প্রশ্নঃ আইনের উৎসগুলাে আলােচনা কর।
অথবা, আইনের উৎস সম্পর্কে অধ্যাপক হল্যান্ড যে মতামত ব্যক্ত করেছেন তা আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ আধুনিক সমাজে আইন মানুষের পরিচালক রূপে ভূমিকা পালন করে। বৃহত্তর সমাজ জীবন ও রাষ্ট্রীয় কাঠামাের দ্বারা আইনের প্রকৃতি নির্ধারিত হয়ে থাকে। আইনের যথার্থ স্বরূপ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতি, জীবনধারা ভাব ও নীতির ওপর নির্ভরশীল। বস্তুত আইন হলাে মানুষের আচার-ব্যবহার ও চিন্তাধারার বিধিবদ্ধ রূপ।

আইনের সংজ্ঞাঃ প্রচলিত অর্থে আইন বলতে নিয়ম-কানুন বা বিধি-বিধানকে বুঝায়। মানুষ যেসকল বিধি সমাজে মেনে চলে, তাকে সামাজিক আইন বলা হয়। সমাজে মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যেসকল বিধি-বিধান চালু করা হয় সেগুলিকে রাষ্ট্রীয় আইন বলা যেতে পারে।

আইনের উৎসসমূহঃ রাষ্ট্রই সকল ক্ষমতার উৎস। কিন্তু রাষ্ট্র ছাড়াও আইনের অনেক উৎস রয়েছে। সাধারণভাবে আমরা আইনের ছয়টি উৎসের কথা আলােচনা করব। এসব উৎসগুলাে হচ্ছে- প্রথা, ন্যায়বিচার, ধর্ম, আইনজ্ঞদের ভাষ্য, বিচারের রায় এবং আইন প্রণয়ন। নিম্নে এসব উৎস সম্পর্কে আলােচনা করা গেল।

(১) প্রথাঃ প্রথা আইনের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন উৎস। প্রাচীনকালে সামাজিক প্রথার মাধ্যমেই সমাজ পরিচালিত হতাে। ম্যাকাইভারের ভাষায়, আইনের বিরাট গ্রন্থে রাষ্ট্র দুই একটি ছত্র কেটে দেয় এবং দু’একটি ছত্র সংশােধন করে। মানুষ যেমন তার দেহকে নতুন করে গঠন করতে পারে না। রাষ্ট্র তেমনি আইনকে নতুনভাবে রূপ দিতে পারে না। প্রচলিত প্রথা আইনের উত্থান-পতনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। প্রথাগত বিধানের ওপর ভিত্তি করেই ইংল্যান্ডের শাসনতন্ত্র গড়ে ওঠেছে।

(২) ন্যায়বিচারঃ ন্যায়বিচার বলতে প্রকৃতপক্ষে নিরপেক্ষতা ও ন্যায্য রায়কেই বুঝায়। বিচারকার্য সম্পন্ন করতে গিয়ে অনেক সময় বিচারকগণ কোনাে বিশেষ মামলার প্রচলিত আইনের সাহায্যে ন্যায়বিচার করতে পারেন। এক্ষেত্রে বিচারকগণ পরিবর্তনশীল সমাজের ন্যায়বােধের সাথে তাল মিলিয়ে নিজস্ব ন্যায়নীতি, প্রয়ােগ করে থাকেন। এর ফলে নতুন আইন জন্ম নেয়।

(৩) ধর্মঃ প্রাচীনকালে ধর্ম ও আইন এমনভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিল যে কোনটি আইন, আর কোনটি ধর্মীয় অনুশাসন তা নির্দিষ্ট করা কঠিন ছিল। ধর্ম প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে আইনের বিবর্তনে সাহায্য করেছিল। এই উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলিম আইন ধর্মীয় বিধি থেকেই জন্ম নিয়েছে। সুতরাং ধর্মও আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

(৪) আইনজ্ঞদের ভাষ্যঃ বিখ্যাত আইনবিদদের ব্যাখ্যা ও আলােচনা আইনের প্রকত অর্থ, অভিপ্রায় ও রহস্য উদঘাটন করে। আইনজ্ঞগণ বর্তমান ও প্রাচীন তথ্যের তুলনামূলক পর্যালোচনা করে আইনের ব্যাখ্যা ও রূপদান করেন। ব্রিটেনের আইন ব্যবস্থায় কোক, ব্লাকস্টোন, কেন্ট প্রমুখ আইনবিদদের বিশেষ অবদান আছে।

(৫) বিচারের রায়ঃ আদিম সমাজে ধর্ম ও প্রথার ওপর ভিত্তি করে বিবাদ ও সংঘাত মিটিয়ে ফেলা হতাে। কিন্ত সমাজ জীবন ক্রমগতিতে জটিল হয়ে পড়ায় ধর্ম ও প্রথার স্থান দখল করেছে বিচারব্যবস্থা। রাজাগণ প্রথা ও আইনের মধ্যে সব সময় সমাধান খুঁজে না পেলে তাকে বিচার-বুদ্ধির আশ্রয় নিতে হতো। এভাবে বিচারের রায় আইনে পরিণত হয়। জনৈক আমেরিকান বিচারপতি বলেন, বিচারপতিগণ অবশ্যই আইন প্রণয়ন করেন ও চিরকালই তা করে যাবেন।

