প্রশ্নঃ অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের শিল্পসাৰ্থকতা আলােচনা কর।

অথবা, তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের শিল্পমূল্য বিচার কর।

অথবা, উপন্যাস হিসেবে অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর সার্থকতা বিশ্লেষণ কর।

উত্তরঃ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ অবজ্ঞাত নিরক্ষর জনজীবন নির্ভর ধ্রুপদী উপন্যাস। অদ্বৈত মল্লবর্মণ [১৯১৪ ১৯৫১)-এর এ-উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল রত্ন। অদ্বৈত প্রতিভার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম হচ্ছে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ (১৯৫৬]। নদী-তীরবর্তী অন্ত্যজ মানবপ্রবাহের ভাঙা-গড়ার ছন্দে আন্দোলিত জীবনের বিশাল ক্যানভাস অবলম্বিত হয়েছে এ উপন্যাসে। এ উপন্যাসটি সমগ্র বিশ্বের নদীমাতৃক জেলে জীবনােপাখ্যানের মহাকাব্য।

উপন্যাসের কাহিনি-বিন্যাসঃ অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে মূলত অন্ত্যজ শ্রেণির জীবন রূপায়িত হয়েছে। তিতাস নদী-তীরে বসবাসকারী মালােদের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা-চিত্রের, সমন্বয়ে তাদের জীবনের সামগ্রিক রূপটি যেন এক বিশাল ক্যানভাসে এঁকেছেন ঔপন্যাসিক। ফলে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, আচার-আচরণ, রুচি সংস্কৃতি, ধর্মীয় অনুভূতি প্রভৃতি প্রত্যক্ষ-পরােক্ষভাবে স্থান পেয়েছে এ উপন্যাসে। মালােদের জীবন ধারণের একমাত্র অবলম্বন তিতাস নদী। তিতাসের সঙ্গে তাদের জীবন সম্পর্কের যে খণ্ড খণ্ড চিত্র তৈরি হয় নিত্য, তারই আলেখ্য এ রচনা। ফলে এ উপন্যাসের কাহিনিও যেমন তিতাসকে নিয়ে আবর্তিত, চরিত্রগুলাের বিকাশও ঘটেছে তেমনই তিতাসকে অবলম্বন করে। এ উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ মালােদের সংস্কৃতির জীবন্ত চিত্র অঙ্কন করেছেন। বাসন্তীরা সেই সংস্কৃতি আজীবন লালন করে। প্রকৃতির অমােঘ নিয়মে মালােরা চিরবঞ্চিত হলেও বৈরী শক্তির বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদী হয়। তিতাসে অদ্বৈত সামাজিক সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদীর তীরবর্তী মালাে/জেলেদের কর্ম-ধর্ম-স্বপ্ন সংস্কৃতিভিত্তিক জীবন নিয়ে রচিত। শুধু এ অঞ্চলের মানুষের কাহিনি এবং তার সীমার মধ্যেই সেটি আবদ্ধ থেকেছে। এমনকি কাহিনিটি নিকটস্থ কুমিল্লাতেও বিস্তৃত হতে পারেনি। সে কারণে উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে একটি অঞ্চলভিত্তিক। সেদিক থেকে বলা যেতে পারে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ একটি ভৌগােলিক অঞ্চল নির্ভর হয়ে সূচিত ও বিকশিত হয়েছে। ঐ অঞ্চলের অখণ্ডতা কাহিনির কোন পর্যায়ে খণ্ডিত হয়নি। উক্ত অঞ্চলের বাইরের মানুষ ও প্রকৃতির ব্যাপক কোন খোঁজ খবরও উপস্থাপিত হয়নি এ রচনায়। উপন্যাসটির নির্দিষ্ট ভৌগােলিক পরিসরের মধ্যে থেকে উপন্যাসের চরিত্রগুলো নত সংগ্রামশীল থেকে বেঁচে থাকার জন্য। চলমান জীবনে তাদের দুঃখবহ পরিণতি রচনার কুশলতায় গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। এসব বৈশিষ্ট্যের আলােকে তিতাস একটি নদীর নাম’কে অনেকে আঞ্চলিক উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে একজন সমালােচন বলেছেনঃ

“তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় যে জীবনকে অঙ্কন করেছেন, সে জীবন নগর কেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত মানসের অভিজ্ঞতা বহির্ভূত। তিতাস বিধৌত জনপদের স্থানিক বর্ণনার সঙ্গে সে অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার বিশ্বস্ত রূপায়ণসূত্রে এ উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। বাংলাদেশের আঞ্চলিক উপন্যাস সাহিত্যে এটি একটি কালজয়ী সংযােজন।”

