয়তন, সংখ্যা, ঘনত্ব, বিস্তৃতি, গতি প্রভতি বস্তুর মূখ্য গুণ। আর যে গুণগুলাে ব্যক্তিসত্তা জ্ঞানগত এগুলােকে তিনি গৌণ গুণ বলেছেন। যেমন- রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ইত্যাদি গুণ আন্তংভাবেই ব্যক্তিনির্ভর বা জ্ঞাননির্ভর। কাজেই বাহ্য সম্পর্কে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি তা বস্তু প্রতীকের মাধ্যমে। কোনাে বস্তুকে সরাসরি জানা যায় না। এ মতবাদ অনুসারে বস্তুর প্রতীককে আমরা সরাসরি জানতে পারি । এ মতবাদের আর এক নাম প্রতীকবাদ। যখন প্রতীকের সঙ্গে বস্তুর সামঞ্জস্য হয় তখন সত্য জ্ঞান পাওয়া যায়। আর যখন প্রতীকের সঙ্গে বস্তুর কোনাে মিল থাকে না তখন সেই জ্ঞান হয় মিথ্যা।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বিচারমূলক বাস্তববাদের কিছু দোষত্রুটি থাকা সত্ত্বেও এর বাস্তব মূল্যকে অস্বীকার করার কোনাে উপায় নেই। যদিও এ মতবাদ ভাববাদ ও নব্য বাস্তববাদের দিকে সমালােচনা করতে যেয়ে এমন এক বিড়ম্বনার সৃষ্টি করেছেন যার ফলে প্রকারান্তরে এ মতবাদ প্রতীকবাদ বা ভাববাদের দিকে ধাবিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু দর্শনের একটি মতবাদ হিসেবে এর গুরুত্বকে আমরা কোনােভাবেই অস্বীকার করতে পারি না। তা ছাড়া বৈজ্ঞানিক বাস্তববাদের সাথে বিচারমূলক বাস্তববাদের কোনাে সাদৃশ্য নেই।