(৬) আইন প্রণয়নঃ আধুনিককালে আইনসভা কর্তৃক আইন প্রণয়ন আইনের একটি বিরাট উৎস হিসেবে দেখা দিয়েছে। আধুনিক গণতান্ত্রিক যুগে আইন সভাই জনমত, প্রথাগত নিয়ম-কানুন, ন্যায়-নীতি ইত্যাদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আইনে রূপদান করে। আইন সভার সদস্যবৃন্দ জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেই আইন প্রণয়ন করে থাকেন।

(৭) জনমতঃ আইনের উৎস হিসেবে জনমত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আইনসভার সদস্যগণ জনগণের প্রতিনিধি। জনমতের বাস্তব প্রতিফলন ঘটানাে তাদের অন্যতম দায়িত্ব। কাজেই আইনসভায় যেকোনাে আইন প্রণয়নের সময় জনমতের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হয়।

(৮) সংবিধানঃ সংবিধান আইনের সবচেয়ে বড় উৎস। সংবিধান বিশেষ দলিল। আইনসভা ও অন্যান্য সরকারি বিভাগের ক্ষমতা সীমিত ও তাদের কার্যকর প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধান তৈরি করা হয়। সংবিধানে বিভিন্ন ধরনের বিধানাবলী লিপিবদ্ধ থাকে যেগুলাে আইনসভা এবং সরকারের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।

(৯) নির্বাহী ঘােষণা ও ডিক্রীঃ বর্তমান যুগে বিভিন্ন কারণে আইনসভা তার কর্তৃত্বকে শাসনবিভাগের মাধ্যমেও পরিচালিত করে। এ অবস্থায় শাসনবিভাগের জারিকৃত ঘােষণা ও আদেশগুলােও আইনে পরিণত হয় । তাই প্রশাসনিক আইনের উৎস নির্বাহী ঘােষণা ও ডিক্রী গুরুত্বপূর্ণ।

(১০) বিজ্ঞানসম্মত আলােচনাঃ বিশিষ্ট আইনবিদদের বিজ্ঞানসম্মত পর্যালােচনাও আইনের আরেকটি উৎস। তাদের মতবাদ যুক্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তবে সরাসরি সিদ্ধান্ত হিসেবে নয়। বিজ্ঞানসম্মত আলােচনার স্বীকৃতিস্বরূপ একে বিচারকের সিদ্ধান্ত বলে গণ্য করা হয়।

(১১) আন্তর্জাতিক আইনঃ বর্তমানে আন্তর্জাতিক আইনকে আইনের উৎস হিসেবে ধরা হয়। কেননা আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমেই রাষ্ট্রসমূহ তাদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

(১২) প্রশাসনিক ঘােষণাঃ প্রশাসনিক ঘােষণা ও আইনের অন্যতম একটি উৎস। আইনসভা কর্তৃক অর্পিত নির্বাহী ক্ষমতা বলে শাসনবিভাগের কর্মকর্তাগণ বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাহী ঘােষণা ও ডিগ্রী প্রদানের দ্বারা নতুন আইনের সৃষ্টি করেন।

(১৩) বৈদেশিক চুক্তিঃ সাধারণত বৈদেশিক চুক্তিগুলাে শাসনবিভাগ দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রায় দেশেই বৈদেশিক চুক্তি ঘােষিত হওয়ার পর তা আইনসভায় গৃহীত হয়ে আইনে পরিণত হয়। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোনাে বৈদেশিক চুক্তি ঘােষিত হওয়ার আগেই আইনসভার অনুমােদন লাভ করতে পারে ।

(১৪) বিন্যস্তকরণঃ আইনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে তাদের যথাযথভাবে বিন্যস্তকরণের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয় অনেকাংশে। প্রাচীনকালেও আইনের এ বিন্যস্তকরণ প্রক্রিয়া প্রচলিত ছিল এবং আধুনিককালেও এটার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণে। ফরাসি সমাট নেপােলিয়নের ‘Napoleon Code’ আধুনিক আইন বিন্যস্তকরণের একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। আইনের সুবিন্যস্তকরণের ফলে আইনের ক্ষেত্রে বেশ পরিবর্তন সূচিত হয়। কাজেই বিন্যস্তকরণ আইনের একটি বিশেষ উৎস বলে খ্যাত।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, আইন যেমন রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অপরিহার্য তেমনি সুশৃঙ্খলভাবে মানব . জীবন পরিচালনার জন্যও অপরিহার্য। কারণ আইনের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া মানুষ সভ্য ও শৃঙ্খল হতে পারে না। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের অন্যতম প্রধান উৎস হলাে আইন সভা। যদিও আইনসভা আইন প্রণয়ন করে থাকে তথাপিও। সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন মহল বা বিষয়াদি হতে বিভিন্ন উপাদান আইনসভাকে আইন প্রণয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে । অতএব অনেক কিছুর সমন্বয়েই আইন পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে।