অথবা, মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে মধ্যযুগের সূত্রপাত ঠিক কখন থেকে তা নিশ্চিত করে বলা শক্ত। এ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মতামত প্রচলিত রয়েছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, মধ্যযুগের রাষ্ট্রতত্ত্ব এক ঊষর মরুভূমির মত এবং তা প্রায়ই সম্রাট ও পােপের মধ্যকার দ্বন্দ্বের ধূলােঝড়ে অশান্ত। সেখানে রয়েছে প্রাণহীন আলােচনার বিস্তীর্ণ এক অরণ্য আর রয়েছে মরীচিকার মতাে এক ধরনের অবাস্তবতা। রাষ্ট্রদর্শনের ইতিহাসকে মােটামুটি তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা- (১) প্রাচীন যুগ (২) মধ্যযুগ ও (৩) আধুনিক যুগ। আর আমাদের আলােচ্য বিষয় হলাে মধ্যযুগ যা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
মধ্যযুগঃ রাষ্ট্রদর্শনের ইতিহাসে কোনাে সময়কে মধ্যযুগে বলা যায়, সে বিষয়ে যথেষ্ট মতভেদ থাকলেও মােটামুটিভাবে ইউরােপের ইতিহাসে ষষ্ঠ শতাব্দী হতে ষােড়শ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কে মধ্যযুগ (Middle Age) বলা হয়।
মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যসমূহঃ মধ্যযুগ রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে একটি বিশেষ সময় বলে বিবেচিত। সামগ্রিকভাবে মধ্যযুগের ওপর দৃষ্টিপাত করলে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
(১) ইসলাম ধর্মের প্রাধান্যঃ মধ্যযুগ অন্ধকার যুগ হলেও এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের অনেক স্থানেই পবিত্র ইসলাম ধর্মের বাণী পৌঁছে এবং দলে দলে লােক দীক্ষা গ্রহণ করে। ইসলাম ধর্ম এ যুগে একটি বিশেষ স্থান দখল করেছিল।
(২) পােপের কর্তৃত্ব বৃদ্ধিঃ পােপের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি ছিল মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার একটি বিশেষ দিক। মধ্যযুগে পােপের কথাই ছিল আইন বিশেষ। পােপের প্রাধান্য যেন সমগ্র মধ্যযুগকে গ্রাস করে রেখেছিল। আধ্যাত্মিক ক্ষমতার নিকট পােপের পার্থিব ক্ষমতার অধীনতা পােপের চিন্তাধারায় লক্ষ্য করা যায়।
(৩) স্টোয়িকবাদের প্রভাবঃ স্টোয়িকবাদের প্রভাব মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার একটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য। স্টোয়িকবাদ মধ্যযুগের সমগ্র রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে নিয়ন্ত্রণ করত। মধ্যযুগে স্টোয়িকবাদের ন্যায় রাজনৈতিক দর্শন ও প্রাকৃতিক আইন ঈশ্বরের আইনের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
(৪) যাজকদের ভূমিকাঃ মধ্যযুগে জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে যাজকদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই ধর্মীয় প্রশ্নসমূহ প্রাধান্য লাভ করে। যাজকগণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মতামত পেশ করতেন। তাদের অনুসিদ্ধান্তের উৎস ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতি।
(৫) অবরােহ পদ্ধতি অনুসরণঃ মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তায় অববােহ পদ্ধতি অনুসরণের বিধান লক্ষ্য করা যায়। যাজকদল আরােহ পদ্ধতির পরিবর্তে অবরােহ পদ্ধতিতে তাদের যুক্তি বিশ্লেষণ করতেন। পর্যবেক্ষণ, অনুসন্ধান . বা পরীক্ষণের তারা বিশেষ ধার ধারতেন না।
(৬) ধর্মীয় আধিপত্যঃ ধর্মীয় আধিপত্য ছিল মধ্যযুগের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। জাগতিক ব্যাপারে ধর্মীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে রাজনীতি ধর্মের নিগড়ে আবদ্ধ হয়। এরূপ পরিস্থিতি মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তায় বিরাজ করছিল।
