প্রশ্নঃ সত্যসম্পর্কীয় মতবাদ হিসেবে অনুরূপতাবাদ ও সঙ্গতিবাদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর। তােমার মতে এ দুটো মতবাদের মধ্যে কোনটি বেশি সন্তোষজনক।
অথবা, সত্যবিষয়ক মতবাদ হিসেবে অনরূপতাবাদ সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা কর। সঙ্গতিবাদ থেকে এটি কিভাবে ভিন্ন?
ভূমিকাঃ সত্য হচ্ছে পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে মিল আর মিথ্যা হচ্ছে পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে গরমিল। অন্যভাবেও বলা যায়, অবধারণের সাথে বিষয়বস্তুর অনুরূপতা হলাে সত্যতা। আর অননুরূপতা হলাে ভ্রম। সত্যের প্রকৃতি ও পরীক্ষা সম্পর্কে চারটি মত আছে। যথা-
অনুরূপতাবাদঃ অনুরূপতাবাদ অনুসারে অবধারণের সত্যতা নির্ভর করে ধারণা ও বস্তুর সামঞ্জস্যের ওপর। ধারণার সাথে বস্তুর মিল হলে অবধারণটি সত্য হবে, আর ধারণার সাথে বস্তুর গরমিল হলে অবধারণটি মিথ্যা হবে। যেমন- ‘তেতুল হয় টক’- এ অবধারণটি সত্য। আবার ‘দুধ হয় কালাে’- এ অবধারণটি মিথ্যা। ধারণার সাথে বস্তুর অনুরূপতাই সত্যতা নির্ণয়ের মাপকাঠি। তবে অনুরূপতা শব্দটিকে নিয়ে মতভেদ আছে।
(ক) সরল বস্তুস্বাতন্ত্রবাদীদের মতঃ
১. এদের মতে, বিষয় বা বস্তু সােজাসুজি জানা যায় না। জ্ঞান হওয়ার সময় জ্ঞাত মন ও জ্ঞেয় বস্তুর মাঝখানে কিছুই থাকে না। মানুষের জ্ঞান বাস্তব অবস্থার অনুরূপ হলে তা সত্য হবে এবং অনুরূপ না হলে তা মিথ্যা হবে।
২. এদের মতে, বিষয় বা বস্ত সরাসরি জানা যায় না। ধারণাকেই আমরা সরাসরি জানি। ধারণা বস্তুর প্রতীকবিশেষ। সুতরাং অনুরূপতার অর্থ হচ্ছে প্রতীক বা ধারণার সাথে প্রতীকবস্তুর সাদৃশ্য।
(খ) নব্য বস্তুস্বাতন্ত্রবাদীদের মতঃ এদের মতে, জ্ঞানের বিষয় আর জ্ঞানে কোনাে পার্থক্য নেই। জ্ঞানের বিষয় আর জ্ঞান একই জিনিস। সুতরাং অনুরূপতার অর্থ হচ্ছে, জ্ঞানের সাথে জ্ঞানের বস্তুর সাদৃশ্য।
(গ) বৈচারিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীদের মতঃ এদের মতে, বিষয় সােজাসুজি জানা যায় না। সরাসরি কতগুলাে বিষয়ের প্রভাবই জানা যায়। এই প্রভাবগুলাের নাম অন্তরসত্তা। এখানে অনুরূপতার অর্থ হচ্ছে বস্তুর ধারণার সাথে অন্তরসত্তার মাধ্যমে জ্ঞাত বস্তুর মিল।
সমালােচনাঃ নিম্নে অনুরূপতাবাদের যে সকল ত্রুটি আছে তা তুলে ধরা হলাে-
(১) এ মত অযৌক্তিকঃ অনুরূপতাবাদীদের মতে, বাহ্য বস্তুর সাথে ধারণার মিল হলে অবধারণটি সত্য হয়। কিন্তু বাহ্য বস্তুকে সরাসরি জানা যায় না। কাজেই বাহ্য বস্তুর সাথে ধারণার অনুরূপতা যাচাই করার কোনাে সুযােগ নেই।
(২) অনুরূপতাবাদ অসম্পূর্ণঃ ধারণার অবস্থান হচ্ছে মনের মধ্যে, আর বিষয় ও তার সম্পর্কে অবস্থান হচ্ছে মনের বাইরে বাহ্য বস্তুতে। সুতরাং এ দুটি ভিন্নধর্মী বিষয়ের মধ্যে মিল বা গরমিল পরীক্ষা করার উপায় নেই।
(৩) এ মত বাস্তববাদের মতাে ক্রটিপূর্ণঃ অনুরূপতাবাদ একটি বাস্তববাদী মতবাদ। সুতরাং বাস্তববাদের সমস্ত দোষ এ মতবাদে বিদ্যমান।
(8) সত্যের মানদণ্ড নির্ণয়ঃ সত্যের মানদণ্ড হিসেবে অনুরূপতাবাদ কেবল অভিজ্ঞতার বিষয়ের ক্ষেত্রেই প্রয়ােগ করা যেতে পারে। কিন্তু বিশুদ্ধ গণিতের মতাে অভিজ্ঞতাবাদ নিরপেক্ষ বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করা সম্ভব নয়। সঙ্গতিবাদ ও এই মতবাদ অনুসারে সঙ্গতিই সত্যতা নিরূপণের চাবিকাঠি। কোনাে বচনের সত্য-মিথ্যা নির্ভর করে অন্যান্য বচনের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করার ওপর। অন্যান্য বচনের সাথে কোনাে বচন যখন