প্রশ্নঃ ‘শিল্পবিপ্লবের সফলতা ও ফরাসি বিপ্লবের ব্যর্থতার মাঝেই সমাজবিজ্ঞানের জন্ম হয়েছে।’ উক্তিটির আলােকে সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আলােচনা কর।
অথবা, সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ আলােচনা কর।
অথবা, একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ আলােচনা কর ।
ভূমিকাঃ সামাজিক পরিবেশের সাথে জ্ঞানের যেকোনাে শাখার বিকাশের যােগসূত্র রয়েছে। আর সমাজবিজ্ঞান বিকাশের ক্ষেত্রে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। কারণ সমাজবিজ্ঞান শুধু সামাজিক অবস্থা দ্বারাই প্রভাবিত নয় বরং তাকে বিশ্লেষণ করার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। সমাজবিজ্ঞান বিকাশের ধারাবাহিক ইতিহাস পর্যালােচনা করলে যেসকল উপাদান বিকাশধারায় সহযােগিতা প্রদান করেছে তা হলাে ফরাসি বিপ্লব এবং শিল্পবিপ্লব।
সমাজবিজ্ঞান তত্ত্বের উদ্ভবের বিভিন্ন উপাদানঃ সমাজবিজ্ঞানের বিকাশের ক্ষেত্রে যে উপাদানগুলাে সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তা নিম্নে তুলে ধরা হলােঃ
সামাজিক শক্তি- (১) রাজনৈতিক বিপ্লব (২) শিল্পবিপ্লব এবং পুঁজিবাদের উদ্ভব (৩) সমাজতন্ত্রের উদ্ভব (৪) নগরায়ন (৫) ধর্মীয় পরিবর্তন (৬) বিজ্ঞানের উন্নতি।
বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি- (১) জ্ঞান-উন্মেষ ও ফরাসি সমাজবিজ্ঞান (২) কার্ল মার্কস ও জার্মান সমাজবিজ্ঞান (৩) ব্রিটিশ সমাজতত্ত্বের উৎপত্তি (৪) প্যারেটো ও মসকাঃ ইতালীয় সমাজবিজ্ঞান (৫) বিংশ শতাব্দীর সমাপ্তির দিকে ইউরােপীয় মার্কসবাদ।
আলােচ্য উক্তি অনুসারে ফরাসি বিপ্লব এবং শিল্পবিপ্লব কিভাবে সমাজবিজ্ঞানের গােড়াপত্তন করে তা আলােচনা করা হলােঃ
(১) সমাজবিজ্ঞানের গােড়াপত্তন ও ফরাসি বিপ্লবঃ
সামাজিক শক্তিঃ রাজনৈতিক বিপ্লব; বিশেষ করে ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব সমাজতত্ত্বের উদ্ভবের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক শক্তি হিসেবে কাজ করে। সেই বিপ্লব পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজের ওপর অনেক ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, তবে সমাজবিজ্ঞানের বিকাশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাবের ভূমিকা ছিল মুখ্য। কারণ ফরাসি বিপ্লবের পর সে দেশের সামাজিক অনুশাসন পুরােপুরিই ভেঙে পড়ে। তারা অষ্টাদশ এবং উনবিংশ শতাব্দীতে যেসব রাজনৈতিক বিপ্লব সংঘটিত হয় সেসব পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন সামাজিক অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করার চিন্তা করেন। সামাজিক অনুশাসন প্রতিষ্ঠার সে আকাক্ষা থেকেই সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব হয়।
বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিঃ
(ক) ফ্রান্সের সমাজবিজ্ঞানের গােড়াপত্তন হিসেবে জ্ঞান উন্মেষের শক্তিঃ বিভিন্ন গবেষকের মতে, বুদ্ধিবৃত্তি সমাজবিজ্ঞানের বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। (Hawthorn, 1975, Nisbet, 1967, Seidman, 1983, Zeetlin 1981)। জ্ঞান-উন্মেষের পর্যায় দার্শনিক চিন্তার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্তর। সমাজজীবন সম্পর্কে বহুদিনের পুরনাে ধ্যান-ধারণা এবং বিশ্বাসকে এ জ্ঞান উন্মেষের পর্যায় অস্বীকার করে বা পরিবর্তন করার চেষ্টা করে। যে দু’জন বিখ্যাত ফরাসি সমাজচিন্তাবিদ বুদ্ধিবৃত্তিকে প্রভাবিত করেছেন তারা হলেন চার্লস মন্টেস্কু (১৬৮৯-১৭৫৫) এবং জাঁ জ্যাক রুশাে (১৭২১-১৭৭৮)। সমাজবিজ্ঞানের বিকাশের ক্ষেত্রে জ্ঞান-উন্মেষের প্রভাব প্রত্যক্ষের চেয়ে পরােক্ষই বেশি ছিল। ইরভিং জেটলিনের ভাষায় “Early Sociology developed as a reaction to the enlightenment”. যেসব চিন্তাবিদ জ্ঞান-উন্মেষের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তারা দু’টি বুদ্ধিবৃত্তিক ধারা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, যথা: সপ্তদশ শতাব্দীর দর্শন এবং বিজ্ঞান।
(খ) জ্ঞান-উন্মেষের প্রতি রক্ষণশীল প্রতিক্রিয়াঃ যদিও আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে, ফরাসি সমাজবিজ্ঞানের শুরু হয় জ্ঞান-উন্মেষের চিন্তা দিয়ে, কিন্তু একটু গভীরভাবে তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে, ফরাসি সমাজবিজ্ঞানের যৌক্তিক, মাঠ গবেষণাভিত্তিক বৈজ্ঞানিক এবং পরিবর্তনধর্মী বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে জ্ঞান-উন্মেষের প্রতি রক্ষণশীল প্রতিক্রিয়ারও অনেক ভূমিকা রয়েছে। জেটলিন রক্ষণশীলদের একটি মূল প্রতিপাদ্যকে চিহ্নিত করেন যা ফরাসি সমাজবিজ্ঞানের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। আর তা হলো-
(১) ব্যক্তির ওপর গুরুত্বারােপ করলে সমাজ এবং সমাজ বিকাশের নিজস্ব সূত্র ও অতীত ঐতিহ্য বিদ্যমান।
(২) ব্যক্তির দ্বারা সমাজ সৃষ্টি হয়-এ ধারণার পরিবর্তে সমাজ ব্যক্তিকে সৃষ্টি করে সামাজিকীকরণের মাধ্যমে, তাই সমাজ বিশ্লেষণের একক হওয়া উচিত।
(৩) সমাজ ভূমিকা, অবস্থা, সামাজিক সম্পর্ক, কাঠামাে এবং প্রতিষ্ঠান নিয়ে গঠিত। সেখানে ব্যক্তি সমাজের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পালনে ক্ষুদ্র ভূমিকা পালন করে মাত্র।
(৪) সমাজের বিভিন্ন অংশ পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল ও ওতপ্রােতভাবে জড়িত। যেহেতু সমাজের এক অংশ অন্য অংশের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, সে জন্য একটির পরিবর্তন পুরাে সমাজকে প্রভাবিত করে। তাই সমাজের যেকোনাে পরিবর্তন অতিসতর্কতার সাথে করা উচিত।
ফরাসি সমাজবিজ্ঞানের বিকাশঃ ফরাসি দেশে সমাজবিজ্ঞান তত্ত্বের উদ্ভবের ক্ষেত্রে তিন মনীষীর অবদান প্রাতঃস্মরণীয়। নিচে তাদের অবদান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলােচনা করা হলাে। এ তিনজন হলেনঃ সেন্ট সাইমন, অগাস্ট কোঁৎ এবং এমিল ডুরখেইম।
