প্রশ্নঃ সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর শাসন সংস্কারগুলাে বর্ণনা কর।

উপস্থাপনাঃ ভারতবর্ষের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী শুধু রাজ্য বিজেতাই ছিলেন না, তিনি একজন যােগ্য শাসকও ছিলেন। ঐতিহাসিক কে, এস, লাল বলেন, সম্ভবত ভারতবর্ষের ইতিহাসে তিনিই সর্বপ্রথম মুসলিম শাসক, যিনি শাসনকার্য পরিচালনার জন্য কতগুলাে সুশৃঙ্খল নীতি নির্ধারণ করেন।

আলাউদ্দিন খিলজীর শাসন সংস্কারঃ

১. স্বৈরতান্ত্রিক শাসনঃ সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর শাসনব্যবস্থা ছিল স্বৈরতান্ত্রিক। তিনি রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর কিংবা জরুরি অবস্থার জন্য উপযােগী যে কোনাে আইন প্রয়ােগ করতেন। সেক্ষেত্রে তিনি সঙ্গত ও অসঙ্গতের ব্যাপারে কোনাে বিবেচনায় যেতেন না। তিনি সকল বিরােধী শক্তির প্রভাব কঠোর হস্তে দমন করে নিজের সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

২. শক্তিশালী শাসন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাঃ আলাউদ্দিন খিলজী বিভিন্ন আদেশ নির্দেশের মাধ্যমে আমীর ওমরাদের কর্তৃত্ব খর্ব করে স্বীয় শাসন কর্তৃত্ব শক্তিশালী করেন। অভিজাত সম্প্রদায়ের মালিক ও আমীরদের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য তাদের ধন সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেন। এছাড়া তাদের অনেককেই কারাগারে বন্দি করে অন্ধ করে দেয়া বা হত্যা করা হয়।

৩. শাসন সংস্কারঃ আলাউদ্দিন খিলজী শক্তিশালী রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি স্বেচ্ছাচারী শাসন কায়েম করেন, তবে তাকে ভারতে সুশৃঙ্খল মুসলিম শাসন ব্যবস্থার অগ্রদূত বলা যায়।

৪. ধর্মনিরপেক্ষ শাসন প্রবর্তনঃ ভারতীয় মুসলিম শাসকদের মধ্যে আলাউদ্দিন খিলজীই সর্বপ্রথম ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন। শাসন বিষয়ে তিনি আলেম ওলামাদের কর্তৃত্ব অস্বীকার করেন। স্বীয় বাস্তবধর্মী বুদ্ধির বলে তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তবে নিজ স্বার্থে বিনা দ্বিধায় তিনি ইসলামের কোনাে বিধান লঙ্ঘন করতেন না। কারণ তিনি ব্যক্তিগত জীবনে ধার্মিক ছিলেন।

৫. একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠাঃ আলাউদ্দিন খিলজী কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থায় একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি শাসনব্যবস্থার সকল ক্ষমতা নিজ হাতে তুলে নেন এবং শক্তিশালী একনায়ক কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।

৬. সার্বভৌমত্বের ধারণাঃ তিনি তার শাসনব্যবস্থায় সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি মনে করতেন, সুলতানই সর্বময় ক্ষমতার উৎস এবং তার আদেশই আইন বলে গণ্য হবে। তিনি আরাে মনে করতেন, সুলতানের কার্যে কারাে হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই।

৭. বিদ্রোহের কারণ চিহ্নিতকরণঃ আলাউদ্দিন খিলজী শাসন ক্ষমতায় আসার পূর্বে অভিজাত ও আমীরগণ ঘন ঘন বিদ্রোহ করতেন। তিনি বিদ্রোহের কারণ অনুসন্ধানে গভীর চিন্তা ভাবনা ও উপদেষ্টাদের সাথে মতবিনিময় করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, বিদ্রোহের মূলে ৪টি কারণ রয়েছে। যথা- (ক) রাষ্ট্রীয় শাসনকার্যে সুলতানের অমনােযোগিতা, (খ) অভিজাত সম্প্রদায় বা আমীর ওমরাদের পারস্পরিক আত্মীয়তা ও সামাজিক মেলামেশা, (গ) সম্পদের প্রাচুর্য ও (ঘ) সমাজে অত্যধিক মদ্যপানের প্রভাব।

৮. বিদ্রোহ প্রতিরােধে কার্যকর ব্যবস্থাঃ আলাউদ্দিন খিলজী কেবল বিদ্রোহের কারণ উদঘাটন করেই ক্ষান্ত হননি; বরং বিদ্রোহ দমনের দিকেও মনােনিবেশ করেন। তিনি বিদ্রোহ দমনে নিম্নোক্ত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করেন-

ক. শাসন বিষয়ে অমনােযােগিতা দূর করতে প্রশাসনের সর্বস্তরে সুলতান তীক্ষ দৃষ্টি রাখা শুরু করেন।

