প্রশ্নঃ শাসকের মধ্যে শৃগাল ও সিংহের গুণাবলীর সমন্বয় সাধন হওয়া উচিত। মেকিয়াভেলির প্রিন্স গ্রন্থের আলোকে উদ্ধৃতিটির আলোচনা কর।

অথবা, শাসকের গুণাবলীর সম্পর্কে ম্যাকেয়াভেলীর চিন্তাধারা আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ পঞ্চদশ শতাব্দীতে পরিষদ আন্দোলনের ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে আধুনিক যুগের সূত্রপাত হয়। রাষ্ট্রচিন্তার এই যুগসন্ধিক্ষণে সাধারণভাবে সমগ্র ইউরোপে এবং বিশেষভাবে ইতালিতে যে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সাধিত হয়, তারই বাস্তব প্রতিফলন ঘটে মেকিয়াভেলির রাষ্ট্রদর্শনে। পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে যে কয়জন চিন্তাবিদ সমকালীন ঘটনাবলীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রাষ্ট্র সম্বন্ধে তাঁদের মতামত ব্যক্ত করে গেছেন, তাদের মধ্যে মেকিয়াভেলী অন্যতম।

শাসকের মধ্যে শৃগাল ও সিংহের সমন্বয়ঃ আধুনিক চিন্তাবিদ মেকিয়াভেলী রাষ্ট্রদর্শনে এমন কতকগুলো নতুন নতুন ধারার সংযোগ করেন যেগুলো আধুনিক ইউরোপে প্রচলিত কিন্তু মধ্যযুগের রাষ্ট্রদর্শনে সম্পূর্ণ অপ্রচলিত ছিল। মেকিয়াভেলীর ‘The Prince’ গ্রন্থের মূল লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা। এজন্য তিনি সরকার পরিচালনার কতকগুলো বাস্তব পরামর্শ ও উপদেশ প্রদান করেছেন। নিম্নে তা আলোচনা করা হলোঃ

(১) সাহসিকতা, তেজস্বিতা, প্রবল ধীশক্তিঃ শাসকের প্রবল সাহস ও তেজস্বিতা রাষ্ট্রের শান্তি- শৃঙ্খলা কাঁয়েম এবং সুষ্ঠুভাবে শাসন পরিচালনার জন্য প্রয়োজন হয়। তবে শাসককে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও প্রবল ধী-শক্তির অধিকারী হতে হবে। উপরিউক্ত গুণের যিনি অধিকারী হবেন। তিনিই উত্তম শাসক হতে পারবেন।

(২) মানবচরিত্রঃ মেকিয়াভেলী মানবচরিত্র সম্বন্ধে অত্যন্ত নিষ্ঠুর কিন্তু বাস্তব ধারণা বর্ণনা করেন। তার মতে, মানুষ অত্যন্ত স্বার্থপর। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মানুষ পিতৃবিয়োগের কথা যত শীঘ্র বিস্মৃত হয় সেরূপ পিতৃসম্পত্তি খোয়া গেলে হয় না। মানবচরিত্র সম্পর্কে তার এ মূল্যায়ণ আধুনিক যুগে সর্বত্র উদ্ভাসিত।

(৩) ভীতির সঞ্চার করাঃ মেকিয়াভেলীর মতে, শাসককে সবসময় লক্ষ্য রাখতে হবে নিষ্ঠুরতা, চাতুর্য বা প্রতারণা যেভাবেই হোক না কেন মানুষের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করতে হবে। একমাত্র ভীতি উদ্রেকের মাধ্যমে মানুষকে বশীভূত করা যায়, ভালোবাসা বা অন্য কোন পদ্ধতির মাধ্যমে নয়।

(৪) জনগণের বন্ধুত্বঃ মেকিয়াভেলীর মতে, শাসককে সর্বক্ষণ জনগণের বন্ধুত্ব অর্জনে নিয়োজিত থাকতে হবে। বিপদের দিনে জনগণই তার একমাত্র বন্ধু বা সহায়। তবে স্বার্থান্বেষী বা উচ্চাভিলাষী অভিজাত সম্প্রদায় সম্বন্ধে সর্বদা তাকে সজাগ থাকতে হবে। কেননা, তারা বিপদের দিনে সুযোগ পেলে তাকে গুপ্ত শত্রুর মতো সম্পূর্ণরূপে উৎখাত করতে বদ্ধ পরিকর হয়ে ওঠবে।

(৫) রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষাঃ একজন শাসককে তার শাসনক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য যে মুনি-ঋষির মতো সাধুবাবাজী হতে হবে এমন নয়, কারণ তার করণীয় ও কৃতকর্মের একমাত্র মাপকাঠি হলো রাষ্ট্রের স্বার্থ সংরক্ষণ। মেকিয়াভেলী বলেন- ‘যখন কোন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে তখন কোনটি ন্যায় কোনটি অন্যায় ইত্যাদি বিবেচনা করা চলবে না।’

