প্রশ্নঃ আলাউদ্দিন খিলজীর রাজ্য বিজয়ের কাহিনী আলােচনা কর।
অথবা, আলাউদ্দিন খিলজীর ভারত বিজয়ের কাহিনী আলােচনা কর
ভূমিকাঃ মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষের ইতিহাসে আলাউদ্দিন খিলজী একজন শ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যবাদী শাসক। তিনি ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরােহণ করে ভারতের এক বিশাল অংশ জয় করে স্বীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এ কারণে ঐতিহাসিক পর্যটক ইবনে বতুতা তাকে One of the best Sultans বলে অভিহিত করেছেন।
আলাউদ্দিন খিলজীর রাজ্য বিজয়ঃ আলাউদ্দিন খিলজীর রাজ্য বিজয়ের প্রয়াসকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- (ক) উত্তর ভারত বিজয়, (খ) দাক্ষিণাত্য বিজয়।
ক. উত্তর ভারত বিজয়ঃ
১. গুজরাট বিজয়ঃ ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, আলাউদ্দিন খিলজীর সর্বপ্রথম অভিযান পরিচালিত হয় গুজরাট রাজা কর্ণদেবের বিরুদ্ধে। তিনি স্বীয় ভ্রাতা উলুঘ খান ও মন্ত্রী নসরত খানকে এ উদ্দেশ্যে ১২৯৭ খ্রিস্টাব্দে গুজরাট প্রেরণ করেন। তারা বাঘেলা বংশীয় রাজা কর্ণদেবকে পরাজিত করেন। কন্যা দেবলাদেবীকে নিয়ে কর্ণদেব দেশ থেকে পালিয়ে যান। এ সুযােগে মুসলিম সেনারা অসংখ্য ধনরত্ন, রাণী কমলা দেবী এবং মালিক কাফুরকে নিয়ে বিজয়ী বেশে দিল্লীতে প্রত্যাবর্তন করেন।
২. ক্যাম্বে দখলঃ গুজরাট বিজয়ের পর আলাউদ্দিন খিলজীর অনুমতিক্রমে তার মন্ত্রী নসরত খান ১২৯৮ খ্রিস্টাব্দে ক্যাম্বে দখল করে দিল্লী সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করেন।
৩. রণথম্ভোর বিজয়ঃ ১২৯৯ খ্রিস্টাব্দে রণথম্ভোরের চৌহানরাজ হাম্বীর দেবের বিরুদ্ধে গুজরাট বিজেতা উলুঘ খান ও নসরত খানের নেতৃত্বে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী প্রেরিত বাহিনী রণথম্ভোর দুর্গ অবরােধ করেন। নসরত খান অবরােধ পরিচালনার সময় নিহত হন। উলুঘ খানও দুর্গ জয়ে ব্যর্থ হন। সামরিক এ বিপর্যয়ের এক বছর পর ১৩০১ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন খিলজী স্বয়ং স্ব-সৈন্যে রণথম্ভোর আক্রমণ করে তা দখল করেন। বিজিত রণথম্ভোরের দায়িত্ব উলুঘ খানের ওপর অর্পণ করে তিনি দিল্লীতে প্রত্যাবর্তন করেন।
৪. চিতাের বিজয়ঃ রণথম্ভোর বিজয়ের পর আলাউদ্দিন খিলজী ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে মেবারের রাজধানী চিতাের আক্রমণ করেন। মেবারের রাজা রতন সিং, তার দু’সেনাপতি গােরা ও বাদল বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেও পরাজিত হয়ে পলায়ন করে। অধিকৃত। চিতােরের শাসনভার শাহজাদা খিজির খানের ওপর ন্যস্ত করা হয়।
৫. মালব বিজয়ঃ গুজরাট, রণথম্ভোর ও চিতাের বিজয়ের পর মালব জয় ছিল স্বাভাবিক পরিণতি। ১৩০৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী মালবের রাজা রায়মল্ল দেবকে পরাজিত করে আইনুল মুলককে মালবের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।
৬. উজ্জয়িনী, চান্দেরী, মান্ড ও ধর বিজয়ঃ ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন, মালব বিজয়ের পর সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী ১৩০৫ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় আক্রমণ করে মালবের উজ্জয়িনী, চান্দেরী, মান্ড ও ধর জয় করে সমগ্র মালবকে নিজ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন।
