প্রশ্নঃ মন বা আত্মা সম্পর্কে আধ্যাত্মিক মতবাদ ও অভিজ্ঞতামূলক মতবাদ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, মনের স্বরূপ মতবাদ সম্পর্কে অভিজ্ঞতাবাদ মতবাদের একটি সমালোচনাগুলো ব্যাখ্যা দাও।

ভূমিকাঃ দর্শনের বিভিন্ন আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে মনসম্পর্কিত আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যাকে কেন্দ্ৰ করে মনোদর্শনের উৎপত্তি হয়েছে। এই মনোদর্শন সাম্প্রতিককালে দর্শনের বিশিষ্ট শাখা হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালের মনীষীরা মনের স্বরূপ কিংবা মনের সাথে বস্তুর সম্পর্ক কী তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছেন। ফলে মন সম্পর্কে দর্শনের ইতিহাসে বিভিন্ন মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। এ সকল মতবাদের মধ্যে আধ্যাত্মিক মতবাদ ও অভিজ্ঞতামূলক মতবাদ অন্যতম। নিম্নে মনের স্বরূপ উল্লেখপূর্বক উল্লিখিত মতবাদ আলোচনা করা হলো-

মনের স্বরূপ সম্পর্কে আধ্যাত্মিক মতবাদঃ মানুষ প্রতি মুহূর্তে অভিজ্ঞতা অর্জন করছে। এই অভিজ্ঞতা বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। কিন্তু অভিজ্ঞতার ভিন্নতার দরুন মন ভিন্ন হয় না। মন বা আত্মা অভিন্ন, অপরিবর্তনীয় ও স্থায়ী থাকে বলেই বিভিন্ন অভিজ্ঞতা আমাদের মনে থাকে। কাজেই আত্মাকে অপরিবর্তিত স্থায়ী আধ্যাত্মিক দ্রব্য বলা উচিত। দর্শনের ইতিহাসে আমরা এই মতবাদের প্রাচীন রূপ ও আধুনিক রূপ দেখতে পাই। প্লেটো ও এরিস্টটল ছিলেন প্রাচীন রূপের প্রবর্তক। আর ডেকার্ট, রক, বার্কলি ছিলেন আধুনিক রূপের প্রধান সমর্থক। নিম্নে এগুলো আলোচিত হলো-

প্রাচীন রূপঃ মনের স্বরূপ সম্পর্কে প্রাচীন যুগের দার্শনিকদের যে মতবাদ ব্যক্ত করেছেন তা নিম্নরূপঃ

(ক) আত্মা সম্পর্কে প্লেটোর মতঃ প্লেটো মনে করেন, মন বা আত্মা তিন রকম মৌলিক ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তিনি এগুলোর নাম দিয়েছেন প্রজ্ঞা, কামনা এবং শক্তি। প্লেটোর আত্মার তিন ক্রিয়া অনেকটা আধুনিক মনোবিজ্ঞানীদের আত্মার এ তিনি বিভাগের অনুরূপ। প্লেটোর মতে, প্রজ্ঞাই হলো আত্মার আসল রূপ । প্রজ্ঞা দৈব শক্তিবিশিষ্ট্য। প্রজ্ঞারূপে আত্মা সনাতন বা শাশ্বত। এর বিনাশ নেই। আত্মা সম্পূর্ণরূপে অজড় বা আধ্যাত্মিক। দেহের সাথে এর সম্পর্কের কোনো প্রয়োজন নেই।

(খ) আত্মা সম্পর্কে এরিস্টটলের মতঃ এরিস্টটল দেহ ও আত্মার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা স্বীকার করেন। কিন্তু উভয়ের স্বতন্ত্র সত্তা অস্বীকার করেন। আত্মাকেই তিনি দেহের আকার বা সংগঠন এবং দেহকে আত্মার উপাদান বলে মনে করেন। প্লেটোর মতো এরিস্টটলও প্রজ্ঞাকে আত্মার মাধ্যম বলে মনে করেন।

