অথবা, মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযানের একটি বিবরণ দাও।
অথবা, পটভূমিসহ মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযানের ইতিহাস লেখ। এ অভিযানে তার সফলতার কারণ নির্ণয় কর।
উপস্থাপনাঃ ভারত উপমহাদেশে স্থায়ী মুসলিম রাজনৈতিক শক্তি প্রতিষ্ঠার অগ্রনায়ক, গজনী বংশের খ্যাতিমান শাসক মুয়েজুদ্দিন মুহাম্মদ বিন সাম (মুহাম্মাদ ঘুরি বলেও পরিচিত)-এর ঘটনাবহুল রাজত্বকাল সমসাময়িককালের এক উল্লেখযােগ্য অধ্যায়। তার সাফল্যজনক অভিযান ও পদক্ষেপসমূহ ভারতে স্থায়ী মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক নব দিগন্তের সূচনা করেছিল।
মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযানের পটভূমিঃ
১. মুহাম্মদ ঘুরীর উচ্চাভিলাষঃ মুহাম্মদ ঘুরী ছিলেন একজন উচ্চাভিলাষী সাম্রাজ্যবাদী শাসক। ১১৭৩ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরােহণের অব্যবহিত পরেই তিনি স্বীয় ক্ষমতার নিরাপত্তা বিধান করার লক্ষ্যে রাজ্যবিস্তারে মনােনিবেশ করেন। এ উচ্চাকাঙ্ক্ষাই তাকে ভারতবর্ষ আক্রমণে প্রলুব্ধ করেছিল।
২. মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাঃ মুহাম্মদ ঘুরীর ভারতবর্ষে অভিযান পরিচালনার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল স্থায়ী মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। এ উদ্দেশ্যেই তিনি সেনাবাহিনী গঠন করে আক্রমণের পরিবেশ খুঁজতে থাকেন।
৩. ভারতীয় রাজনৈতিক অনৈক্যঃ মুহাম্মদ ঘুরীর আক্রমণের পূর্বে ভারতীয় হিন্দু রাজন্যবর্গের মধ্যে রাজনৈতিক অনৈক্য, দুর্বলতা, অস্থিরতা এবং পারস্পরিক কোন্দল বিরাজ করছিল। তারা পরস্পর কলহ বিবাদে লিপ্ত ছিল। এরূপ অরাজকতাপূর্ণ পরিবেশে মুহাম্মদ ঘুরী ভারতে স্থায়ী সাম্রাজ্য স্থাপনে সাফল্যের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে অভিযান পরিচালনা করতে প্রলুব্ধ হন।
৪. ধন ঐশ্বর্যঃ ঐতিহাসিক ভিডি মহাজন বলেন, ভারতবর্ষের অগণিত ধন ঐশ্বর্যপ্রাপ্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় এবং ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে মুহাম্মদ ঘুরী উত্তর ভারতে রাজ্যবিস্তারে প্রয়াসী হন।
মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযানঃ
১. মুলতান বিজয়ঃ মুহাম্মদ ঘুরী ১৯৭৫ সালে মুলতানে তার প্রথম অভিযান চালিয়ে তথাকার শাসক কারামতিয়াকে সহজেই পরাজিত করে মুলতান অধিকার করেন এবং সেখানে একজন নতুন শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।
২. উচ রাজ্য বিজয়ঃ মুলতান বিজয়ের পর মুহাম্মদ ঘুরী ১১৭৬ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধুর ভাদ্রি রাজাদের রাজ্য উচ আক্রমণ করে তা দখল করেন। উচ বিজয়ের ফলে পরবর্তীকালে সিন্ধু দেশ জয় করার সুযােগ সৃষ্টি হয়। .
