প্রশ্নঃ তুঘলক বংশের পতনের কারণসমূহ আলােচনা কর।

অথবা, তুঘলক বংশের পতন কিভাবে হয়েছিল তা বর্ণনা কর।

উপস্থাপনাঃ ভারত উপমহাদেশে মুসলিম শাসনব্যবস্থার ইতিহাসে তুঘলক বংশের শাসনকাল একটি স্মরণীয় অধ্যায়। খিলজী শাসক বংশের অবসান ঘটিয়ে সুলতান গিয়াসুদ্দিন তুঘলক ১৩২০ সালে তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। এ বংশের মােট নয় জন সুলতান ৯৩ বছর ভারত উপমহাদেশে শাসনকার্য পরিচালনা করেন, কিন্তু। এতদসত্ত্বেও ইতিহাসের নির্মম পরিহাস তুঘলক বংশকে রেহাই দেয়নি, ফলে তাদের পতন ঘটে।

তুঘলক বংশের পতনের কারণঃ

১. মুহাম্মদ বিন তুঘলকের পরিকল্পনার ব্যর্থতাঃ তুঘলক বংশের পতনের জন্য মুহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজধানী স্থানান্তর, প্রতীকী মুদ্রা প্রচলন, দোয়াব অঞ্চলে কৃষি কর বৃদ্ধি, খােরাসান ও কারাচিল অভিযান ইত্যাদি মহাপরিকল্পনা এবং সেগুলাে বাস্তবায়নের ব্যর্থতা অনেকাংশে দায়ী।

২. রাজকোষের শূন্যতাঃ মুহাম্মদ বিন তুঘলকের অবাস্তব মহাপরিকল্পনা গ্রহণের ফলে রাজকোষের প্রচুর অর্থের অপচয় ঘটে এবং জনগণের কাছে তিনি অপ্রিয় হয়ে ওঠেন। অপরদিকে ফিরােজ শাহ তুঘলক সিংহাসনে আরােহণের পর বিভিন্ন কর রহিত করে দেন এবং বিশাল ক্রীতদাস বাহিনীর ভরণ-পােষণের ফলে রাজ্যের কোষাগার শূন্য হয়ে যায়। এ শূন্যতাই তুঘলক বংশের বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। ঐতিহাসিক শামসে শিরাজ আফিফের মতে- The treasury was at a very low ebb.

৩. কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতাঃ ফিরােজ শাহ তুঘলক কর্তৃক জায়গির প্রথার পুনঃ প্রবর্তন, উত্তরাধিকারসূত্রে সেনাবাহিনীতে পদলাভের ব্যবস্থা, ক্রীতদাসদের ভরণ পােষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান ইত্যাদির ফলে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে, ফলে তুঘলক বংশের বিপর্যয় ঘটে।

৪. শাসকবর্গের দুর্বলতাঃ ফিরােজ শাহ তুঘলক কিংবা তার দুর্বল উত্তরাধিকারীগণ কেউই পূর্ববর্তী সুলতানদের আমলের হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারে তৎপরতা প্রদর্শন করেনি। বস্তুত পরবর্তী শাসকদের দুর্বলতা, আত্মকলহ ও ভােগবিলাসে লিপ্ত থাকার ফলে তুঘলক বংশের পতন ঘটে।

৫. সাম্রাজ্যের বিশালতা ও কেন্দ্রবিমুখ প্রবণতাঃ মুহাম্মদ বিন তুঘলকের শাসনামলে তুঘলক সাম্রাজ্য শুধু সমগ্র উত্তর ভারতেই নয়, দক্ষিণ ভারতেও বিস্তৃত হয়ে পড়ে। তার বিশাল বিস্তৃত সাম্রাজ্য ২৩টি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। তখনকার অনুন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থায় এ বিশাল বিস্তৃত সাম্রাজ্য রক্ষা সহজসাধ্য ছিল না। এছাড়া দূরবর্তী অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা দেখা দিলে সময়মতাে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হতাে না। তাই সাম্রাজ্যের বিশালতা ও কেন্দ্রবিমুখ প্রবণতা তুঘলক সাম্রাজ্য পতনের অন্যতম কারণ হয়ে দেখা দেয়।

৬. হিন্দু ও অসুন্নী মুসলমানদের আনুগত্যহীনতাঃ তুঘলক বংশের শাসকগণ ধর্মনিরপেক্ষতা বর্জন করে ইসলামী আইন অনুযায়ী রাজ্য পরিচালনার পক্ষপাতী ছিলেন। ফলে হিন্দু সম্প্রদায় এবং অসুন্নী মুসলমানগণ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তুঘলক শাসকদের গৃহীত নীতি মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের এরূপ আনুগত্যহীনতা তুঘলক শাসনের স্থায়িত্বের মূলে কুঠারাঘাত হানে।

৭. সুনির্দিষ্ট উত্তরাধিকার নীতির অভাবঃ সুষ্ঠু ও সুনির্দিষ্ট উত্তরাধিকার নীতি না থাকার কারণে পরবর্তীতে সিংহাসনের অধিকার নিয়ে তুঘলক রাজপরিবার তথা সমগ্র শাসকগােষ্ঠী আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে ফিরােজ শাহের দুর্বল উত্তরাধিকারীরা সিংহাসনকে কেন্দ্র করে বিরােধ, আত্মকলহ ও গৃহযুদ্ধে লিপ্ত থেকে পরবর্তীকালে একটি করুণ এবং বেদনাদায়ক ইতিহাস রচনা করে, যা তুঘলক বংশের পতন ত্বরান্বিত করে।

৮. জনসমর্থনের অভাবঃ তুঘলক শাসন ছিল সমরশক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত এক ধরনের স্বৈরশাসন। এটা জনগণের সদিচ্ছা ও আনুগত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না, কিন্তু পরবর্তীকালে সামরিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে এ স্বৈরশাসনেরও পতন ঘটে।

৯. বিভিন্ন বিদ্রোহঃ ফিরােজ শাহের মৃত্যুর পর বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। হিন্দু সামন্ত রাজা, মুসলিম অভিজাত শ্রেণি কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। কনৌজ থেকে বিহার এমনকি বঙ্গদেশ পর্যন্ত বিশাল এলাকায় অরাজকতা দেখা দেয়। এ পরিস্থিতির সুযােগে জমিদার ও শাসকশ্রেণি স্বাধীনভাবে রাজ্য শাসন করতে থাকে।

১০. দুর্ভিক্ষ ও মহামারীঃ এ সময় প্রায়ই দুর্ভিক্ষ মহামারী দেখা দিত। এসব দুর্ভিক্ষ ও মহামারী তুঘলক বংশকে দুর্বল করে ফেলে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের কর্মক্ষমতা স্থবির করে দেয়। ফলে সাম্রাজ্যের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি হয়।

১১. সুলতানদের বিলাসিতাঃ ফিরােজ শাহের পরবর্তী দুর্বলচিত্ত ও নির্বোধ উত্তরাধিকারীদের পক্ষে সঠিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না। কারণ তারা ছিলেন আরামপ্রিয় ও বিলাসী।

১২. মাত্রাতিরিক্ত উদারতাঃ সুলতান ফিরােজ শাহের মাত্রাতিরিক্ত উদারতাও তুঘলক বংশের পতনের অন্যতম কারণ। তিনি ছিলেন প্রজাবৎসল, ধর্মভীরু, সত্যনিষ্ঠ । তার উদারতার কারণে দেশের সামরিক বাহিনীতে বৃদ্ধ, অক্ষম, আত্মীয় স্বজনরা নিয়ােগ লাভ করে, যা পরবর্তীতে হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়।

১৩. তৈমুর লঙের আক্রমণঃ ফিরােজ শাহের বংশধরগণের গৃহবিবাদ এবং সমগ্র রাজ্যে অরাজকতা, বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে যখন দিল্লী সালতানাতের অস্তিত্ব বিপন্ন প্রায় তখন ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে দুর্ধর্ষ মােঙ্গল বীর তৈমুর লঙ ভারত বর্ষের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ করেন। তার আক্রমণে তুঘলক বংশ লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়।

উপসংহারঃ তুঘলক বংশের শাসন ভারতের ইতিহাসে একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা। এ বংশের ৯ জন শাসক প্রায় ৯৩ বছর দেশ শাসন করেন। তবে তাদের শাসন দেশ ও জনগণের জন্য অকল্যাণকর ছিল। এছাড়া তারা বিদেশি আক্রমণ প্রতিহত করতেও ব্যর্থ হয়, ফলে তুঘলক বংশের পতন ঘটে।