প্রশ্নঃ বিশ্বসভ্যতায় হিব্র জাতির অবদান আলােচনা কর।

অথবা, মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে হিব্রুদের অবদান মূল্যায়ন কর।

ভূমিকাঃ নিকট ও মধ্যপ্রাচ্যের যে সব প্রাচীন সভ্যতা আধুনিক বিশ্বকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। হিব্রু সভ্যতা তার অন্যতম। হিব্রুরা পরবর্তীকালে ইহুদীরূপে আখ্যায়িত হয়। খ্রিস্ট জাতির অনেকখানি পটভূমিই হিব্রু জাতির কাছ থেকে আহরিত হয়েছে। হিব্রুদের নৈতিক ধারণা আধুনিক পাশ্চাত্য জগৎকে প্রবলভাবে আলােড়িত করে। বিশেষত সে সব দেশে যেখানে ব্যাবিলনীয়গণ শক্তিশালী ছিল। হিব্রু সভ্যতাও শূন্য থেকে উদিত হয়নি। এর অনেক উপাদানই মিশরীয় ও ব্যবিলনীয় উৎসের ওপর নির্ভরশীল এবং হিব্রু দর্শন ছিল অংশত মিশরীয় ও অংশত গ্রিসীয় প্রভাবযুক্ত। তা সত্ত্বেও হিব্রু সভ্যতার মৌলিক অবদান ছিল।

হিব্র জাতির উৎসঃ হিব্রু এবং ইহুদী শব্দদ্বয়ের অর্থ এক হলেও হিব্রু শব্দটি প্রাচীনতম; কারণ উত্তর সাম্রাজ্যের ধ্বংসের পর জুডার অধিবাসীদের ইহুদী বলা হতাে। আরবদেশ থেকে হিব্রু যাযাবর জাতি সর্বপ্রথম প্যালেস্টাইনে আগমন করে। খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ সালে তাদের আদিপুরুষ আব্রাহাম অথবা হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে স্বদেশভূমি ছেড়ে হিব্রুগণ-মেসােপটেমিয়ায় বসতি স্থাপন করে। পরবর্তীকালে আব্রাহামের পৌত্র জাকবের নেতৃত্বে তারা পশ্চিম দিকে যাত্রা করে এবং প্যালেস্টাইন দখল করে তথায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। জাকব ইসরাইল নামে পরিচিত এবং তিনিই ইসরাইলের জাতীয় ধর্মগুরু।

মুসা (আঃ)-এর নেতৃত্বঃ প্যালেস্টাইনে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে হিব্রুরা মিশরে গমন করে এবং সেখানে প্রাচীন মিশরীয় বাদশাহ ফেরাউনের অধীনে দাসত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। পরবর্তীকালে হযরত মুসার নেতৃত্বে খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০-১২৫০ সালে এই দাসত্ব শৃংখল থেকে মুক্ত হয়ে সিনাই উপদ্বীপে আগমন করে। প্যালেস্টাইনের প্রাচীন ক্যানানাইট সাম্রাজ্য অথবা কেনান ধ্বংস করে হিব্রুগণ সেখানে একটি উন্নত মানের সভ্যতা গড়ে তােলেন।

হযরত দাউদ (আঃ)-এর নেতৃত্বঃ হযরত দাউদ (আঃ)-এর চল্লিশ বছরব্যাপী রাজত্বকালে হিব্রু জাতির ইতিহাসে গৌরবােজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করে। জেরুজালেম অধিকার করে তিনি একটি বিশাল সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ় করেন। হিব্রুদের দশটি গােত্রকে সংঘবদ্ধ করে তিনি হিব্রু জাতিকে সুসংহত করেন। তার বিশেষ স্থাপত্য কীর্তি হলাে জেরুজালেমের অসংখ্য ইমারতসমূহ। হিব্রু জাতির অগ্রগতির ইতিহাসে হযরত দাউদ (আঃ)-এর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।