(৭) আধ্যাত্মিক ও পার্থিব দ্বন্দ্বঃ মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা মূলত আধ্যাত্মিক ও পার্থিব শক্তির সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। এই সংঘর্ষের শেষ পর্যায়ে বিশ্ব রাজনীতিতে পােপের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং একটি সুনিশ্চিত আধ্যাত্মিক মতবাদের বিকাশ ঘটে।
(৮) পুরাতন টেষ্টামেন্টের প্রাধান্যঃ মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে পুরাতন টেস্টামেন্টের প্রাধান্য দেখা যায়। পােপ তার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নতুন টেস্টামেন্ট অপেক্ষা পুরাতন টেস্টামেন্টকে অধিক উপযােগী বলে মনে করেন।
(৯) সামন্তবাদী ধারণাঃ মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তায় সামন্তবাদী প্রথার মূল বৈশিষ্ট্য হলাে ভূমিকেন্দ্রিক অর্থব্যবস্থা, ভূমিকেন্দ্রিক অধিকার, সুযােগ, সুবিধা ও পর্যায়ক্রমিক ক্ষমতার বিন্যাস প্রভৃতি। আধুনিক যুগে জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভবের পূর্ব পর্যন্ত সামন্তব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। মধ্যযুগে সামন্ত প্রভুদের অত্যাচার ও নিপীড়নে সৃজনশীলতা লােপ পায়।
(১০) রাষ্ট্র ও গির্জা অভিন্নঃ খ্রিষ্টীয় যাজকদের মতানুসারে রাষ্ট্র ও গির্জা দু’টি স্বতন্ত্র ও সমান্তরাল প্রতিষ্ঠান নয়। বরং একটি ঐক্যবদ্ধ অখণ্ড ব্যবস্থার দুটি দিক মাত্র-পার্থিব ও আধ্যাত্মিক। পার্থিব দিকের প্রধান হচ্ছেন সম্রাট ও আধ্যাত্মিক দিকের প্রধান হচ্ছেন পােপ।
(১১) প্রশাসনিক দূর্বলতাঃ মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তায় প্রশাসনিক দুর্বলতা বিরাজ করছিল। ইউরােপের পশ্চিমাংশে দেখা যায় সাম্রাজ্যবাদ জার্মানদের প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে সুষ্ঠু রাষ্ট্রীয় কার্যের বিকাশ ঘটেনি। আর একারণেই মধ্যযুগ ছিল অরাজনৈতিক।
(১২) দুই তরবারীর যুদ্ধঃ রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ মধ্যযুগকে দুই তরবারীর যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন। আধ্যাত্মিক ব্যাপারে গির্জায় এবং পার্থিব ব্যাপারে রাষ্ট্রের স্বায়ত্তশাসনে একে অন্যের হস্তক্ষেপ না করার যে নীতি ঘােষণা করা হয়, তাই ছিল দুই তরবারী তত্ত্ব।
(১৩) বিশ্বজনীনতাবাদঃ The note of all medieval thought is its Universalism. রােমান সম্রাজ্য ভৌগােলিক সীমানাকে স্বীকার করেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যকার পার্থক্য করে অখন্ড সম্রাজ্য স্থাপন করার কৃতিত্ব রােমান শাসকদের।
(১৪) নির্বাচন ব্যবস্থাঃ মধ্যযুগে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ নির্বাচন এমনকি কোনাে কোনাে এলাকায় আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের নমুনা লক্ষ্য করা যায়। যেমন- বৃটিশ কমন্সসভা, বরাে এবং কাউন্টি কাউন্সিলের মতাে কিছু কিছু আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান স্বায়ত্তশাসন ভােগ করত।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, উল্লেখিত বিষয়ের মধ্যে মধ্যযুগের আসল পরিচয় নিহিত। মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা আধুনিক বিচারে ছিল প্রতিক্রিয়াশীল। কিন্তু তা বলে কোনােক্রমেই গুরুত্বহীন ছিল না। সার্বিক বিশ্লেষণে বলা যায় যে, উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ আলােচনার মাধ্যমেই মধ্যযুগের আলােচনা ফলপ্রসূ হয়ে ওঠবে।
Leave a comment