খ.. খাসমহলে নৃত্যগীত ও আমােদ প্রমােদের ব্যবস্থা কমিয়ে দেন।

গ. আমীরদের পারস্পরিক আত্মীয়তা, পারিবারিক সংযােগ ও সামাজিক বৈঠক পূর্বাহ্নে করতে হলে সুলতানের অনুমতি নিতে হবে।

ঘ. সুলতান মদ্যপানসহ মাদকদ্রব্যের ব্যবহার এবং ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করেন। তিনি স্বয়ং মদ্যপান ত্যাগ করে পানপাত্র ভেঙ্গে ফেলেন।

ঙ. অভিজাত ও সম্পদশালী হিন্দুদের দৌরাত্ম খর্ব করার জন্য তাদের অতিরিক্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেন।

চ. বহুসংখ্যক গুপ্তচর নিয়ােগ করে সাম্রাজ্যের সর্বত্র কোথায় কী ঘটছে তার সংবাদ সংগ্রহের ব্যবস্থাও তিনি করেন।

ছ. গুপ্তচরদের প্রদত্ত রিপাের্টে আমীর, অভিজাতরা কোনাে সন্দেহজনক কার্যে লিপ্ত আছেন জানতে পারলে তিনি তাদের সমুচিত শাস্তিদানের ব্যবস্থা করতেন।

৯. রাজস্ব সংস্কারঃ আলাউদ্দিন খিলজীর শাসনব্যবস্থায় রাজস্ব সংস্কার ছিল অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংস্কার। তার রাজস্ব সংস্কার ছিল নিম্নরূপ-

ক তিনিই সর্বপ্রথম ভূমি জরিপের ব্যবস্থা করেন, যা পরবর্তীতে শের শাহ অনুসরণ করেন।

খ. অভিজাত ও সরকারি কর্মচারীদের দানকৃত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন।

গ. অপ্রয়ােজনীয় বৃত্তি, ভাতা ও জায়গির প্রথা বন্ধ করে দেন।

ঘ. করমুক্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে কর নির্ধারণ করেন।

ঙ. মুসলমানদের আয়ের ২১% যাকাত দিতে বাধ্য করেন।

চ. যুদ্ধক্ষম অমুসলিমদের ওপর জিযিয়া আরােপ করেন।

ছ. যুদ্ধ লুণ্ঠিত সম্পদের ই অংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করতেন।

জ. ভূমির পরিবর্তে রাজ কর্মচারীদের নগদ বেতন পদ্ধতি চালু করেন।

ঝ. ভূমির উর্বরতা অনুসারে খারাজ ধার্য করেন।

১০. সামরিক সংস্কারঃ অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন, ক্রমাগত মােঙ্গল হামলার হুমকির মােকাবেলা এবং রাজ্য বিস্তারের প্রয়ােজনে সুলতান বিরাট স্থায়ী সামরিক বাহিনী গঠন করেন। তার সামরিক সংস্কারের উল্লেখযােগ্য দিক হলাে-

ক. জায়গির প্রথা রহিত করে নগদ বেতন প্রথা চালুকরণ।

খ. ঘােড়া,ক্রয়ের ব্যাপারে সেনাবাহিনীর প্রতারণা দূর করার জন্য ঘােড়ার দাগের ব্যবস্থাকরণ।

গ. সৈন্যদের বিস্তারিত বিবরণী বা রেজিস্টার রাখার প্রথা চালু করেন।

ঘ. সৈনিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।

ঙ. সামরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য নতুন নতুন সামরিক ঘাঁটি স্থাপন ইত্যাদি।

১১. অর্থনৈতিক সংস্কারঃ আলাউদ্দিন খিলজীর শাসনব্যবস্থার শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব হলাে তার অর্থনৈতিক সংস্কার। তার অর্থনৈতিক সংস্কারের উল্লেখযােগ্য দিক হলাে-

ক. নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ।

খ. রাজস্ব হিসেবে উৎপাদিত ফসল আদায় ও গুদামজাত করে প্রয়ােজনের সময় বাজারে সরবরাহ নিশ্চিতকরণ।

গ, ব্যবসায়ে প্রতারণা ও শঠতা প্রতিরােধে তদারককারী নিয়োগ।

ঘ. খাদ্য মজুদ নিষিদ্ধকরণ।

ঙ. খাদ্যদ্রব্য ও শস্যের মূল্য নির্ধারণ। এজন্য ঐতিহাসিক লেনপুল তাকে মহান রাজনীতিক ও অর্থনীতিবিদ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

উপসংহারঃ আলাউদ্দিন খিলজী শাসন ক্ষেত্রে যে মৌলিকত্বের পরিচয় দিয়েছেন তাতে তাকে সন্দেহাতীতভাবে প্রাক-মুঘল যুগে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ সুলতান বলা যায়।