আধুনিক যুগঃ মনের স্বরূপ সম্পর্কে আধুনিক যুগের দার্শনিকদের যে মতবাদ ব্যক্ত করেছেন তা নিম্নরূপ- (ক) আত্মা সম্পর্কে ডেকার্টের মতঃ আধুনিক দর্শনের জনক ফরাসি দার্শনিক ডেকার্ট আত্মা বলতে জড় থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আধ্যাত্মিক তত্ত্বকে বোঝেন। মনের স্বরূপ-লক্ষণ হলো চেতনা। জড়ের চেতনা নেই। আর আত্মার বিস্তৃতি নেই। চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছা আত্মাকে আশ্রয় করে থাকে। আত্মা সরল, অবিভাজ্য, অশরীরী, প্রাণবন্ত ও আদর্শমূলক। ডেকার্ট বলেন, সবকিছুকে সন্দেহ করা গেলেও আত্মাকে সন্দেহ করা যায় না। আত্মাকে সন্দেহ করতে গেলে সন্দেহকর্তা রূপে আত্মাকে মেনে নিতে হয়। তাই তিনি বলেন, আত্মার অস্তিত্ব একান্তভাবে নিশ্চিত ও সন্দেহাতীত।

(খ) আত্মা সম্বন্ধে লকের ধারণাঃ অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক জন লকের মতে, আত্মা হলো এক মানস দ্রব্য। চিন্তা, অনুভূতি, ইচ্ছা প্রভৃতি হলো মানসিক ক্রিয়া। এ ক্রিয়াগুলো শূন্যে ভাসমান থাকতে পারে না। সুতরাং এগুলোর কোনো আধার আছে যাকে আশ্রয় করে এগুলো থাকে। এ আধারই আত্মা যা অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়।

(গ) আত্মা সম্পর্কে বার্কলির মতঃ ভাববাদী দার্শনিক বার্কলি আধ্যাত্ম দ্রব্য রূপে আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করেন। তার মতে, জড় বলে কোনো দ্রব্যের অস্তিত্ব নেই। সব দ্রব্যই চেতনধর্মী। জড় মনের ধারণামাত্র, কিন্তু আত্মা মনের ধারণা নয়। ধারণা নিষ্ক্রিয়, আত্মা সক্রিয়। আত্মা ছাড়া কোনো ধারণাই হয় না।

মনের স্বরূপ সম্পর্কে অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদঃ চরম সন্দেহবাদী দার্শনিক ডেভিড হিউম হচ্ছেন আত্মা সম্বন্ধে অভিজ্ঞতাবাদী ব্যাখ্যার জনক। এ ছাড়া অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল, উইলিয়াম জেমস আত্মা সম্পর্কে অভিজ্ঞতাবাদী মত ব্যক্ত করেন। নিম্নে তাদের মত তুলে ধরা হলো-