উপন্যাসের সাংগঠনিক বৈশিষ্ট্য/গঠনশৈলীঃ তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটি লেখকের সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণে রচিত। সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণে উপন্যাসটি রচিত হওয়ায় এর ঘটনাংশ হয়ে উঠেছে এতদঞ্চলের সমগ্রতাবােধ-উৎসারিত। এ উপন্যাসে লেখক প্রধানত বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতি ব্যবহার করলেও কখনাে কখনাে তিনি গীতময় ও চিত্রময় অনুষঙ্গও ব্যবহার করেছেন। উপন্যাসটি চার খণ্ডে বিভক্ত। প্রতিটি খণ্ডে রয়েছে দুটি করে পর্ব। যেমনঃ

১. তিতাস একটি নদীর নাম ও প্রবাস খণ্ড,

২. নয়া বসত ও জন্ম মৃত্যু বিবাহ,

৩. রামধনু ও রাঙা নাও।

৪. দুরঙা প্রজাপতি ও ভাসমান।

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের ক্ষেত্রে উপন্যাস নির্মাণের শর্তাবলি প্রায় নিখুঁতভাবে পালিত হয়েছে। এ উপন্যাসে কিছু কিছু অংশে নাটকীয় আবহ নির্মাণ করা হয়েছে; নাটকীয় বৈশিষ্ট্য এ-উপন্যাসে একটি বিশেষ গুরুত্বসহকারে উপস্থাপিত। এ-উপন্যাসে তিতাস তীরের জেলেদের জীবনের নানা স্বপ্ন-সংগ্রাম ব্যর্থতা অনেকগুলাে ঘটনাই নাটকীয় আবহে আঁকা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উপন্যাসের কিছু নাটকীয় বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা যায়ঃ

ক. “দলের ভিতর সেই মেয়েটিকেও দেখা গেল। মার পায়ের দিকে তাকাইয়া সেও তালে তালে পা ফেলিতেছিল। কিশােরের সহিত চোখাচুখি হইয়া সে তাল কাটা পড়িল। পা আর উঠিতে চাহিল না।… অদূরে দাঁড়াইয়া কিশাের তাহাকেই দুই চোখের দৃষ্টি দিয়া যেন গ্রাস করিতেছে।

…ইহারই পটভূমিকায় কিশাের মূৰ্ছিতা মেয়েটাকে পাজা কোলা করিয়া তুলিয়া ঘন ঘন হাঁকিতে লাগিল, এর মা কই, এর মা কই? সে অজ্ঞান হইয়া গেছে। জল আন, পাংখা আন।”

খ. “পা টিপিয়া চলার শব্দ আর চাপা গলার ফিসফাস কথা বলার আওয়াজ প্রথমে তিলকের মনোযােগ আকৃষ্ট করিল। নাঃ. কিশােরটা বেহায়ার হদ্দ। তাকে নিয়ে আর পারা যাইবে না। বিরক্ত হইয়া তিলক পাশ ফিরিয়া শুইতেছিলাে। এমন সময় পায়ে জোরে একটা টান পড়ায় তার তন্দ্রা পাতলা হইতে হইতে একেবারে ভাঙ্গিয়া গেল। পুরা সম্বিৎ পাইয়া দেখে, ছইয়ের ভিতরে শুইয়াছিল, তারা তিনজনেই এখন ছইয়ের বাইরে। আর তিনজনেরই পা নৌকার গুরার সঙ্গে দড়ি দিয়া বাঁধা। নৌকা আর সেই খাড়ির ভিতরে নাই। হু হু করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে নয়া গাঙের সর্বনাশা মােহনার দিকে।”

গ. “তিলক চিৎকার করিয়া উঠিল, ‘অ কিশাের, আর কত ঘুমাইবা, চাইয়া দেখ সর্বনাশ হইয়া গেছে। একে ঝটকায় | পায়ের বাঁধন ছিড়িয়া কিশাের এক নিঃশ্বাসে ছইয়ের ভিতরে গিয়া পাটাতন খুলিল। সে নাই।”