মিলেমিশে একটি সংবদ্ধ সংহতি গড়ে তুলে তখন সেই বচন সত্য হয়। সঙ্গতিবাদীদের মতে, কোনাে বচনই নিজে নিজে সত্য বা মিথ্যা কিছুই হতে পারে না। ‘সকল জড়বস্তু পৃথিবীর দিকে আকৃষ্ট হয়’- এই বচনটি সত্য। কারণ জড়বস্তু সম্পর্কে আমাদের অন্যান্য জ্ঞানের সাথে এই বচনের তথ্যটি সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু ‘সকল মানুষ সৎ’- এই বাক্যটি মিথ্যা, যেহেতু মানুষ সম্বন্ধে আমাদের এই ধারণা আছে যে সকল মানুষ সৎ নয়। এখানে এই বাক্যের সাথে বাস্তবের কোনাে সঙ্গতি নেই।
অনুরূপতাবাদ ও সঙ্গতিবাদ-এর মধ্যে পার্থক্যঃ নিম্নে অনুরূপতাবাদ ও সঙ্গতিবাদের মধ্যে পার্থক্য আলােচনা করা হলাে-
(১) বাস্তববাদী সব কয়টি মতের দ্বারাই অনুরূপতাবাদকে সমর্থন করা হয়েছে। বাস্তববাদ অনুসারে বাহ্যবস্তুর মননিরপেক্ষ সত্তা আছে। সুতরাং বাহ্যবস্তুর সাথে মনের ধারণার মিল হলেই অবধারণটি সত্য হবে। পক্ষান্তরে সঙ্গতিবাদ বাহ্যবস্তুর মননিরপেক্ষ অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না।
(২) সত্যতা নির্ণয়ের মাপকাঠি অনুরূপতাবাদ অনুসারে ধারণার সাথে বস্তুর অনুরূপতাকে বুঝানাে হয়। সেখানে সঙ্গতিবাদে এক বচনের সাথে অন্যান্য বচনের সঙ্গতির মাধ্যমে দেখানাে হয়।
(৩) অনুরূপতা অনুসারে প্রত্যেক অবধারণের একটি নির্দিষ্ট বিষয় থাকে। অবধারণের সাথে, সে বিষয়ের অনুরূপতা দেখে তার সত্যতা পরিমাপ করা যায়। পক্ষান্তরে সঙ্গতিবাদ অনুসারে অবধারণে কোনাে সত্যতা বিদ্যমান থাকে না। সত্যতা হচ্ছে অবধারণের আগন্তুক গুণ।
(৪) অনুরূপতা বলতে বচনকে বাস্তব অবস্থার প্রতিলিপি বলে মনে করেন অনুরূপতাবাদীরা। অপরপক্ষে সঙ্গতিবাদীরা বচনের আপেক্ষিক সত্যতা এবং আংশিক বা অপূর্ণ সত্যতায় বিশ্বাসী।
(৫) অনুরূপতাবাদীরা অনুরূপতাকে এক এক সম্বন্ধ বলে মনে করেন। পক্ষান্তরে, সঙ্গতিবাদ বচনের অভ্যন্তরীণ সম্বন্ধের ওপর নির্ভরশীল।
কোনটি বেশি সন্তোষজনকঃ অনুরূপতাবাদ ও সঙ্গতিবাদ কোনটাই ত্রুটিমুক্ত মতবাদ নয়। তবুও তুলনামূলকভাবে সঙ্গতিবাদকে বেশি সন্তোষজনক বলা যায়। কেননা, এ মতবাদ অন্যান্য চরম মতবাদকে অস্বীকার করে। এটি সব ধরনের বচনের সত্যতা নিরূপণের একমাত্র মাপকাঠি। গাণিতিক বচনের সত্যতা নিরূপণে এটি সবচেয়ে নির্ভরযােগ্য মানদণ্ড। যুক্তিবিদ্যায় যখন আমরা দু’টি সত্য আশ্রয়বাক্য থেকে বিধিসঙ্গতভাবে সিদ্ধান্ত টানি। তখন সিদ্ধান্তটিও সত্য বলে প্রমাণিত হয়। জ্যামিতিক উপপাদ্যের সত্যতাও আমরা সঙ্গতি মানদণ্ডের আলােকে প্রমাণ করি। তাছাড়া ঐতিহাসিক বা অতীতসংক্রান্ত এমনকি বর্তমানকাল সংক্রান্ত যাবতীয় অভিজ্ঞতানিরপেক্ষ বচনের সত্যতা আমরা এ মানদণ্ডের আলােকেই পরীক্ষা করি। সুতরাং এ মতবাদ নিঃসন্দেহে সত্যসম্পৰ্কীয় অন্য যেকোনাে মতবাদের তুলনায় অধিক গ্রহণযােগ্য।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, অনুরূপতাবাদ ও সঙ্গতিবাদ বিভিন্নভাবে ত্রুটিযুক্ত। তবে অনরূপতাবাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের আপত্তি উত্থাপিত হলেও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার করলে দেখা যায় যে, অনুরূপতাবাদের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। অন্যদিকে সঙ্গতিবাদীরা সত্যতা নিরূপণের জন্য সঙ্গতিকে একমাত্র সন্তোষজনক বা নির্ভরযােগ্য মানদণ্ড বলে মনে করলেও নানা ত্রুটির জন্য এই মতবাদ এককভাবে গ্রহণযােগ্য নয়। তবে গ্রহণযােগ্যতার প্রশ্নে অনুরূপতাবাদ এবং সঙ্গতিবাদের সমন্বয় সত্যতা নিরূপণের নির্ভরযােগ্য মানদণ্ড হতে পারে।
Leave a comment