সেন্ট সাইমনঃ মনীষী সেন্ট সাইমন অগাস্ট কোঁতের পূর্বসূরী ছিলেন এবং একসময় কেঁৎ তার ব্যক্তিগত সহকারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাদের চিন্তাধারার মধ্যে অনেক মিল থাকলেও এক সময় মতানৈক্যের কারণে দু’জন আলাদা হয়ে যান। সেন্ট সাইমনের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য অবদান হলাে যে, তিনি একদিকে ছিলেন রক্ষণশীল এবং অন্যদিকে ছিলেন প্রগতিশীল।
অগাস্ট কোঁৎঃ অগাস্ট কেঁৎ-ই প্রথম ‘সমাজবিজ্ঞান’ শব্দটি ব্যবহার করেন। প্রথমদিকের সমাজবিজ্ঞানী বিশেষ করে স্পেন্সার এবং ডুরখেইমের ওপর তার প্রভাব ছিল। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, সমাজবিজ্ঞানকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে; যেমনঃ তার সময়ের অন্য অনেকে এটা বিশ্বাস করতেন।
ডুরখেইমঃ অগাস্ট কোঁতের মত ডুরখেইমের ওপর মুক্তবুদ্ধিচর্চার নেতিবাচক প্রভাব বেশি ছিল, তবে তার অনেক ইতিবাচক প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়। যেমন: তিনি বিজ্ঞান এবং সামাজিক সংস্কারের ওপর গুরুত্বারােপ করেছেন।
(২) শিল্পবিপ্লব এবং পুঁজিবাদের উদ্ভবঃ উনবিংশ শতাব্দী এবং বিংশ শতাব্দীর গােড়ার দিকে পাশ্চাত্যের অনেক সমাজেই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে। শিল্পবিপ্লবের বহুবিধ প্রভাব ছিল যা পাশ্চাত্যের কৃষিপ্রধান দেশগুলােকে শিল্পপ্রধান দেশে রূপান্তর করে। বহু লােক কৃষিকাজ ছেড়ে বিকাশমান শিল্পে শ্রমিক হিসেবে যােগ দেয়। কারখানাগুলাে ক্রমাগত প্রকৌশলগত উন্নতির সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে থাকে। শিল্প এবং পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাতে শ্রম প্রদানের জন্য বিরাট এক অর্থনৈতিক বুর্জোয়া শ্রেণির সৃষ্টি হয়। বহু ধরনের উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রয় হওয়া শুরু হয় যা অর্থনীতিতে বহুবিধ প্রভাব ফেলে।
জার্মান সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশঃ বিশিষ্ট চার জন সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্কাস, মাক্স ওয়েবার, এমিল ডরখইম এবং জর্জ সিমেল ছাড়াও আরাে অনেক সমাজবিজ্ঞানী সমাজসৃষ্ট ঐ সব পরিবর্তন এবং সমস্যাসমূহ নিয়ে ভাবতে থাকেন। তারা তাদের পুরাে জীবন ঐ সব সমস্যা নিয়ে গবেষণা করে কাটিয়ে দেন, অনেকে এমনকি তার প্রতিকারেরও সুপারিশ করেন। যদিও ফরাসি সমাজবিজ্ঞানের পথিকৃৎদের মধ্যে চিন্তার ক্ষেত্রে সাদৃশ এবং ধারাবাহিকতা আছে কিন্তু জার্মান সমাজবিজ্ঞানের গােড়াতেই তার বিপরীত চিত্র লক্ষ্য করা যায়।
পরিশেষঃ পরিশেষ বলা যায় যে, ফরাসি বিপ্লবের ব্যর্থতা এবং শিল্পবিপ্লবের হাত ধরেই যে সমাজবিজ্ঞানের গােড়াপত্তন ও বিকাশ লাভ, তা খুব সহজেই প্রতীয়মান হয়। কেননা তৎকালিন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সুশীল সমাজের তাত্ত্বিকগণ যে ভিন্ন ধরনের ব্যবস্থার কথা বলেন বা সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেন তার সূত্র ধরেই সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব। তাই সামগ্রিক আলােচনায় আলােচ্য উক্তির যথার্থতা বা যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়।
Leave a comment