অথবা, নব্য বাস্তববাদ-এর মুল্যায়ন কর।
অথবা, সমালােচনাসহ বাস্তববাদ ও নব্য বাস্তববাদ ব্যাখ্যা কর।
ভূমিকাঃ জ্ঞান হতে হলে জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয় বস্তুর প্রয়ােজন। যিনি বস্তুর জ্ঞান পান তিনি জ্ঞাতা। আর জ্ঞাতা যে বস্তুর জ্ঞান পায় তা জ্ঞেয় বস্তু। আমরা কি জানি, কাকে জানি। আমরা যা জানি তা কি জানার ওপর নির্ভর করে। না জ্ঞান নিরপেক্ষভাবেই থাকে। অর্থাৎ যা জানি তার স্বরূপ কী? এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে মতবিরােধ দেখা দেয়। দর্শনের ইতিহাসে একদল দার্শনিক বলেন, জ্ঞেয় বস্তু মনের বা জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল। এদের নাম ভাববাদী। আরেক দল দার্শনিক বলেন, জ্ঞেয় বস্তু জ্ঞাতার জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল নয়। বস্তু মননিরপেক্ষ সত্তা নিয়েই বিরাজমান। এদেরকে বস্তুবাদী বলা হয়। এই বস্তুবাদেরই একটা রূপ হলাে নব্য বাস্তববাদ।
বাস্তববাদঃ যে মতবাদ অনুসারে জ্ঞেয় বস্তুর একটি স্বাধীন সত্তা আছে, জ্ঞাতা জানুক বা না জানুক জ্ঞেয় বস্তু স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল তাকে বাস্তববাদ বা (Realism) বলে। বাস্তববাদ অনুসারে বস্তু জ্ঞানের বিষয় হতে পারে তাই বলে বস্তুর অস্তিত্ব জ্ঞাতা বা জ্ঞাতার মনের ওপর নির্ভর করে না বরং জ্ঞাতার যেমন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে, তেমনি জ্ঞেয় বস্তুরও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে। এ মতবাদ অনুসারে জ্ঞান হলাে জ্ঞাতার সাথে জ্ঞান নিরপেক্ষ বস্তুর সম্পর্কবিশেষ জ্ঞেয় বস্তুর অস্তিত্ব জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল নয়। বস্তুর মননিরপেক্ষ সত্তা সম্পর্কে আমাদের প্রত্যয় এতই দৃঢ় যে, মনের বাইরে বস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আমরা মন হতে ঝেড়ে ফেলতে পারি না। সকল বস্তুবাদী এ বিষয়ে একমত যে, পাহাড়, পর্বত, নদ-নদী, সাগর, মেঘ, তারকা, জড় পদার্থ ইত্যাদি বস্তুর বিভিন্ন গুণাবলি মননিরপেক্ষ। এদের অস্তিত্ব জ্ঞাতার ওপর নির্ভরশীল নয়। অর্থাৎ বস্তসত্তা জ্ঞাননিরপেক্ষ। প্রত্যক্ষণের মাধ্যমেই বস্তুর স্বরূপ ও গুণাবলি সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। বাস্তববাদীরা তাদের মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিম্নলিখিত যুক্তিগুলাে তুলে ধরেছেন-
(১) যথার্থ জ্ঞান যখন জ্ঞাতা, জ্ঞেয় বস্তুর অস্তিত্বের ওপর নির্ভর করে তখন জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বস্তু নামে দু’টি পৃথক সত্তার অস্তিত্ব স্বাভাবিকভাবে স্বীকার করতে হয়। সুতরাং, জ্ঞেয় বস্তুর জ্ঞাননিরপেক্ষ স্বতন্ত্র সত্তা আছে; যার অভাবে যথার্থ জ্ঞান হয় না।
(২) জ্ঞান জ্ঞেয় বস্তু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কিন্তু জ্ঞেয় বস্তু জ্ঞানের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ নয়। কাজেই জ্ঞান ছাড়াও জ্ঞেয় বস্তু থাকতে পারে।
