অথবা, জেমসের মৌলিক অভিজ্ঞতাবাদ কী?
ভূমিকাঃ জ্ঞানের উৎপত্তির ব্যাপারে দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। জ্ঞানের উৎপত্তি বিষয়ে উল্লেখযােগ্য যে চারটি মতবাদ রয়েছে সেগুলাের মধ্যে অভিজ্ঞতাবাদ অন্যতম। বুদ্ধিবাদী দর্শনের এক প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ রূপেই অভিজ্ঞতাবাদের উদ্ভব। আধুনিক দর্শনে অভিজ্ঞতাবাদ অন্যতম আলােচ্য বিষয়। অভিজ্ঞতাবাদ মােতাবেক অভিজ্ঞতাই জ্ঞানলাভের যথার্থ উৎস। আর দর্শনের জন্মকালেই অভিজ্ঞতাবাদের জন্ম।
জেমসের মৌলিক অভিজ্ঞতাবাদঃ জেমসের মৌলিক অভিজ্ঞতাবাদে আমরা তিনটি নীতি লক্ষ্য করি, যথা
(১) সম্পর্ক সাপেক্ষেঃ দার্শনিক জ্ঞান অভিজ্ঞতার জগতে সীমাবদ্ধ থাকবে যে সকল বিষয়ে অভিজ্ঞতামূলক কোনাে দিক নেই সে সকল বিষয়ে দার্শনিক আলােচনা করা উচিত হবে না।
(২) অভিজ্ঞতাসাপেক্ষঃ একটি বস্তু বা বিষয়ের সাথে অন্য বস্তু বা বিষয়ের যে সম্পর্ক তাও ঐ বস্তু বা বিষয়ের মতাে অভিজ্ঞতালব্ধ। অর্থাৎ বস্তু বা বিষয় যেমন অভিজ্ঞতাসাপেক্ষ তাদের মধ্যকার সম্পর্কও হতে হবে অভিজ্ঞতা সাপেক্ষ ।
(৩) ভিন্ন সত্তার সাহায্যঃ আমাদের প্রাপ্ত সকল খণ্ড খণ্ড অভিজ্ঞতা ধারাবাহিকভাবে এমন একক সূত্রে গ্রথিত যে, আমাদের অভিজ্ঞতার দ্বারাই এদের সম্বন্ধ নির্ণয় করা যায়। এদের অস্তিত্ব বা ঐক্য বিধানের জন্য কোনাে প্রকার ভিন্ন সত্তার সাহায্য গ্রহণ করতে হয় না।
ব্যাপক অর্থে অভিজ্ঞতাবাদঃ গতানুগতিক অভিজ্ঞতাবাদীরা নানাভাবে অভিজ্ঞতা শব্দটিকে ব্যবহার করেছেন। সাধারণভাবে অভিজ্ঞতা বলতে শুধুমাত্র ইন্দ্রিয় সংবেদনকে বুঝায়। আর জেমস ইন্দ্রিয় সংবেদন এবং প্রত্যক্ষণসহ কামনা করা, প্রচেষ্টা করা, ইচ্ছা করা, আসা করা, ভয় করা, সন্দেহ করা এবং নৈতিক ও ধর্মীয় চেতনা, সৌন্দর্যানুভূতি ইত্যাদিকেও অভিজ্ঞতা বলে অভিহিত করেন।
অভিজ্ঞতা হলাে ক্রিয়াঃ জেমস্ অভিজ্ঞতাকে একটি ধারক সত্তা মনে না করে বরং একে একটি ক্রিয়া হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এই ক্রিয়ার উৎস জড়ত্ব নয়, চেতনাও নয় বরং একটি নিরপেক্ষ পদার্থ। জেমস এটির নাম দিয়েছেন বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা। তার মতে, এই বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতাই হচ্ছে জগতের মূল উপাদান।
জ্ঞান নির্বাচনধর্মীঃ জেমসের মতে, আমাদের জ্ঞান সর্বদা নির্বাচনধর্মী। আমরা আমাদের নির্বাচন অনুযায়ী কোনাে বস্তু বা বিষয়ের অভিজ্ঞতা লাভ কর। বস্তুজগতের নিজস্ব কোনাে অর্থ নেই। অভিজ্ঞতা ক্রিয়ার দ্বারা যেভাবে এর স্বরূপ চিত্রিত হয় এর অর্থ তাই দাঁড়ায়।
অভিজ্ঞতা পরিবর্তনশীলঃ জেমসের মতে, অভিজ্ঞতা সর্বদা পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীল এই অভিজ্ঞতক্রিয়ার অন্তরালে কোনাে স্থায়ী, অপরিবর্তনীয় ধারক সত্তা বা মন বলে কিছু নেই। অভিজ্ঞতা হচ্ছে একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ। নিয়ত পরিবর্তনের মধ্যেও এটি কখনও খণ্ডিত বা বিচ্ছিন্ন হয় না।।
অভিজ্ঞতা আত্মগতঃ প্রয়োগবাদী দার্শনিকগণ অনেক বিষয়ের মধ্যে সত্যতার সমস্যাকেও গুরুত্ব সহকারে আলােচনা করেছেন। তবে সকল প্রয়ােগবাদী দার্শনিক সত্যতার উপর সমান গুরুত্ব আলােচনা করেননি। এদের মধ্যে উইলিয়াম জেমস সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে সত্যতার বিষয়টি আলােচনা করেছেন। আর আমরা সত্যতার আলােচনায় সাধারণত জেমসকে অনুসরণ করব।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, অন্যান্য মতবাদের ন্যায় প্রয়ােগবাদও বিভিন্ন দিক থেকে সমালােচনার সম্মুখীন হয়েছে। তবে আসল কাজ হলাে এ মতবাদ পরিবর্তনে বিশ্বাসী। কোনাে সত্য চিরকালের জন্য সত্য নয়। এই মূলনীতি এই মতবাদ গ্রহণ করেছে। আমরা বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির মূলেও এই সত্যের কার্যকারিতা লক্ষ্য করি।
Leave a comment