হযরত সােলায়মান (আঃ)-এর নেতৃত্বঃ হযরত দাউদ (আঃ)-এর মৃত্যুর পর তার পুত্র সােলায়মান অথবা হযরত সােলাইমান (আঃ) হিব্রু সম্রাটের মর্যাদা লাভ করেন। বিজ্ঞ, বিচক্ষণ এবং তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন সােলায়মান হিব্রু সভ্যতার ক্রমবিকাশে অশেষ অবদান রেখে গিয়েছেন। তিনি জেরুজালেমের একটি সুবৃহৎ ও অনিন্দ্য সুন্দর মন্দির নির্মাণ করেন। তার মৃত্যুর পর হিব্রু জাতির অধঃপতন হতে থাকে এবং তাদের সাম্রাজ্য দু’টি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। এরপর হিব্রুগণ বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করতে থাকে। ৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে অবশেষে তাদের বিলুপ্তি ঘটে।

বিশ্ব সভ্যতায় হিব্রুদের অবদানঃ মানবসভ্যতায় হিব্রু জাতির অবদান ছিল অপরিসীম। নিম্নে বিশ্বসভ্যতায় হিব্রুদের বিভিন্ন অবদানের উল্লেখ করা হলাে-

(১) ধর্মঃ ধর্মীয় ক্ষেত্রে হিব্রুদের অবদান সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য। তাওরাত বা ওল্ড টেস্টামেন্ট হিব্রুদের ধর্মগ্রন্থের নাম। ঐতিহাসিক গ্রন্থ হিসাবে এর মূল্য সর্বজনস্বীকৃত। নিকট প্রাচ্যের হিব্রু ও তাদের প্রতিবেশী জাতিসমূহ সম্পর্কে একটি মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করে। সাহিত্য মূল্য হিসাবেও এটি অতুলনীয়। তাওরাতের দশটি অনুশাসনের ভিত্তিতে তাদের নৈতিক মান নির্দিষ্ট হতাে। তারা বিশ্বাস করে, দেবতা যিহোভা মানবজাতিকে সৎপথে পরিচালনার উদ্দেশ্যে সিনাই পর্বতের মােসেজের (মুসা আঃ) হাতে এ ধর্মীয় নির্দেশাবলি প্রদান করেছিলেন।

(২) সাহিত্যঃ প্রাচীন হিব্রু সাহিত্য মােটামুটি সমৃদ্ধ ছিল। এই সাহিত্যের বেশিরভাগই পুরাতন টেস্টামেন্টে বিধৃত। পণ্ডিতদের মতে বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া খণ্ডিত লিপি সংগ্রহ থেকেই পুরাতন টেস্টামেন্ট গড়ে ওঠেছে। ধর্মীয় অনুভূতি থেকে লিখিত হলেও পুরাতন টেস্টামেন্টের সাহিত্য মূল্য অস্বীকার করা যায় না। অষ্টম পুস্তকে মহিলাদের অবস্থান ও চরিত্র করুণ রসের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। পুরাতন টেস্টামেন্টে রাজাদের চতুর্থ গ্রন্থে ইহুদি রাজতন্ত্রের উজ্জ্বল দিনগুলাের কথা বর্ণিত হয়েছে। ‘জব’ গ্রন্থটিতে অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে মানুষ, শয়তান ও ঈশ্বরের চরিত্র এবং ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। পরবর্তী পুস্তক ‘ধর্মসঙ্গীত’ অত্যন্ত সুধাময় সাহিত্যিক নিদর্শন।

(৩) দর্শনঃ গ্রিকদের পূর্বে হিব্রুরাই বিস্ময়কর দর্শনের জন্ম দিতে পেরেছিল। এই দর্শন মানুষ ও জীবন সম্পর্কে নতুন ধারণা দিয়েছে। পুরাতন টেস্টামেন্টে তাদের অনেক দার্শনিক মতবাদ পাওয়া গিয়েছে। বিশেষ করে ‘Book of Provers’ এবং ‘Apocryphal Book of Ecclesiasticus’ পুরাতন টেস্টামেন্টের এই দুই অংশে হিব্রুদের প্রাথমিক দার্শনিক চিন্তার প্রতিফলন রয়েছে। এ সমস্ত হিব্রু দর্শনের প্রকৃত লেখক সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় না। তবে দর্শনের মূল বক্তব্যের সংক্ষিপ্তকরণ করা যায়। নিম্নে এই দর্শন সম্পর্কে ধারণা দেয়া গেল-

(ক) গঠন প্রকৌশলঃ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ছিল একটি যন্ত্রবিশেষ, যা কোনাে নির্দিষ্ট গন্তব্য ছাড়াই আবর্তিত হয়। সূর্যের নিচে কোনাে কিছুই নতুন নয়, কোনাে অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে না, শুধু পেছনের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।

(খ) অদৃষ্টবাদঃ মানুষ অদৃষ্টের দ্বারা পরিচালিত হয়। কাজ এবং কৃতকার্যতার মধ্যে কোনাে সম্পর্ক নেই।

(গ) সন্দেহবাদঃ চূড়ান্ত কোনাে বিষয় সম্পর্কে ধারণা লাভ করা অসম্ভব। মৃত্যু-পরবর্তী আত্মা বা জীবনের অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনাে প্রমাণ নেই।

(8) আইনঃ সাংস্কৃতিক শূন্যতার মধ্যেও হিব্রু আইনকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে পর্যবেক্ষণ করা চলে আইন ছাড়াও সাহিত্য এবং দর্শনের ক্ষেত্রে হিব্রুদের প্রতিভার পরিচয় রয়েছে। যদিও এ সমস্ত বিষয়ের মধ্যে ধর্মীয় সংযুক্তি রয়েছে; তথাপি এ ক্ষেত্রে পার্থিব ধ্যান-ধারণার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। হিব্রু আইনের ধারা নিয়ে পুরাতন টেস্টামেন্টের পঞ্চম পুস্তক রচিত হয়েছে। সম্ভবত নবীদের উন্মেষের কালে ধর্মক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক আলােড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, তারই পথ ধরে এই আইন সংকলনের সৃষ্টি। ক্যালডীয় ও প্রাচীন-ব্যবিলনীয় আইনের ধারণা সম্ভবত হিব্রুদের প্রভাবিত করেছিল।

সাধারণ দৃষ্টিতে এই আইনের ধারা হাম্বুরাবির আইনের চেয়েও উজ্জ্বল ছিল। এখানে হিব্রু আইনের কয়েকটি ধারা উল্লেখ করা যেতে পারে-

(ক) দরিদ্রঃ অতিথি-অভ্যাগতদের প্রতি দানশীলতা ও উদারতা দেখাতে হবে।

(খ) ছয় বছর দাসত্ব করলে দাসকে মুক্তি দিতে হবে, কিন্তু রিক্ত হাতে দাসকে ফিরিয়ে দেয়া চলবে না।

(গ) বিচারক ও অন্যান্য কর্মকর্তা জনসাধারণ কর্তৃক নির্বাচিত হবে, এ ক্ষেত্রে উপঢৌকন প্রদান বা পক্ষপাতিত্ব করা চলবে না।

(৫) শিল্পকলা ও স্থাপত্যঃ শিল্পকলা ও স্থাপত্য ক্ষেত্রেও প্রাচীন হিব্রু জাতির অবদান ছিল। শিল্পকলা ও স্থাপত্যকীর্তির, অসংখ্য নিদর্শন হিব্রু সভ্যতার গভীরতা ও বৈশিষ্ট্যকেই নির্দেশ করে। স্থাপত্যকীর্তির অপূর্ব নিদর্শন জেরুজালেমের মন্দির হেরােড় কর্তৃক ধ্বংস হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এটি শিল্পজগতের বিস্ময় ছিল।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, হিব্রুরা সর্বপ্রথম একেশ্বরবাদের একটি সুস্পষ্ট ধারণা দিয়েছিল। পরবর্তী প্রধান ধর্মলাে একেশ্বরবাদের এ ধারণা গ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রে তাদের পরবর্তী ধর্মবিশ্বাসের অগ্রদূত বলা যায়। সভ্যতায় হিব্রুদের প্রধান অবদান লক্ষ্য করা যায় ধর্মে, নৈতিকতায়, সাহিত্যে এবং সমাজের প্রায় প্রতিটি শাখায়। সবশেষে বলা যায়, আর কোননা, জনগােষ্ঠী এত দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও সভ্যতার এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখতে পারেনি।