বস্তুত অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাসই পেয়েছে বদ্বীপ-ভূমির নদ চুম্বিত গঠনশীল-নিত্য জায়মান ও চকিতে ভেঙে যাবার অনিশ্চিত জীবনের ছকটিকে আয়ত্ত করতে। মালােদের জীবন প্রবাহের মধ্য দিয়েই তৈরি হয়েছে উপন্যাসের অসংখ্য চরিত্র। এইগুলাের আগমন প্রস্থানের সময়কালই যেন কাহিনির ভিত্তি হিসেবে গড়ে উঠেছে। মালােদের অনির্দিষ্ট জীবনপ্রবাহ। ও অনির্দিষ্ট নদী-প্রবাহ এ উপন্যাসের গঠনশৈলীর উপরও যেন প্রভাব ফেলছে। এ সম্পর্কে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেনঃ

“এ উপন্যাসটির গঠন নির্দোষ নহে। উহার ঘটনা বিন্যাস এককেন্দ্রিক নহে, বহুস্তর বিভক্ত; উহার প্রধান চরিত্রসমহ বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন। উহার ঘটনা পরিণতিও নানা বিচ্ছিন্ন, কিন্তু একভাবে সূত্র গ্রথিত আখ্যানের যােগফল, কোন বিশেষ চরিত্রের অনিবার্য ক্রমবিকাশাভিমুখী নহে।…বদ্ধমূল সংস্কৃতি চর্চায়। কোন ব্যক্তি বিশেষের নয়, এই সমষ্টি জীবনের চিত্রাঙ্কনে তাহার প্রতিভার বৈশিষ্ট্য।”

শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ কথারই প্রতিধ্বনি লক্ষ্যযােগ্য অন্য একজন সমালােচকের কথায়:

“মানুষ ও প্রকৃতির বিশাল পটভূমিতে তিনি আসলে এই উপন্যাসে নদী ও মানুষের এক চিরায়ত যুগলবন্দী রচনা করেছেন।”

সমষ্টি জীবনের চিত্রাঙ্কনের সাফল্য দিয়েছে এ উপন্যাসকে শিল্প মর্যাদা একই প্রেক্ষাপটে বিবেচ্য এর কাহিনি, চরিত্র, আষা, সংলাপ, পরিবেশ, এমনকি লেখকের জীবনবােধও। ;তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের কাহিনি ও চরিত্রের গঠন আক্রয়া অগ্রসর হয়েছে ছোটো ছােটো ঢেউয়ে আবর্তিত হয়ে কিছু দূর পর পর বাঁক নেওয়া নদীর মতাে। প্রায়ই একটি নতুন মােড়, একটি নতুন ঘটনা, একটি নতুন চরিত্র, একটি নতুন পরিবেশ। তবে সবকিছুরই উৎস এক। বিশাল বিস্তৃত এই কাহিনি পূর্বেই সুপরিকল্পিত এমনটি বলা কঠিন। কিন্তু গভীরভাবে মনোেযােগ দিয়ে উপলব্ধি করা যা শিল্পসৃষ্টির আগ্রহের সঙ্গে কাহিনির যেন একটি আত্মিক মিল রয়েছে।

চরিত্ৰায়ণ-কৌশলঃ উপন্যাসের শিল্পরূপ আলােচনায় কাহিনির মতাে চরিত্রও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষকরে কাহিনির গঠনগত বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ কাহিনিতে ঔপন্যাসিক তিতাস তীরের মালােদের জীবন বৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন। উপন্যাসটির নির্দিষ্ট ভৌগােলিক পরিসরের মধ্যে থেকে উপন্যাসের চরিত্রগুলাে নিয়ত সংগ্রামশীল থেকে বেঁচে থাকার জন্য। ফলে নানা প্রসঙ্গে উপন্যাসে এসেছে প্রায় অর্ধশত নাম। প্রতিটি নামই কোন না কোন ভাবে উপন্যাসের কাহিনিতে রেখেছে কম-বেশি ভূমিকা। অবশ্য বিনা কারণে কোন চরিত্রের উপস্থিতি খুব একটা লক্ষ করা যায় না। এ উপন্যাসটিতে শিশু-যুবা-বৃদ্ধ সব বয়সের চরিত্রের রয়েছে উপস্থিতি। এ উপন্যাসে ঔপন্যাসিক কেন্দ্রীয়ভাবে এমন কোন একটি চরিত্রকে বিকশিত করেন নি, যাকে ঘিরে আবর্তিত হতে পারতাে অন্যান্য চরিত্র। তিতাসকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসের প্রায় প্রতিটি চরিত্র বিকাশ লাভ করেছে। বস্তুত সাধারণভাবে তিতাস ছাড়া কোন চরিত্রই বিকশিত হয়নি।

