অথবা, লােদী বংশের পতনের কারণগুলাে লেখ।
উপস্থাপনাঃ উত্থান পতনই একটি জাতির চিরন্তন ইতিহাস। সৈয়দ বংশের সর্বশেষ সুলতান আলাউদ্দিন আলম শাহ স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করলে দিল্লীতে এক নতুন লােদী রাজ বংশের শাসন সূচিত হয়। ভারত উপমহাদেশে ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মােট ৭৫ বছরকাল রাজত্ব করার পর মুঘল সম্রাট বাবরের আক্রমণের মধ্য দিয়ে দিল্লী সালতানাতে লােদী বংশের শাসন ক্ষমতার চূড়ান্ত পতন ঘটে।
লােদী বংশের উত্থানঃ
ক. বাহলুল খান লােদী (১৪৫১-১৪৮৯ খ্রি.)
১. সিংহাসনে আরােহণঃ ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, “বাহলুল খান লােদী ছিলেন আফগান জাতির লােদী উপদল সস্তৃত। ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ বংশের সর্বশেষ সুলতান আলম শাহ স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করলে তিনি দিল্লীর সিংহাসনে আরােহণের মাধ্যমে আরেকটি নতুন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনিই দিল্লীর বিখ্যাত লােদী বংশের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট।”
২. কর্মঠ ও বীর শাসকঃ বাহলুল খান লােদী ছিলেন কর্মঠ, দক্ষ ও প্রতিভাবান শাসক। সিংহাসনে আরােহণ করেই তিনি রাজ্যের সকল অরাজকতা, অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা দূর করে দিল্লী রাষ্ট্রের বেদখলকৃত এলাকাগুলাে পুনঃ বিজয়ে দৃঢ় সংকল্প হন। তিনি ক্ষমতায় আরােহণ করে প্রথমেই মন্ত্রী হামিদ খাকে ক্ষমতাচ্যুত করে কারাগারে পুরে নিজেকে তার কুপ্রভাব মুক্ত করেন। এতে তিনি রাজনৈতিক দূরদর্শতার পরিচয় দেন।
৩. সাহসী ও ন্যায়পরায়ণ শাসকঃ বাহলুল খান লােদী ছিলেন সাহসী, চরিত্রবান, ধার্মিক ও ন্যায়পরায়ণ, ন্যায়বিচারক শাসক। তিনি সর্বদাই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। কখনাে শাসক হিসেবে গৌরববােধ করতেন না। ড. আবদুল করিম বলেন, “সামাজিক কার্যসমূহ পরিচালনার সময় সুলতান কখনাে সিংহাসনে বসতেন না এবং কোনাে আমীরকেও দাঁড়িয়ে থাকতে দিতেন না।”
৪. ইতিহাসে তার স্থানঃ প্রশাসন পরিচালনায় দক্ষতা ও চারিত্রিক উৎকর্ষের জন্য বাহলুল খান লােদীকে ফিরােজ শাহ তুঘলকের পরবর্তী শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। তিনি অল্প পরিমাণে হলেও সুলতানী সাম্রাজ্যের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনেন। তিনি বন্ধুত্বের মাধ্যমে আফগানদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করেন এবং কৌশলে বিদ্রোহীদের দমন করেন। শাসক হিসেবেও তিনি ছিলেন উচ্চমানের। ঐতিহাসিক এ. বি. পান্ডে বলেন, “তার রাজকীয় গুণাবলি ছিল উচ্চ মানের।”
৫. মৃত্যুঃ বাহলুল লােদী ১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে গােয়ালিয়র জয় করে দিল্লী প্রত্যাবর্তনের পথে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং জালালী নামক স্থানে মৃত্যুমুখে পতিত হন। তার মৃত্যুর পর তার পুত্রদের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।
খ. সিকান্দার লােদী (১৪৮৯-১৫১৭ খ্রি.)
১. ক্ষমতায় আরােহণঃ ঐতিহাসিক আর. সি. মজুমদার বলেন, “বাহলুল খান লােদীর মৃত্যুর পর তার পুত্র নিজাম খান অভিজাতবর্গের মাধ্যমে সিকান্দার শাহ লােদী উপাধি ধারণ করে ১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীর সিংহাসনে আরােহণ করেন।”
২. সুযােগ্য শাসক ও শ্রেষ্ঠ বিজেতাঃ সিকান্দার লােদী একাধারে সুযােগ্য শাসক ও শ্রেষ্ঠ বিজেতা ছিলেন। দিল্লী সালতানাতের হারানাে গৌরব তিনি ফিরিয়ে এনে ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। জৈনপুরের শাসনকর্তা তার ভাই বারবাক শাহ আনুগত্য থেকে বিরত থাকলে তিনি তাকে আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য করে অকর্মণ্যতার জন্য কারাবন্দি করেন। তিনি ত্রিহুত, বিহার প্রভৃতি অঞ্চল জয় করে সুলতানী রাষ্ট্রের সীমানা বৃদ্ধি করেন এবং ১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের সুলতান হােসাইন শাহের সাথে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
৩. রাজধানী স্থানান্তরঃ সিকান্দার লােদী ত্রিহুত ও বিহার জয় করার পর মধ্য ভারতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের শাসকদের দমনপূর্বক ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী দিল্লী থেকে আগ্রায় স্থানান্তর করেন।
৪. লােদী বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতানঃ লােদী বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন সিকান্দার লােদী। তিনি ছিলেন খুবই দক্ষ ও অতুলনীয় যােগ্যতাসম্পন্ন শাসক। রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি আফগান অভিজাতদের ক্ষমতা খর্ব করার পাশাপাশি পূর্ব প্রদেশের জমিদারদের ক্ষমতা সংকীর্ণ করেন। তিনি সুপরিকল্পিত প্রশাসন পরিচালনার জন্য শাসনব্যবস্থা ঢেলে সাজান।
৫. চারিত্রিক গুণাবলিঃ সিকান্দার লােদী দয়ালু ও ধার্মিক হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তার কৃতিতু ছিল অনন্য। তিনি ছিলেন উদার মনের অধিকারী। তিনি প্রজাদের শান্তির লক্ষ্যে সবরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। শাসনকার্যে ও ব্যক্তিগত বিষয়ে তিনি আলেমদের পরামর্শ মেনে চলতেন। তিনি মাঝে মাঝে পণ্ডিতদের দরবারে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের মূল্যবান রচনাদি শুনতেন।
ভি. ডি. মহাজন বলেন- He patronized the learned people and himself wrote poetry in Persian. কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক তাকে হিন্দু বিদ্বেষী আখ্যা দিলেও ঐতিহাসিক হেগ তাকে শ্রেষ্ঠ নৃপতি বলেছেন। তিনি বলেন- He was the greatest of the three kings of the house.
৬. মৃত্যুঃ আটাশ বছর যােগ্যতার সাথে রাজত্ব করার পর ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে সুলতান সিকান্দার লােদী আগ্রায় ইন্তেকাল করেন।
গ. ইবরাহীম লােদী (১৫১৭-১৫২৬ খ্রি.)