৭. মারওয়ার বিজয়ঃ ১৩০৮ খ্রিস্টাব্দে রাজস্থানের অন্যতম রাষ্ট্র মারওয়ারের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করে রাজা শীতল দেবকে পরাজিত করে সুলতান আলাউদ্দিন মালিক কামাল উদ্দিন গুজের ওপর তথাকার শাসনভার অর্পণ করেন।
৮, জানলার বিজয়ঃ ড. এ. বি. এম. হাবিবুল্লাহ বলেন, আলাউদ্দীন খিলজী ১৩১১খ্রস্টাব্দে জানলার রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন। যুদ্ধে রাজা কানেরা দেব পরাজিত ও নিহত হন। ফলে জালাের রাজ্য খিলজীর সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। এভাবে সমগ্র উত্তর ভারত বিজয় করে আলাউদ্দিন খিলজী সেখানে তার শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
খ. দাক্ষিণাত্য বিজয়ঃ
১. দেবগিরি বিজয়ঃ ঐতিহাসিক আর. সি. মজুমদার বলেন, দেবগিরির যাদব রাজ্যের রাজা রামচন্দ্র দেব তিন বছর ধরে প্রতিশ্রুত বাৎসরিক কর ও উপঢৌকন প্রদান বন্ধ করে দেন। ফলে ১৩০৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতানের নির্দেশে মালিক কাফুর এক সামরিক অভিযানে তাকে পরাস্ত করে দিল্লীর আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য করেন। কিন্তু রামচন্দ্রের আশ্রিত রাজা কর্ণদেব পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তার কন্যা দেবলাদেবীকে রাজধানীতে এনে মহাসমারােহে যুবরাজ খিজির খানের সাথে বিয়ে দেয়া হয়।
২. বরঙ্গল বিজয়ঃ আলাউদ্দিন খিলজী ১৩০৯ খ্রিস্টাব্দে মালিক কাফুরকে বরঙ্গলের কাকতালীয় রাজা প্রতাপ রুদ্রদেবের বিরুদ্ধে অভিযানে প্রেরণ করেন। রাজা প্রতাপ রুদ্র দীর্ঘ দিন অবরুদ্ধ থেকে নিয়মিত কর প্রদানের সন্ধিশর্তে রাজ্য ফিরে পান।
৩. দ্বারসমুদ্র বিজয়ঃ সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী ১৩১০ খ্রিস্টাব্দের শেষ ভাগে মালিক কাফুরের নেতৃত্বে এক বিরাট বাহিনী দ্বারসমুদ্রের হােয়সল রাজ্যের রাজা তৃতীয় বীর বল্লালের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। এটি ছিল কাফুরের দাক্ষিণাত্যে তৃতীয় অভিযান। মালিক কাফুর সহজেই বল্লালকে পরাজিত করে রাজধানী দ্বারসমুদ্র দখল করেন। বল্লাল সুলতানের আনুগত্য মেনে নিয়ে কর প্রদানে রাজি হন।
৪. মাদুরা বিজয়ঃ ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, মাদুরায় দু’ভাই বীর পাণ্ডে ও শুভ্র পাণ্ডের কলহের সুযােগ নিয়ে মালিক কাফুর পাণ্ড রাজ্যের রাজধানী মাদুরা যাত্রা করেন। তারা পলায়ন করলে মালিক কাফুর ১৩১১ খ্রিস্টাব্দে অতি সহজে মাদুরা দখল করে প্রচুর ধনরত্নসহ দিল্লীতে প্রত্যাবর্তন করেন।
৫. দেবগিরিতে পুনঃ অভিযানঃ ১৩১২ খ্রিস্টাব্দে দেবগিরির রাজা রামচন্দ্রের মৃত্যুর পর পুত্র শংকর দেব পিতৃ প্রতিশ্রুত কর দিতে অস্বীকার করলে সুলতান আলাউদ্দিন মালিক কাফুরের নেতৃত্বে এক অভিযান প্রেরণ করেন। এটি ছিল দাক্ষিণাত্যে কাফুরের চতুর্থ অভিযান। মালিক কাফুর শংকর দেবকে পরাজিত ও হত্যা করে দেবগিরিতে পুনরায় দিল্লীর প্রভুত্ব স্থাপন এবং হােয়সল রাজ্য খিলজী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। এভাবে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী দাক্ষিণাত্যে মুসলিম আধিপত্য বিস্তার করেন।
উপসংহারঃ সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর রাজ্য জয়ে তার সাম্রাজ্যবাদী নীতিই বাস্তবায়িত হয়েছিল। তিনি উচ্চাভিলাষী শাসক হিসেবে সমগ্র উত্তর ও দক্ষিণ ভারত জয় করে যে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, তা তাকে ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান দান করেছে। তাই ড. এ. রায় বলেন- The History of Muslim empire and Muslim administration in India really begins with him.
Leave a comment