৩. গুজরাট বিপর্যয়ঃ উচ বিজিত হলে ১১৭৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি গুজরাটের রাজধানী আনহিল ওয়ারের বিরুদ্ধে আক্রমণ করে রাজা দ্বিতীয় ভীমের নিকট পরাজিত হন এবং যুদ্ধকৌশল পরিবর্তন করে খাইবার গিরিপথ দিয়ে ভারত আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন।
৪. পাঞ্জাব বিজয়ঃ ১১৭৯ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ ঘুরী খাইবার গিরিপথ দিয়ে পেশােয়ার আক্রমণ করে তা দখল করেন। এরপর ১১৮২ খ্রিস্টাব্দে গজনী বংশের শেষ রাজা খসরু মালিককে পরাজিত করে পাঞ্জাব অধিকার করেন।
৫. সিন্ধু অঞ্চল বিজয়ঃ ১১৮২ খ্রিস্টাব্দে দেবল নগরী দখল করে সিন্ধু প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চল ঘুরী রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। খসরু মালিক শিয়াল কোট, অবরােধ করলে ১১৮৬ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ ঘুরী লাহাের অধিকার করেন। খসরু পরাজিত এবং বন্দি হলে তাকে গজনী হতে অপসারণ করা হয়।
৬. তরাইনের প্রথম যুদ্ধঃ পাঞ্জাবে আধিপত্য বিস্তারের পর মুহাম্মদ ঘুরীকে বিভিন্ন কারণে দিল্লী ও আজমীরের চৌহান রাজা পৃথ্বিরাজের সাথে সংঘর্ষে জড়াতে হয়। ফলে ১১৯১ খ্রিস্টাব্দে কৰ্ণাট ও থানেশ্বরের মধ্যবর্তী তরাইন নামক স্থানে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে মুহাম্মদ ঘুরী পরাজিত ও আহত হয়ে গজনীতে ফিরে যান।
৭. তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধঃ তরাইনের প্রথম যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ঘুরী গজনীতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে ১ লাখ ২০ হাজার সুসজ্জিত সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে পুনরায় পৃথ্বিরাজের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। পৃথ্বিরাজের সৈন্য সংখ্যা ছিল তিন লক্ষ। তরাইন প্রান্তরে উভয়ের মধ্যে তুমুল যুদ্ধের পর পৃথ্বিরাজ শােচনীয়ভাবে পরাজিত হন। এ যুদ্ধে পৃথ্বিরাজ ও গােবিন্দসহ অনেক হিন্দু রাজা নিহত হয়। ফলে ভারতে মুসলিম সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপিত হয়। ঐতিহাসিক আর. সি. মজুমদার বলেন The victory of Muhammad Ghuri was decisive, it lid the foundation of Muslim dominion in Northern India.
৮. হানসী, সামানা ও আজমীর জয়ঃ তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বিরাজের পরাজয়ের সুযােগে মুহাম্মদ ঘুরী হিন্দু রাজাদের নিকট হতে হানসী, সামানা, সরস্বতী, কোহরাম, আজমীর প্রভৃতি অঞ্চল অধিকার করে এসব অঞ্চলের দায়িত্ব তার সুযােগ্য সেনাপতি কুতুবুদ্দিন আইবেকের ওপর ন্যস্ত করে তিনি গজনীতে প্রত্যাবর্তন করেন।
৯. মিরাট, কোহল ও দিল্লী অধিকারঃ ঐতিহাসিক ফিরিশতা বলেন, উত্তর ভারতের অধিকৃত অঞ্চলে মুহাম্মদ ঘুরীর নিযুক্ত শাসক কুতুবুদ্দিন আইবেক ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে মিরাট, ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে কোহল এবং দিল্লী জয় করেন। এরপর রাজধানী লাহাের থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত করেন।
১০. কনৌজ জয়ঃ ১১৯৪ খ্রিস্টাব্দে ঘুরী কনৌজরাজ জয়চাঁদকে দমন করার জন্য অভিযান পরিচালনা করে তাকে পরাজিত করে কনৌজ জয় করেন।
১১. বারানসী জয়ঃ ড. হাবিবুল্লাহ বলেন, কনৌজ জয়ের পর বিজয়ী মুসলিম বাহিনী আরাে অগ্রসর হয়ে ভারতের ধর্মীয় রাজধানী বারানসী দখল করে।
১২. গুজরাট, গােয়ালিয়র, বিয়ানা ও বাদায়ুন জয়ঃ কুতুবুদ্দিন আইবেক ১১৯৬ খ্রিস্টাব্দে গােয়ালিয়র এবং ১১৯৭ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের রাজা দ্বিতীয় ভীম দেবকে রিদোহীদের সহায়তা করার অপরাধে হত্যা করে রাজধানী আনহিলওয়ার অধিকার করেন। পরবর্তীকালে গােয়ালিয়র, বিয়ানা ও বাদায়ুনে মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৩. কালিঞ্জর জয়ঃ ১২০২ খ্রিস্টাব্দে কুতুবুদ্দিন আইবেক বুন্দেলখণ্ডের চান্দেলারাজ পরমার্দী দেবের রাজধানী কালিঞ্জর আক্রমণ করেন। সুরক্ষিত চান্দেলার দুর্গ মুসলমানদের হস্তগত হয় এবং এর ফলে কালীঞ্জর ঘাের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৪. বিহার ও বাংলা জয়ঃ ড. হাবিবুল্লাহ বলেন, কুতুবুদ্দিন যখন ভারত জয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তখন তার সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী, ১১০০ খ্রিস্টাব্দে বিহার এবং ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে লক্ষণ সেনের রাজধানী নদীয়া আক্রমণ পূর্বক বাংলা জয় করে ঘুরী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন।
১৫. খােকারদের দমনঃ পাঞ্জাবের খােকার উপজাতি ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ ঘুরীর আনুগত্য অস্বীকার করে স্বাধীনতা ঘােষণা করলে তাদের সঙ্গে ঘুরীর যুদ্ধ বাধে। এ যুদ্ধে ঘুরী সহজেই তাদের পরাজিত করেন, কিন্তু গজনী প্রত্যাবর্তনের পথে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি আততায়ী আলী মর্দান কর্তৃক নিহত হন।
মুহাম্মদ ঘুরীর সাফল্যের কারণঃ
১. আদর্শগত পার্থক্যঃ মুসলমানদের সাফল্যের একমাত্র কারণ ইসলামী জীবনাদর্শ। তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক অনৈক্য এবং রাজন্যবর্গের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ তাদের শতধাবিভক্ত করে রেখেছিল। ভি. ডি. মহাজন বলেন- A very important cause of Muslim success and Hindu failure was the lack of political unity in the country.