১. সিংহাসনে আরােহণঃ সুলতান সিকান্দার লােদীর মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে ইবরাহীম লােদী ২১ নভেম্বর ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে ইবরাহীম শাহ উপাধি ধারণ করে দিল্লীর সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি ছিলেন লােদী বংশের সর্বশেষ সুলতান।
২. ষড়যন্ত্র দমনঃ তিনি ক্ষমতায় আরােহণের পর অভিজাতবর্গের একাংশ জৈনপুরের শাসক জালাল খানকে স্বাধীন সুলতান বলে ঘােষণা করলে ইবরাহীম লােদী জালাল খানের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়ে তাকে পরাজিত ও নিহত করে সিংহাসন বিপদ মুক্ত করেন।
৩. ইবরাহীম লােদীর অবদানঃ আর. সি. মজুমদার বলেন, “একজন কীর্তিমান পুরুষ হিসেবে ইবরাহীম লােদীর নাম স্মরণযােগ্য। তিনি সাম্রাজ্যের বিভক্তি রােধ করেন। তিনি জালাল খানের অপসারণের পর গােয়ালিয়রের বিদ্রোহী শাসক আযম হুমায়ুনকে পরাজিত করেন। এতে অভিজাত শ্রেণি ক্ষুব্ধ হলেও তিনি তাদের আয়ত্তে রাখতে সক্ষম হন।
৪. বাবরের আক্রমণ ও পানিপথের প্রথম যুদ্ধঃ তৈমুরের বংশধর বাবর ইবরাহীম লােদী ও মেবারের রানা সংগ্রাম সিংহের বিরােধজনিত সুযােগের সদ্ব্যবহার করেন। তিনি মাত্র বারাে হাজার সুশিক্ষিত সৈন্যের একটি দল নিয়ে পিল্লির সন্নিকটে ২১ এপ্রিল ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইবরাহীম লােদী ও রানা সিংহকে পরাজিত করে সিংহাসন দখল করেন।
৫. মৃত্যুঃ ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে সমরকুশলী বাবর কর্তৃক পরিচালিত পানিপথের যুদ্ধে ইবরাহীম লােদী সূচনীয়ভাবে পরাজিত ও নিহত হন।
লােদী বংশের পতনঃ
বাহলুল লােদী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত লােদী বংশ দীর্ঘকাল রাজত্ব করলেও ইবরাহীম লােদীর উগ্র মেজাজ এবং অহংকারের কারণেই শেষ পর্যন্ত লােদী বংশের শাসন ক্ষমতার চির অবসান ঘটে। নিম্নে লােদী বংশের পতনের উল্লেখযোেগ্য কারণগুলাের বিবরণ দেয়া হলাে-
১. আফগান আমীরদের অসন্তুষ্টিঃ ইবরাহীম লােদীর কঠোর নীতি আফগান আমীরদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তিনি উদ্ধত আফগান অভিজাতদের দমন করার পদক্ষেপ নিয়ে তাদের অনেককে বন্দি করেন। এতে আফগান আমীরগণ ইবরাহীম লােদীর ওপর অসন্তুষ্ট হয় এবং বিদ্রোহ সৃষ্টির পথ রচনা করে।
২. দৌলত খান লােদীর বিরুদ্ধে অভিযানঃ ইবরাহীম লােদী দমন অভিযান পরিচালনা করেও আফগান শাসনকর্তা দৌলত খান লােদীকে পরাভূত করতে পারেননি। তাই তিনি দৌলত খান লােদীকে শাস্তি দিতে উদ্যত হলে দৌলত খান লােদী আত্মরক্ষার জন্য কাবুলের শাসনকর্তা বাবরকে ভারত আক্রমণে প্রলুব্ধ করেন।
৩. বাবরের আক্রমণঃ মধ্য এশিয়ার ফারগানা রাজ্যের শাসক বাবর স্বীয় শাসন এলাকা সম্প্রসারণকল্পে ভারতে একটি সফল অভিযানের পথ খুঁজছিলেন। ইবরাহীম লােদীর প্রতিদ্বন্দ্বী দৌলত খান লােদীর আমন্ত্রণে তার অভিযান পরিচালনার চমকপ্রদ সুযােগ সৃষ্টি হয়। তাই বাবর সুযােগ বুঝে ১৫২৬ সালে ভারত আক্রমণ করে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইবরাহীম লােদীকে পরাজিত ও হত্যা করে দিল্লী দখল করেন। ফলে ভারতের শাসন ক্ষমতা লােদী বংশের হাত থেকে মুঘলদের হাতে আসে।
উপসংহারঃ বাবরের হাতে ইবরাহীম লােদীর ভাগ্য বিপর্যয়ে ভারতবর্ষের মধ্যযুগীয় রাজনীতিতে এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন সূচিত হয়। পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবরের বিজয়ের মধ্য দিয়ে প্রায় ২০০ বছরাধিককালের সুলতানী শাসনের অবসান এবং মুঘল শাসনের সূচনা হয়।
Leave a comment