(ক) হিউমের মতেঃ আমাদের সব ধারণাই ইন্দ্রিয় থেকে উদ্ভূত হয়। তিনি বলেন, এমন কোনো ইন্দ্রিয়জ নেই যার থেকে আমরা এই ধারণা লাভ করতে পারি যে, আধ্যাত্মিক দ্রব্য হিসেবে আত্মা আছে। অথচ কিছু কিছু দার্শনিক রয়েছেন যারা মনে করেন যে, শাশ্বত, অবিনশ্বর, সরল, অবিভাজ্য আধ্যাত্ম দ্রব্যের অস্তিত্ব আছে এবং সাক্ষাৎ অনুভবের মাধ্যমে আত্মার জ্ঞান লাভ করা যায়। এদের বিরোধিতা করে হিউম বলেন, অভিজ্ঞতায় আমরা যে আত্মাকে পাই, সে আত্মা হলো আমাদের প্রত্যক্ষণের সমষ্টি। তার ভাষায়, “আমার দিক থেকে যখনই আমি অন্তরঙ্গভাবে আমার মধ্যে প্রবেশ করি, তখন আমি সর্বদাই কোনো-না-কোনো সংবেদন পাই। কখনও গরম, কখনও ঠাণ্ডা, কখনও আলো; কখনও ছায়া, কখনও ভালোবাসা, কখনও বা ঘৃণা, কখনও দুঃখ, কখনও বা সুখ। আমি কখনও সংবেদন ছাড়া কিছুই প্রত্যক্ষ করি না। হিউমের মতে, আমাদের এই মন যেন একটি রঙ্গমঞ্চ, যেখানে একের পর এক সংবেদনের আবির্ভাব ঘটছে, মঞ্চে চলাফেরা করছে, তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ হিউমের মতে, পরিবর্তনশীল সংবেদন, অনুভূতি ও ধারণার পারম্পর্যই আত্মা। এখন প্রশ্ন হতে পারে স্থায়ী আত্মা বলে যদি কিছু না থাকে তাহলে বিছিন্ন সংবেদনগুলোর মধ্যে সংযোগ কিভাবে সম্ভব? এ ক্ষেত্রে হিউমের উত্তর হলো ধারণার অনুষঙ্গ নিয়মই বিচ্ছিন্ন সংবেদনগুলোর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে। যে নিয়মগুলো সংবেদন বা ধারণার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে; হিউম সেগুলোর নাম দিয়েছেন-সাদৃশ্য নিয়ম, স্থান বা কালের সান্নিধ্য এবং কারণ-কার্য নিয়ম। যখন কোনো প্রতিকৃতি এর মূল বস্তুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয় তখন তা হবে সাদৃশ্য নিয়মের দৃষ্টান্ত। কোনো অট্টালিকার একটি কক্ষের কথা উল্লেখ করলে অন্য কক্ষগুলোর কথাও এসে যায়, এটি হলো সান্নিধ্য নিয়মের উদাহরণ। আবার যদি কোনো আঘাতের কথা ভাবা হয়, তাহলে সে আঘাত থেকে যে বেদনার উদ্ভব হয়, তা আমরা ভাবি, এটি হলো কারণ-কার্য নিয়মের উদাহরণ।

(খ) মিলের মতেঃ জন স্টুয়ার্ট মিল এবং উইলিয়াম জেমস্ আত্মা সম্পর্কে হিউমের বক্তব্যকে সমর্থন করেন। মিলের মতে, সংবেদনের ধারাই আত্মা। জেমস্ তার Pragmatism : A New Name for Some Old Ways of Thinking গ্রন্থে আত্মা সম্পর্কে তার বক্তব্য রাখেন। তিনি আত্মাকে চেতনার প্রবাহ বলে বর্ণনা করেন। রাসেলের মতে, মন একগুচ্ছ মানসিক ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

(গ) জেমসের মতঃ উইলিয়াম জেমস আত্মাকে চৈতন্যপ্রবাহ বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, আত্মা বলে কোনো সত্তা বা জ্ঞাতারূপে কোনো আত্মার অস্তিত্ব কল্পনা করা অবান্তর। তিনি বলেন, মন বিচ্ছিন্ন সংবেদনের সমষ্টি নয়৷ মন হচ্ছে চৈতন্যের অখণ্ড এবং অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ। এ প্রবাহে চৈতন্যগুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, মন সম্পর্কে বিভিন্ন দার্শনিক ভিন্ন ভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। তাই এককভাবে কোনটি গ্রহণযোগ্য সেটা হুট করে বলা যাবে না। কেননা সবাই তার মতের সপক্ষে যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। তবে মন সম্পর্কে ডেভিড হিউম সবচেয়ে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করেছেন বলে মনে হয়। এ কারণে ডেভিড হিউমের মতকেই সবচেয়ে বেশি যুক্তিযুক্ত বলে মনে করতে পারি।