২. মুসলিম সংঘবদ্ধ বাহিনীঃ রাজনৈতিক অনৈক্য, গােত্র কলহ, বর্ণ প্রথা ইত্যাদির কারণে ভারতে সংঘবদ্ধ সৈন্যবাহিনী গড়ে উঠেনি। ফলে তারা ইস্পাত কঠিন সুদৃঢ় মুসলিম বাহিনীর সামনে টিকে থাকতে পারেনি।
৩. তড়িৎ গতিতে যুদ্ধ পরিচালনাঃ যুগােপযােগী অশ্ববাহিনী ছিল মুসলমানদের সাফল্যের অন্যতম কারণ। কেননা হস্তিবাহিনীর চেয়ে অশ্বারােহী বাহিনীর গতি দ্রুততর ও কার্যকর। তাই হিন্দুদের হস্তিবাহিনী মুসলমানদের অশ্ববাহিনীর সম্মুখে টিকতে পারেনি।
৪. ইসলামী অভেদনীতিঃ মুসলমানদের মধ্যে ক্রীতদাস শ্রেণিও তাদের প্রতিভাবলে রাজক্ষমতা লাভ করতে পারত। তাই তারা দক্ষতা ও নৈপুণ্য অর্জনের জন্য যথাসাধ্য প্রাণপণে যুদ্ধ করে প্রভুর মন জয় করতে সচেষ্ট থাকত। এটাই মুহাম্মদ ঘুরীর সাফল্যের পেছনে কাজ করেছিল। কেননা তৎকালে একাধিক সুদক্ষ ক্রীতদাস শাসক ও সেনাপতির উত্থান ঘটে।
৫. ধর্মীয় প্রেরণাঃ মুসলমানদের ধর্মীয় প্রেরণাও মুহাম্মদ ঘুরীর বিজয়ে সাহায্য করেছিল। প্রতিটি অভিযানেই ধর্মীয় উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে মুসলিম বাহিনী যুদ্ধ করে।
৬. যােগ্য নেতৃত্বঃ যােগ্য নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী পরিচালিত হয়েছে বলে অতি সহজেই ঘুরী অপেক্ষাকৃত দুর্বল বাহিনীর ওপর বিজয় লাভ করতে সক্ষম হন।
৭. সামরিক অযােগ্যতাঃ মুহাম্মদ ঘুরীর সফলতার অন্যতম একটি কারণ ছিল ভারতীয়দের সামরিক অযােগ্যতা। তাদের সামরিক পদ্ধতি ছিল প্রাচীন ও ত্রুটিপূর্ণ। অন্যদিকে মুসলমানদের সামরিক পদ্ধতি ছিল আধুনিক ও যুগােপযােগী উন্নত মানের। ফলে তারা মুসলিম বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়।
৮. হিন্দুদের জাতিভেদ প্রথাঃ হিন্দুদের গােত্রীয় কলহ ও বিদ্বেষের ফলে তাদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। তাদের এ জাতিভেদ প্রথাই মুসলিম বাহিনীর বিজয়ের পথ সুগম করেছিল।
৯. জনসমর্থনের অভাবঃ হিন্দু রাজন্যবর্গ জনগণের কোনাে সাহায্য সহযােগিতা কিংবা কোনাে ধরনের সমর্থন লাভ করতে পারেনি। তারা তাদের রাজন্যবর্গের বিরােধিতা করে মুসলিম অভিযানকে স্বাগত জানিয়েছিল।
১০. কেন্দ্রীয় শক্তির উপস্থিতিঃ রাজপুত শাসনে সমস্ত প্রথার প্রভাব হিন্দুদের সামরিক শক্তির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছিল। ফলে তাদের মধ্যে একক অধিনায়কত্ব গড়ে উঠতে পারেনি। পক্ষান্তরে মুসলমানরা তাওহীদের মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে একক অধিনায়কত্বে পরিচালিত একটি শীসাঢালা প্রাচীরস্বরূপ ছিল। আর এ শীসাঢালা ঐক্য তাদের বিজয়কে তুরান্বিত করেছিল।
উপসংহারঃ অদম্য সাহস, অসীম ধৈর্য এবং উন্নত যুদ্ধ কৌশলে বিজিত এলাকাসমূহে সষ্ঠ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মহাম্মদ ঘুরী এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই ভারতের ইতিহাসে ঘুরী মুসলিম সাম্রাজ্যের এই হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ড. এ বি এম, হাবিবুল্লাহ বলেন- There could be no two opinion’s as to the place Muizuddin should occupy in history.
Leave a comment