অনন্ত ও রমু উপন্যাসের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ শিশু চরিত্র। লেখক বিশেষকরে অনন্তর মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক সমাজ, সংস্কৃতি ও প্রকৃতির নানা বিষয় তুলে ধরতে চেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে একজন সমালােচক বলেনঃ

“অনন্ত আর রমু মালােদের পরিবার চ্যুত একলা একটি বালক আর চাষি মুসলমান একটি সচ্ছল পরিবারের একমাত্র উত্তরাধিকারী বালক, এই দুইয়ের মারফৎ গড়ে উঠেছে তিতাসের অন্দর্বয়ন। নিপুণ সেই বুনট। আর সভ্যতা-সংস্কৃতির আদি যুগের বার্তা থাকায় এই দু’টি চরিত্রের দৃষ্টিকোণ উপন্যাসের এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভাষ্য বা পাঠ রচনা করে।”

প্রকৃতপক্ষে উপন্যাসে চারজনের [তিলক, সুবল, কিশাের আর অনন্তর মা] অন্তর্গঢ় জীবন রহস্যের চিত্ররূপ উন্মােচিত হয়েছে। ঐ চারজনের সাদামাটা জীবনেরই এক বাস্তব আলেখ্য বাসন্তী। বাসন্তী চরিত্রটি এ উপন্যাসের চরিত্রগুলাে বিকাশে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছে। অদ্বৈত মল্লবর্মণ উপন্যাসের চরিত্রগুলাের বিকাশের সাথে এদের জীবনের নানা জটিলতাকে উন্মােচন করেছেন। মালােদের নিখুঁত জীবনালেখ্য তৈরিতে যেমন তেমনি চরিত্র চিত্রণেও অদ্বৈত কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে বাংলাদেশের একান্ত ঘরের মানুষের কথা জানা যায়, চেনা জানা পরিবেশকে স্পর্শ করা যায়, যে কথা একান্ত আপনার সে সব কথার প্রতিধ্বনি শােনা যায়।

ভাষাশৈলীঃ তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের একটি অতি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য এর ভাষা। আজন্ম পরিচিত জীবন ও পরিবেশের ঘটনাবলি যেন বাঙময় হয়ে উঠেছে তিতাসকেন্দ্রিক মালােদের নিত্য ব্যবহৃত ভাষা থেকে গৃহীত ও সুপ্রযুক্ত শব্দাবলির মাধ্যমে। গ্রন্থটি মূলত সাধু গদ্যে লিখিত হলেও সাধুরীতির সঙ্গে মাঝে মধ্যে চলিত রীতির গদ্যও লেখক ব্যবহার করেছেন। একই সঙ্গে তিনি আঞ্চলিক ভাষারও আশ্রয় নিয়েছেন। ভাষা ব্যবহারেও এ পদ্ধতি অবলম্বন করে ঔপন্যাসিক পরিচয় দিয়েছেন বাস্তবতাবােধের। সাধু ও চলিত রীতির মিশ্রণের কারণে উপন্যাসে মেলে মিশ্র ভাষারীতি। নিচে উদ্ধৃত কয়েকটি উদাহরণ থেকে এ বিষয়টি লক্ষ করা যাবেঃ

ক. এই কালকের থেকেই যেন আজ তাকে অনেকখানি বড় দেখাইতেছে।

খ. যারা মরিয়া গিয়াছে তারা রক্ষা পাইয়াছে। যারা বাঁচিয়া আছে তারা শুধু ভাবিতেছে, আর কতদূর।

গ, এরা যেদিন মাসীর মতই তাকে পর করিয়া দিবে সেদিন সে কোথায় যাইবে।

অদ্বৈত মল্লবর্মণ কখনাে অপ্রচলিত তৎসম শব্দ ব্যবহার করেননি। এখানে ব্যবহৃত প্রায় প্রতিটি শব্দই বিভিন্ন বাংলা গল্প উপন্যাস প্রবন্ধে বার বার ব্যবহৃত। ফলে তার রচনা হয়েছে সাধারণভাবে সুখপাঠ্য ও সাবলীল। তার উপন্যাসে বােধগম্য শব্দ ভাণ্ডারের সঙ্গে রয়েছে পেশাগত শব্দাবলির উপস্থাপনা। তিতাস তীরের মুসলমান চাষিদের অনুষঙ্গে এসেছে নানা শব্দ। যেমন আল্লাহ, গজব, ফজর, কেরায়া, দেওয়ানা, বেহুদা, কিসিম ইত্যাদি। এ উপন্যাসের বহু বাংলা আঞ্চলিক শব্দাবলি ব্যবহৃত হয়েছে ব্যাপকভাবে।

