প্রশ্নঃ কোন কোন নীতি বা আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ হয়েছিল? এ আন্দোলনে কোন কোন ব্যক্তি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন? আলােচনা কর।
উপস্থাপনাঃ ভারত উপমহাদেশের রাজনৈতিক ক্রমবিকাশের ইতিহাসে ভারত বিভাগ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হলে তীব্র আন্দোলন ও শত শত জীবনের বিনিময়ে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ হয়েছিল।
ভারত বিভাগের পটভূমি/কারণঃ
১. পলাশীর প্রতিশােধ গ্রহণঃ পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক জীবনে নেমে আসে চরম অমানিশা। ইংরেজদের অত্যাচারের যাতাকল থেকে মুক্তিলাভ এবং পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশােধ স্পৃহার জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুসলিম মনীষীগণ বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করেন।
২. সিপাহী বিপ্লবঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী জনতার বিপ্লব ব্যর্থ হলেও এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল হিসেবে পরবর্তীকালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে, ত্বরান্বিত হয় স্বাধীনতা অর্জনের পথপরিক্রমা।
৩. নতুন জাগরণঃ ঐতিহাসিক ড. এম. আর. তরফদার বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রাম করে মুসলমানগণ ব্যর্থ হলেও ভারত বিভাগের জন্য স্যার সৈয়দ আহমদ খান আলীগড় আন্দোলনের দ্বারা মুসলমানদের মধ্যে এক নতুন জাগরণের সৃষ্টি করেন।
৪. কংগ্রেস ও গান্ধীর আন্দোলনঃ একই সময়ে মােহনলাল করমচঁাদ গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস ব্রিটিশের বিরুদ্ধে অসহযােগ আন্দোলন শুরু করে। শেষ পর্যন্ত খেলাফত ও অসহযােগ আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও এ আন্দোলনের জোয়ারে ইংরেজ সরকার ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে।
৫. বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনঃ পশ্চিমবঙ্গের শাসকগােষ্ঠী কর্তৃক বাংলাদেশের মুসলমানগণ শােষিত হতে থাকলে এতদঞ্চলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ পূর্ববঙ্গকে পৃথক প্রদেশ গঠনের দাবি জানায়। উক্ত দাবির মুখে ১৯০৫ সালে ইংরেজরা বঙ্গভঙ্গ ঘােষণা করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে আলাদা প্রদেশ গঠন করে। ঢাকায় নতুন এ প্রদেশের রাজধানী স্থাপিত হয়। ফলে ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলার মুসলমানরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে জেগে ওঠে।
৬. মুসলিম লীগের আন্দোলনঃ খেলাফত ও অসহযােগ আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ায় ১৯০৬ সালে গঠিত মুসলিম লীগ রাজনৈতিক ময়দানে অবতীর্ণ হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়ে তােলে। এ আন্দোলন পরবর্তীকালে ব্রিটিশদের ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করে।
৭. ভারতীয় মুসলিম লীগকে সুসংগঠিতকরণঃ ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে পূর্ব বাংলার মুসলমানগণ অত্যন্ত হতাশ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় মুসলিম নেতৃবৃন্দ ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে গঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগকে সুসংগঠিত ও সুদৃঢ় করার প্রয়ােজনীয়তা বিশেষভাবে উপলব্ধি করেন।
৮. খেলাফত আন্দোলনঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইংরেজরা মুসলিম বিশ্বের ওপর নির্যাতনের স্টিম রােলার চালায়। এ নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ১৯১৯ সালে খেলাফত আন্দোলনের মাধ্যমে ইংরেজ খেদাও আন্দোলন শুরু করে।
৯. অসহযােগ আন্দোলনঃ এ দেশে ব্রিটিশ বেনিয়াদের নির্মম শাসন থেকে হিন্দু মুসলমানরে মুক্ত করে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে বিশিষ্ট মুসলিম নেতারা ১৯২০ সালে অসহযােগ আন্দোলন শুরু করেন। পরবর্তীতে এ আন্দোলন ইংরেজ শাসকগােষ্ঠীর ক্ষমতার মসনদ নড়বড়ে করে তােলে।
১০. সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনঃ খেলাফত ও অসহযােগ আন্দোলনের সময় সন্ত্রাসবাদীরা বােমা পিস্তল দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট, বড়লাট প্রমুখ ইংরেজ কর্মচারী হত্যা শুরু করায় ব্রিটিশদের মাঝে চরম আতঙ্ক দেখা দেয়।
১১. ১৯৩৭ সালের নির্বাচনঃ ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে ৪৯২টি আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ মাত্র ১০৬টি আসন লাভ করে। ফলে এ. কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়।
১২. সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাঃ ঐতিহাসিক আর. সি. মজুমদার বলেন, নির্বাচনের পর পরই হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলােতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে মুসলমানদের নিরাপত্তা ক্ষুন্ন হয় এবং তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের ওপর নানা বিধি নিষেধ চলতে থাকে। ঠিক সে মুহর্তে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগ পুনর্গঠনের দায়িত্ব হাতে নেন।
১৩. মুসলিম লীগের লক্ষৌ অধিবেশনের ঘােষণাঃ ১৯৩৭ সালে লক্ষ্ণৌতে মুসলিম লীগের অধিবেশনে এম. এ. জিন্নাহ ঘােষণা দেন, মুসলিম লীগ ভারতবর্ষে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী।
১৪. দ্বি-জাতিতত্ত্বঃ ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ সভাপতি এম. এ. জিন্নাহ তার দ্বি-জাতিতত্ত্বের ব্যাখ্যায় বলেন, হিন্দু ও মুসলমানদের ধর্মীয় দর্শন, সামাজিক রীতি-নীতি, সাহিত্য-সভ্যতা, সংস্কৃতি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও পরস্পর বিরােধী। মূলত তার এ দ্বি-জাতিতত্ত্বই ভারত বিভক্তি তথা পাকিস্তান সৃষ্টির দার্শনিক ভিত্তি।
১৫. লাহাের অধিবেশনঃ এমনি রাজনৈতিক পটভূমিকায় ভারতকে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করার উদ্দেশ্যে ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহােরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের এক অধিবেশনে লাহাের প্রস্তাব গৃহীত হয়।
১৬. পাকিস্তানের ম্যান্ডেট লাভঃ ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগ পাকিস্তান দাবিকে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে নির্বাচনে অবতীর্ণ হলে ৪৯৫ আসনের মধ্যে ৪৪৬টি আসনে বিজয়ী হয়। ফলে ভারত বিভক্তি নিশ্চিত হয়ে যায়।
১৭. জুন পরিকল্পনাঃ আন্দোলন প্রতিরােধে ব্যর্থ হয়ে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৭ সালের ২ জুন ভারত বিভাগ আইন পাশ করে। যা জুন পরিকল্পনা নামে খ্যাত।
আন্দোলনের ফলাফলঃ ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলন ও মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলন এবং বিশেষ করে পাকিস্তান আন্দোলনের ফলে স্বাধীনতা আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে। অবশেষে ইংরেজ সরকার ভারতবর্ষকে স্বাধীনতাদানের নিমিত্ত ১৯৪৭ সালের ২৮ জুলাই ভারত স্বাধীনতা আইন পাস করে এবং এর মাধ্যমে উক্ত বছরই ১৪ আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ আগস্ট ভারতকে স্বাধীনতা প্রদান করা হয়।
ভারত বিভাগ আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালনকারীগণঃ ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন, ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনে যারা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন তারা হলেন সাইয়্যেদ আহমদ বেরলভী, স্যার সৈয়দ আহমদ খান, সাইয়্যেদ নিসার আলী তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ, নওয়াব আবদুল লতিফ, মাওলানা আবুল কালাম আযাদ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, করমচাঁদ গান্ধী, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু প্রমুখ।
উপসংহারঃ সুদীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের ফলেই ১৯৪৭ সালে ইংরেজদের কবল থেকে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। এ আন্দোলনে মনীষীগণের নেতৃত্বে ভারতের সাধারণ জনগণ নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সােচ্চার না হলে হয়ত ব্রিটিশ বেনিয়াগােষ্ঠী এসব স্বাধীনতা আন্দোলন দমনে সফল হতাে। আর আমরা হয়ত ভারত উপমহাদেশের মসজিদসমূহ থেকে মুয়াযযিনের আযানের ধ্বনির পরিবর্তে কংস ধ্বনি আর ঢাক-ঢােলের ঢক্কর নিনাদ শুনতাম।
Leave a comment