(৬) সৎ গুণাবলী অর্জনঃ রাষ্ট্রনায়ককে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অবশ্যই সৎ গুণাবলী অর্জন করতে সচেষ্ট হতে হবে। তবে বাস্তবক্ষেত্রে সব সদগুণাবলী অর্জন করা বা তা প্রয়োগ সম্ভবপর হয় না বলে, যা নাই তাও আছে, এমন একটা ভাব দেখাতে হবে।

(৭) নিষ্ঠুরতা ও ছলনার আশ্রয়ঃ শাসকের জন্য বিশ্বস্ত হবার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। মানুষ ভালো নয় বলে শাসকও ভাল হতে পারে না। দুষ্টের দমনের জন্য শাসককে নিষ্ঠুরতা ও ছলনার আশ্রয় নিতে হয়। এর মধ্যে অন্যায় বা অবিচার বলতে কিছু নেই। বরং শঠতার আশ্রয় নেয়াকে তিনি বিচক্ষণতার পরিচায়ক বলে বর্ণনা করেছেন।

(৮) শঠতা ও প্রতারণার আশ্রয়ঃ মেকিয়াভেলীর মতে, রাষ্ট্রনায়কদের পোশাক-পরিচ্ছেদ, আচার-আচরণ এমন হতে হবে যেন দেখলেই মনে হয় তিনি সৎ, চরিত্রবান, জনকল্যাণকামী, ন্যায়পরায়ণ ও ধার্মিক ব্যক্তি। তবে শাসনক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য উল্লিখিত গুণাবলী মানুষকে দেখানোর ভান করবে কিন্তু ভেতরে ভেতরে শাসক শঠতা ও প্রতারণার আশ্রয় নেবে।

(৯) সিদ্ধান্ত গ্রহণঃ মেকিয়াভেলীর মতে, অনেক সৎ ও ন্যায়পরায়ণ শাসক রাষ্ট্রের যথেষ্ট কল্যাণ সাধন করা সত্ত্বেও শাসনক্ষমতা হারিয়েছেন। অনেক শাসক বহু অন্যায়-অত্যাচার করা সত্ত্বেও নিজ রাজ্যের নিরাপত্তা ও ক্রমোন্নতি সাধন করেছেন, এতে শাসনক্ষমতা আরো জোরদার হয়েছে।

(১০) শক্তিশালী আইনঃ একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে শক্তিমান আইন প্রণেতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মেকিয়াভেলীর মতে, নাগরিকের সদগুণাবলী ও নৈতিকতাবোধ গঠনের জন্য উপযুক্ত আইন আবশ্যক এবং একজন বিজ্ঞ শাসক আইনের সাহায্যেই জনগণের বাহ্যিক কার্যাবলী ও অভ্যন্তরীণ চিন্তাধারাকে নিয়ন্ত্রণ করবে।

(১১) কূটনৈতিক দক্ষতা সম্পন্নঃ ম্যাকিয়াভেলি তার ‘The Prince’ গ্রন্থে শাসকের কূটনৈতিক দক্ষতা অর্জনের উপর জোর দেন। তিনি বলেন, শাসককে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ যেকোনো সমস্যা সমাধানে শিয়ালের চারিত্রিক রূপ গ্রহণ করতে হবে। সর্বদা সাহসী পদক্ষেপ দ্বারা সফল হওয়া যায় না।

(১২) দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধকরণঃ ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য শাসককে ন্যায়বোধ বা নৈতিকতার দোহাই দিয়ে জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে বলেছেন। এতে শাসককে অবশ্যই শিয়ালের ন্যায় ধূর্ততার পরিচয় দিতে হবে।

(১৩) জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা রক্ষাকারীঃ ম্যাকিয়াভেলির মতে, জনগণের সম্মতি অর্জনের জন্য একজন শাসককে সুকৌশলে জনগণের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। কেননা মানুষ তার পিতৃহন্তাকে ক্ষমা করলেও পৈতৃক সম্পত্তি হরণকারীকে ক্ষমা করে না।

(১৪) ভ্রান্ত পথ সম্পর্কে অবগতিঃ ম্যাকিয়াভেলির মতে, শাসকের উচিত কোনো পথ ভালো আর কোনো পথ মন্দ তা পূর্ব থেকেই জেনে রাখা। এতে একজন শাসক প্রয়োজন অনুযায়ী ভালো বা মন্দপথ অবলম্বন করে রাষ্ট্রের মঙ্গলসাধন করতে পারেন।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, যেমকিয়াভেলী তার সমসাময়িক রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় ঐক্য, নিরাপত্তা, শান্তি, শৃঙ্খলা এবং রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করার জন্য তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘The Prince’-এ শাসককে যে পন্থা অবলম্বন করতে বলেছেন তা আধুনিক বা বর্তমান জাতি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য এবং অপরিহার্য।