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে মালােদের জীবন সংগ্রামকে রূপায়িত করতে গিয়ে সংলাপে আঞ্চলিক ব্যবহারের কারণে তা হয়েছে বাস্তবতা নির্ভর। উপন্যাসের প্রথম পর্যায় থেকে শেষ অবধি ঘটনা বিন্যাসে ব্যবহৃত বহু আঞ্চলিক শব্দের সমন্বয়ে সৃষ্ট বাক্যসমূহ সৃষ্টি করেছে নানা বৈচিত্র্য। এ বৈচিত্র্য যেন ভারসাম্য রচনা করেছে তিতাসের জল ও জীবন প্রবাহের মধ্যে। তবে, লেখক পারতপক্ষে দুর্বোধ্য আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেননি। এ উপন্যাসে যথেচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছে সাধু ও চলিত মিশ্রিত রীতিতে তৈরি সংলাপ। এ ভাষারীতির উদাহরণ-

ক. এমন টালাইন্যা গিরস্তি কতদিন চালাইবা। নাও করবা, জাল করবা, সাউকারি কইরা সংসার চালাইবা! এই কথা আমার বাপের কাছে তিন সত্য কইরা তবে ত আমারে বিয়া করতে পারছ। স্মরণ হয় না কেন?

খ. বঁড়িরে শেষ খাওন খাওয়াইয়া দেই, আর ত কোনদিন খাইত আইব না।

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে ব্যবহৃত হয়েছে অসংখ্য বাগধারা বা প্রবাদ প্রবচন। এগুলাের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে তিতাস তীরবর্তী মানুষের মনােভঙ্গি, বিশাস-সংস্কার উপলব্ধি ও তাদের জীবন অভিজ্ঞতা। উপন্যাসে ব্যবহৃত এসব প্রবাদ-প্রবচন ফুটিয়ে তুলেছে মালােদের লােজ অভিজ্ঞতা ও বৈশিষ্ট্য। উপন্যাস থেকে কয়েকটি উদাহরণ নেওয়া যায়ঃ

কাকের মুখে সিন্দুইরা আম; তবে ঘটে দেও বেলপাতা, মা মরলে বাপ তালই/ভাই বনের পশু, ধানের মধ্যে খামা/কুটুমের মধ্যে মামা, শিবের মতন চোখ, আ ঘটাতে চন্দ্র উদয়, চৌদ্দ সানকির তলা প্রভৃতি। এসব বাগধারা বা প্রবাদ প্রবচন সংগ্রহ ও ব্যবহারের মাধ্যমে অদ্বৈত মল্লবর্মণ বাংলা উপন্যাসে সাহিত্য তথা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।

উপন্যাসটিতে ব্যবহৃত ভাষা লেখকের নিজ অভিজ্ঞতা থেকে সংগৃহীত এবং সে ভাষা তিতাস তীরবর্তী জনজীবন উপস্থাপনের তাগিদে ব্যবহৃত। অদ্বৈত মল্লবর্মণ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে নিজের বর্ণনায় অনেকে লােকজ শব্দের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। ঠিসারা, সাইত, টুরি, জলবাইস ইত্যাদি জনজীবনের শব্দ উপন্যাসে রয়েছে। অদ্বৈত চরিত্র অনুযায়ী সংলাপ জুড়ে কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। করমালী ও বন্দেআলীর মধ্যে সংলাপ লক্ষ করলেই তা স্পষ্ট হবেঃ

“খাওয়ার পর কাঁধের গামছায় মুখ মুছিতে মুছিতে পথে নামিয়া বন্দেআলী বলে, ‘ভাই করমালী নিজে ত খাইলাম ঝাগুর মাছের ঝােল। আমার ঘরের মানুষের একমুঠ শাক-ভাত আজ জুটলনি, কি জানি?”

উপসংহারঃ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় যে জীবনকে অঙ্কন করেছেন, সে জীবন নগর-কেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত-মানসের অভিজ্ঞতা-বহির্ভূত। তিতাস-বিধৌত জনপদের বর্ণনার সঙ্গে সে অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রায় বিশ্বস্ত রূপায়ণসূত্রে এ উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তাই সার্বিক বিচারে বলা যায়- বিষয়-নির্বাচন, সাংগঠনিক বৈশিষ্ট্য, ভাষাব্যবহার, চরিত্রায়ণকৌশল বিভিন্ন দিক বিবেচনায় উপন্যাসটি শিল্পসার্থক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছে।