অথবা, মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবরের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর।
উপস্থাপনাঃ মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাসে মুঘল সম্রাট বাবর ছিলেন সর্বাপেক্ষা প্রথিতযশা নরপতি। ঘটনাবহুল ও বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী এ মহাপুরুষ স্বীয় দৃঢ়তা ও সহিষ্ণুতার বলে খ্যাতির স্বর্ণশিখরে আরােহণ করেছিলেন। তিনি ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের গােড়াপত্তন করেন এবং ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থাকেন। তাই ঐতিহাসিক স্মিথ বলেন- Babur was the most brilliant Asiatic Prince of his age and worth of a high place among the sovereigns of any age or century.
মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সম্রাট বাবরঃ
১. জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবর ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দের ২৪ ফেব্রুয়ারি তুর্কিস্তানের ফারগানা নামক একটি ক্ষুদ্র রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মির্জা ওমর শেখ ফারগানার অধিপতি ছিলেন। মাতার দিক থেকে তিনি চেঙ্গিস খান এবং পিতার দিক থেকে তৈমুর লঙ্গের বংশােদ্ভূত ছিলেন।
২. সিংহাসন লাভঃ পিতা মির্জা ওমর শেখের মৃত্যুর পর ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১২ বছর বয়সে বাবর ফারগানার সিংহাসনে আরােহণ করেন। এভাবে একজন সম্রাট হিসেবে শুরু হয় বাবরের কৈশাের জীবন।
৩. বিজেতা বাবরঃ দেশ জয়ের অদম্য স্পৃহায় বাবর মাত্র ১৫ বছর বয়সে পূর্বপুরুষের রাজধানী সমরকন্দ অধিকার করেন। ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি কাবুল অধিকার করে কিছুদিনের জন্য গজনীও নিজ দখলে আনতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে সাইবানী খানের উত্তরাধিকারী তৈমুর সুলতান কর্তৃক পরাস্ত হয়ে রাজ্যহারা হন।
৪. ভাগ্যান্বেষী সৈনিকঃ সম্রাট বাবরকে যথেষ্ট ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার হয়ে বিভিন্ন হতাশাজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। তবে তিনি কোনাে অবস্থাতেই হতাশ হননি। চেঙ্গিস খান ও তৈমুর লঙ্গের রক্তের অধিকারী বাবরের ছিল দুর্বার আকাঙ্ক্ষা, সুদৃঢ় মনােবল এবং অসামান্য নির্ভীকতা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তার পক্ষে মধ্য এশিয়ায় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তাই তিনি ভারত উপমহাদেশে ভাগ্য পরীক্ষা করতে তৎপর হন।
৫. বাধাবিপত্তির সফল মােকাবেলাঃ মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পূর্বে সম্রাট বাবর সীমাহীন বাধাবিপত্তি সফলভাবে মােকাবেলা করেন।
৬. মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাঃ সামরিক বিজয় দ্বারা ভারত উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে বাবরকে কয়েকটি যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয়েছে। কারণ তিনি ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের ২১শে এপ্রিল পানিপথের প্রান্তরে ইবরাহিম লােদীকে ও ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই মার্চ খানুয়ার প্রান্তরে সংগ্রাম সিংহকে এবং ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে গােগরার যুদ্ধে বাংলার শাসনকর্তা নুসরত শাহকে পরাজিত করেন। এসব যুদ্ধ বিজয়ের মাধ্যমে তিনি দিল্লী ও আগ্রা দখল করে রাজধানী কাবুল থেকে দিল্লীতে স্থানান্তর করেন। এভাবেই তিনি ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
সম্রাট বাবরের কৃতিত্বসমূহঃ
১. বিজেতা ও রাজ্য সংগঠক হিসেবে বাবরঃ তিনি শুধু নির্ভীক সৈনিক, দক্ষ সেনাধ্যক্ষ ও সুদক্ষ অস্ত্র পরিচালকই ছিলেন না; বরং তিনি দেশ বিজয়ের নেশায় বিভাের থাকতেন এবং কালক্রমে এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজেতার সম্মানে ভূষিত হন। ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন, “সামরিক বিজয় দ্বারা তিনি যে রাজবংশের সূচনা করেন, তার ওপরই ইতিহাসে তার সম্মান ও স্থায়ী আসন নির্দিষ্ট হয়েছে। অবশ্য এজন্য তাকে কয়েকটি যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তিনি পানিপথের প্রথম যুদ্ধে, খানুয়ার যুদ্ধে ও গােগরার যুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ গৌরব অর্জন করেন।”
২. শাসক হিসেবে বাবরের কৃতিত্বঃ একজন দক্ষ শাসক হিসেবেও বাবর ইতিহাসে অসামান্য কৃতিত্বের অধিকারী হিসেবে খ্যাত। তিনি প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে এবং অত্যন্ত দক্ষতার সাথে জায়গীরদার ও সামন্ত রাজাদের কর্তৃত্ব খর্ব করেন।
৩. দূরদর্শী সেনানায়কঃ ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে বাবর কাবুলে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং কাবুলকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে প্রাথমিকভাবে ভারতবর্ষে চারটি অভিযান প্রেরণ করে বাজাউর, ভেরা, কুশাব, চেনার, শিয়ালকোট দখল করেন। ঐতিহাসিক লেনপুল, ঈশ্বরী প্রসাদ, আর. সি. মজুমদার প্রমুখ এ কথার ওপর ঐকমত্য পােষণ করেছেন।
৪. সুদক্ষ সেনাপতিঃ ঐতিহাসিক বেভারিক বলেন, “একজন সেনাধ্যক্ষ হিসেবে বাবর অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দেন। পানিপথে অপেক্ষাকৃত বৃহৎ আফগান সেনাবাহিনীর বিশৃঙ্খলার সুযােগ গ্রহণ করতে বাবর ইতস্তত করেননি।”
৫. রাজনৈতিক দক্ষতাঃ বাবর ছিলেন একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ। তিনি স্বীয় রাজনৈতিক চালে আফগানদের এক গােষ্ঠীকে অপর গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করে তাদের ধ্বংস সাধন করেন। তার চাতুর্য ও দূরদর্শিতা ছিল ম্যাকিয়াভেলির অনুরূপ।
৬. সুনিপুণ রণকুশলীঃ বাবরই প্রথম ভারতবর্ষে কামান ব্যবহার শুরু করেন। ড. ত্রিপাঠী বলেন, “বাবর ছিলেন প্রতিভাবান সেনাধ্যক্ষ, দক্ষ তীরন্দাজ, নিপুণ তরবারি চালক ও চতুর ঘােড়সওয়ার।” রণকুশলী হিসেবে তার নাম চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
৭. সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাঃ সম্রাট বাবর অদম্য সাহস ও দুর্নিবার ইচ্ছায় দিল্লী সালতানাতের পতন ঘটিয়ে কাবুল থেকে বঙ্গদেশ পর্যন্ত একটা শ্রেষ্ঠ রাজবংশ ও দীর্ঘস্থায়ী মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঐতিহাসিক রাব্রুক উইলিয়াম বলেন, “সংগঠন অথবা প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলেও তিনি ষষ্ঠদশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।”
৮. ধর্মীয় সহিষ্ণুতাঃ অসাধারণ প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও সম্রাট বাবর তার পূর্বপুরুষদের মতাে নৃশংস ছিলেন না। তার ধার্মিকতা ও পরধর্মের প্রতি উদারতা সম্পর্কে ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, “তার রাজত্বে হিন্দুদের কোনাে প্রকার নিগ্রহ ভােগ করতে হয়নি এবং ধর্মের জন্য তিনি কোনাে ব্যক্তিকে শাস্তিও দেননি।”
৯. জ্ঞানী ও পণ্ডিতঃ সম্রাট বাবর একজন জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি পারস্য ভাষায় কবিতা লেখতেন এবং গদ্যে নিজ আত্মজীবনী ‘তযুকে বাবরী’ লেখে যান। ঐতিহাসিক স্যার ই. ডেনিসন রস বলেন- The Memories of Babur must be reckoned among the most enthralling.
১০. ডাক চৌকি স্থাপনঃ ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, দূরবর্তী অঞ্চলের সাথে নিয়মিত ও দ্রুত যােগাযােগ রক্ষার জন্য তিনি সমগ্র রাজ্যে ১৫ মাইল অণ্ডর সম ডাক চৌকি স্থাপন করেন।
১১. যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়নঃ সম্রাট বাবর দেশব্যাপী বিভিন্ন রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্ট নির্মাণ করে যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধনে প্রভূত অবদানের স্বাক্ষর রাখেন।
১২. স্থাপত্যশিল্পের পৃষ্ঠপােষকঃ বাবর শিল্পকলা ও স্থাপত্যশিল্পের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। ড. ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, “বাবর সর্বগুণের অধিকারী ছিলেন। তাই তিনি অন্যান্য উন্নয়ন কার্যের সাথে বহু বাগ বাগিচা, সেতু, অট্টালিকা ও পাকা নর্দমা নির্মাণ করেন।”
১৩. ইতিহাসে বাবরের স্থানঃ ঐতিহাসিকগণ সম্রাট বাবরের সর্বমুখী প্রতিভা, বুদ্ধিমত্তা, বীরত্ব, কাব্যচর্চা ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। চুলচেরা বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয়, বাবরই ভারত উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্যের শক্ত ভিত্তি স্থাপন করতে সক্ষম হন।
১৪. অনুপম চারিত্রিক মাধুর্যঃ উদারতা, মহানুভবতা, বাৎসল্য বাবরের চরিত্রকে মহিমান্বিত করে তুলেছিল। তার চারিত্রিক গুণাবলি ছিল প্রশংসনীয়। অঙ্গীকার ভঙ্গ করা তিনি জঘন্য পাপ মনে করতেন এবং সর্বদা আল্লাহর ওপর নির্ভর করতেন।
উপসংহারঃ ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর রাজ্যহীন অবস্থা থেকে বিশাল সাম্রাজ্যের গােড়াপত্তন ও একটি স্বর্ণযুগের সূচনা করে ইতিহাসে অমর অক্ষয় হয়ে আছেন। ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন- His permanent place in history rests upon his India conquests, which opened the way for an imperial time.
Leave a comment