(৩) বাস্তববাদীদের মতে, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বস্তুর সম্পর্ক বাহ্য সম্পর্ক। এ বাহ্য সম্পর্কই জ্ঞেয় বস্তুর জ্ঞাননিরপেক্ষ স্বতন্ত্র অস্তিত্ব প্রমাণ করে।
বাস্তববাদের প্রকারভেদঃ বাস্তববাদকে প্রধানত চার শ্রেণিতে ভাগ করা যায়; যথা- (১) সরল বা লৌকিক বাস্তববাদ, (২) বিজ্ঞানসম্মত বা সবিচার বাস্তববাদ বা প্রতীকবাদ, (৩) নব্য বস্তবাদ বা বাস্তববাদ, (৪) নব্য সবিচার বাস্তববাদ। আমাদের আলােচ্য প্রশ্নানুসারে নিম্নে নব্য বাস্তববাদের বিস্তারিত আলােচনা করা হলাে-
নব্য বাস্তববাদঃ আমরা জানি দর্শনের যাত্রা শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ছয় শতকে। সেখান থেকে দর্শন বিভিন্ন সীমা অতিক্রম করে দার্শনিক হেগেল পর্যন্ত পৌঁছে। হেগেলের দ্বান্দ্বিক ভাববাদকে ঘিরে আবার দর্শন বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আধুনিককালের একদল দার্শনিক বস্তুবাদের পতাকা নিয়ে প্রতীকবাদ এবং হেগেলের পরব্রহ্মবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন এবং এরা সকল প্রকার ভাববাদকেও চ্যালেঞ্জ করলেন। দর্শনের ইতিহাসে এরা নব্য বাস্তববাদী নামে পরিচিত। মার্কিন দার্শনিক হােল্ট, মার্ভিন, মন্টেগু, পেরি, স্পর্ডিং ও পিটুনিক প্রমুখ দার্শনিক এ আন্দোলনের স্রষ্টা। ব্রিটিশ দার্শনিক মুর, রাসেল, আলেকজান্ডার নানা দিক থেকে এ আন্দোলনের সমর্থক। কিন্তু আমেরিকা ও ব্রিটিশ দার্শনিকদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে মতবিরােধ দেখা দেয়।
নব্য বাস্তববাদের ব্যাখ্যাঃ ১৯১২ সালে আমেরিকার কয়েকজন দার্শনিক নব্য বাস্তববাদ প্রকাশ করেন। নব্য বাস্তববাদ লৌকিক বাস্তবাদের সাথে মিলে যায়। এ মতের বিভিন্ন বিষয় নিচে পেশ করা হলাে-
বস্তুকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করা যায়ঃ এ মতবাদের সমর্থকরা বলেন, বহির্জগতের বস্তুগুলােকে সরাসরি মন দ্বারা প্রত্যক্ষ করা যায়। এদেরকে ধারণার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করা যায় না, বস্তু প্রতিকৃতি বা প্রতীক নয়। বহির্জগতের বস্তকে মনাতিরিক্ত বস্তুসত্তা হিসেবে সরাসরি প্রত্যক্ষ করা যায়। নব্য বাস্তববাদীরা সাক্ষাৎ বাস্তববাদে বিশ্বাসী। তারা সরাসরি প্রত্যক্ষণে বিশ্বাসী। স্ব-মাধ্যমে প্রত্যক্ষণে তারা বিশ্বাস করেন না। তারা ডেকার্ট ও লকের প্রতীক প্রত্যক্ষণকে অস্বীকার করেন। তারা জ্ঞানের দ্বৈতবাদ স্বীকার করেন না।
মুখ্য ও গৌণ গুণঃ মুখ্য, গৌণ এবং সুন্দর, অসুন্দর গুণগুলাে সত্য, মনাতিরিক্ত ও বস্তুনির্ভর। এরা ব্যক্তি মনের ধারণা নয়। সুতরাং নব্য বাস্তববাদের সাথে একমত।
সত্তা মননির্ভরঃ নব্য বাস্তববাদীরা মনে করেন, বহির্জগতের বস্তসমূহের সত্তা মননির্ভর নয়। এরা সসীম এবং অসীম মনাতিরিক্ত। নব্য বাস্তববাদ আত্মগত এবং বস্তুগত উভয় প্রকার ভাববাদকে অস্বীকার করে। এমতানুসারে জ্ঞান বস্তুর স্বতন্ত্রতার পরিবর্তন ঘটায় না। জ্ঞানের সম্পর্ক বহিঃসম্পর্ক। জ্ঞান জ্ঞেয় বস্তুর প্রকৃতিকে পরিবর্তন করে না। জ্ঞান ও জ্ঞেয় বস্তুর একটা বহিঃসম্পর্ক আছে।
