প্রশ্নঃ রসের স্বজ্ঞাবাদ আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ নীতিবিদ্যা মানুষের আচরণের ভালােত্ব-মন্দত্ব, ন্যায়ত্ব-অন্যায়ত্ব ইত্যাদি নিয়ে আলােচনা করে। এ সকল আচরণের নৈতিক মূল্য নির্ধারণও নীতিবিদ্যা করে থাকে। ডব্লিউ, ডি, রস এর ‘The Foundation of Ethics’ গ্রন্থে স্বজ্ঞাবাদ নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা করেছেন। তার মতে, নীতি দার্শনিকদের কাজ হচ্ছে সাধারণ লােক যেসব সমস্যায় পতিত হতে পারে, সেসব সমস্যার সমাধান করা।

রসের স্বজ্ঞাবাদঃ কোনাে বিশেষ নৈতিক সমস্যা আলােচনা না করে বরং যেকোনাে নৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য যেসব নৈতিক সূত্র ব্যবহার করা হয় সেগুলাের স্থান নির্ধারণ নীতিদার্শনিকদের আসল ও প্রধান কাজ।

সাধারণ নৈতিক সমস্যাবলির সমাধানঃ যখন নৈতিক সূত্রগুলাের কোনােটাকে বাদ দেয়া সাধারণ লােকের পক্ষে সম্ভবপর হয় না, তখন কতক ক্ষেত্রে এসব সূত্রের ব্যাপারে সাধারণ লােকের মধ্যে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়ে থাকে। যেমন তারা এটা দেখতে পায় যে, কারও জীবনকে বিপন্ন না করে তারা সত্য কথা বলতে পারে না, কিংবা মিথ্যা কথা না বলে তারা প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারে না।

সূত্রাবলি পরম নয়ঃ সূত্রাবলির দ্বন্দ্বসম্বন্ধীয় প্রথম সমস্যা সম্পর্কে রস এই মত পােষণ করেন যে, যদি সূত্রাবলিকে পরম বলে মনে করা হয় তাহলে সূত্রাবলি টিকে থাকতে পারে না। কান্ট সূত্রাবলিকে পরম বলে মনে করেন। যা রসের কাছে বাড়াবাড়ি বই নয়। কিন্তু রস এ ব্যাপারে যে সীমারেখা টেনে দিয়েছেন তার বাইরে না যাওয়াটা শক্ত বলেই সমস্যার উদ্ভব হয়। আমরা যদি আদৌ লক্ষ্যের দিকে দ্রুত বেগে অগ্রসর হতে চাই, তাহলে আমাদের অবশ্যই অধিকতর দুরত্বের দিকে অগ্রসর হতে হয়।

নৈতিক সূত্রাবলির চারটি স্তরঃ রসের মতবাদ মেনে নিয়ে আমাদের নৈতিক সূত্রাবলির বর্ণনা সম্পর্কে এতই সতর্ক হতে হবে যে, যার ফলে নৈতিক সূত্রাবলি পথ নির্দেশক হিসেবে খুব কমই আমাদের প্রয়ােজন মেটাবে। নিম্নে নৈতিক সূত্রাবলির চারটি স্তর আলােচিত হলােঃ

প্রথম স্তরঃ রস বলেন, কতকগুলাে সূত্র আছে, যেগুলাে সম্পূর্ণরূপে স্বতঃসিদ্ধ বলে প্রতীয়মান হয় এবং যেগুলােকে বাদ দেয়া যায় না। দৃষ্টান্তস্বরূপ এ সূত্রটি এরূপ যে, আমরা যতদূর পারি ততদূর আমাদের সুখ সৃষ্টি করা উচিত। কিন্তু এ নিয়মের স্বতঃসিদ্ধ স্বরূপের জন্য এটা খুব সম্ভব নয় যে, আমরা একে কেন্দ্র করে যেকোনাে বিতর্ক দেখাবাে।

দ্বিতীয় স্তরঃ নৈতিক সূত্রাবলির দ্বিতীয় স্তরটি মানবিক স্বরূপ সম্পর্কে সাধারণ সত্যের প্রেক্ষিতে প্রথমটি থেকে যেসব সূত্র উদ্ভব হতে পারে সেগুলাের দ্বারা গঠিত।

তৃতীয় স্তরঃ তৃতীয় স্তরটি একটি প্রদত্ত সময় বা স্থানে প্রাপ্ত বিশেষ অবস্থাবলির প্রেক্ষিতে প্রথমটি থেকে প্রাপ্ত সূত্রাবলি দ্বারা গঠিত।

চতুর্থ স্তরঃ চতুর্থ এবং শেষ স্তরটি মানবিক স্বরূপ সম্পর্কে মিথ্যা মতামতের প্রেক্ষিতে প্রথমটি থেকে যেসব সূত্র ভুলভাবে উদ্ভূত সেগুলাে দ্বারা গঠিত।

নৈতিক শব্দ ও বৈশিষ্ট্যের বিচার-বিবেচনাঃ নৈতিক শব্দ ও নৈতিক বৈশিষ্ট্যের বিচার-বিবেচনা করা নীতি দার্শনিকদের জন্য খুবই প্রয়ােজনীয় ব্যাপার। নৈতিক শব্দাবলিকে তার প্রকৃত প্রয়ােগের দিক থেকে বিচার-বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু রসের মতে, এ ধরনের বিচার বিবেচনার কাজ দর্শনের নয় বরং অভিধানেই এ কাজ অধিকতর প্রযােজ্য।

ন্যায়ত্বের বৈশিষ্ট্যঃ রস নিজেই প্রথমে ন্যায়ত্ব এর বৈশিষ্ট্য এবং পরে ভালােত্ব এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে। ন্যায়ত্ব সম্পর্কে বলা হয় যে, এ স্বতঃসিদ্ধ যে, ন্যায়ত্বের অস্তিত্ব রয়েছে, কেননা এ স্বতঃসিদ্ধে যে অনেকগুলাে অবস্থা রয়েছে, যেখানে পালন করার মতাে একটি মাত্র কাজ থাকে।

ন্যায়ত্ব অসংজ্ঞাযােগ্যঃ রস নৈতিক বৈশিষ্ট্যের স্বরূপ সম্পর্কে বিচার করতে গিয়ে ন্যায়ের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে অনেক বিষয়ে আলােচনা করেন এবং অবশেষে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ন্যায়ত্ব অসংজ্ঞাযােগ্য।

নীতিবিদ্যার সূত্র অধিকতর নিশ্চিতঃ রসের মতে, স্বজ্ঞার মাধ্যমে ন্যায় কাজকে ন্যায় বলে জানা যায়। তিনি এ প্রসঙ্গে গণিতের সঙ্গে নীতিবিদ্যার তুলনা করে বলেন যে, গণিতের সূত্র থেকে নীতিবিদ্যার সূত্র অধিকতর নিশ্চিত।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, কোনা বিষয়গুলাের মধ্যে ভালোত্বের এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে, সে সম্পর্কীয় প্রশ্নের আলােচনাও তিনি করেন। তার উত্তরটি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের আগ্রহ, উদ্দেশ্য ও কামনা এবং কামনাই হচ্ছে এই বিষয়গুলাে, যেগুলাের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যসমূহ রয়েছে।