নিরপেক্ষ একত্ববাদঃ নব্য বাস্তববাদীদের মতে, জড় হলাে নিরপেক্ষ পদার্থ, যা এক পরিপ্রেক্ষিতে জড় বা ভােতক এবং অন্য পরিপ্রেক্ষিতে চেতনা বা মানসিক রূপে প্রতীয়মান হয়। কাজেই যেকোনাে বিষয়ই মন বা জাগতিক বিষয়ের একটি মাত্র অংশ।
মানসিক বিষয়াবলিঃ নব্য বাস্তববাদীরা ভুল, প্রমাদ, স্বপ্ন, অভ্যাস, অমূল প্রত্যক্ষণ প্রভৃতিকেও মননির্ভর বলে মনে করেন না। এগুলাে সত্য হলেও মননিরপেক্ষ বাস্তব সত্তা আছে।
বুদ্ধির প্রাধান্যঃ নব্য বাস্তববাদীরা মনে করেন বুদ্ধি, বিচার-বিশ্লেষণবাদী মতবাদ। এ মতবাদ জগতের বুদ্ধিগ্রাহ্য আলােচনায় বিশ্বাসী। বুদ্ধিই জগৎকে বুঝতে পারে। বুদ্ধি দ্বারা বিশ্লেষণই একমাত্র দার্শনিক আলােচনা পদ্ধতি।
সমালােচনাঃ নব্য বাস্তববাদীরা ভাববাদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ করেছেন তা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে যায়। এগুলাে নিচে আলােচনা করা হলাে।
ভ্রান্ত অজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করে নাঃ নব্য বাস্তববাদীরা ভ্রান্ত জ্ঞানকে যথার্থভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। স্বপ্ন, ভুল এবং আমূল প্রত্যক্ষণের বাস্তব অস্তিত্ব স্বীকার করা চলে না। এগুলাে যে মনের বাইরে নয় তার বড় প্রমাণ এগুলাের অস্তিত্ব মনের বাইরে বাহ্যজগতে দেখা যায় না। ব্যক্তিবিশেষ এগুলাে ভিন্ন ভিন্ন রূপ গ্রহণ করে।
এটা দুর্বোধ্যঃ সার্বিক নিয়ম, পরম মূল্য প্রভৃতি এবং শুদ্ধসত্তার বিষয়বস্তু দুর্বোধ্য। মনের বা চেতনার সাথে এদের কোনাে সম্পর্ক নেই একথা বললে এদের ব্যাখ্যা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
সম্পর্ক বাহ্য নয়ঃ নব্য বাস্তববাদীরা বলেন, সব সম্পর্কই বাহ্য এটা ঠিক নয়, অন্তর সম্পর্কও আছে। দেশ, কাল, জড় একে অন্যের সাথে রয়েছে। এরা একটা অখণ্ডতার বা সমগ্রতার সৃষ্টি করে। এরাই বস্তুজগতের আদি উপাদান। এদের মধ্যে অন্তর সম্পর্কও আছে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, যদিও নব্য বাস্তববাদের বিভিন্ন সমালােচনা রয়েছে, তবুও এর বাস্তব মল্য অপরিসীম। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে এসে নব্য বাস্তববাদের উদ্ভব। এ মতবাদ হেগেলের ভাববাদের বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহ। বর্তমান প্রগতির যুগে ভাববাদের প্রয়ােগ নেই বললেই চলে। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে নব্য বাস্তববাদ বস্তুবাদী চিন্তায় এক নবজাগরণের সূত্রপাত করে। ভাববাদী চিন্তাকে খণ্ডন করে বাস্তববাদী তত্ত্বই সর্বপ্রথম প্রমাণ করে যে জ্ঞান ক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে না। সার্বিকভাবে বিচার করলে এ মতবাদের মূল্য অপরিসীম।
Leave a comment