ধারা-৯ঃ যথাকালে ধারক (Holder. in due course)—প্রতিদানের বিনিময়ে যে ব্যক্তি বাহক-দেয় অঙ্গীকারপত্র, বিনিময় বিল বা চেকের দখল লাভ করেন বা যে ব্যক্তি উক্ত দলিলের প্রপক বা পৃষ্ঠাঙ্কনকারী অথবা আদিষ্ট দেয় দলিলের ক্ষেত্রে, যে ব্যক্তি দলিলটি মেয়াদোত্তীর্ণ হবার পূর্বেই বিজ্ঞপ্তি ছাড়া দলিলটিতে ত্রুটিহীন স্বত্ব রয়েছে এমন কোন ব্যক্তি হতে দলিলের দখল লাভ করেন, এরূপ স্বত্বগ্রহীতাকে “যথাকালে (যথানিয়মে) ধারক” বলা হয়।

ব্যাখ্যা—অত্র ধারার উদ্দেশ্যে, একটি অঙ্গীকারপত্র, বিনিময়পত্র বা চেক-এর উপর কোন ব্যক্তির ত্রুটিযুক্ত স্বত্ব থাকলে, সেই ব্যক্তি ৫৮ ধারার বিধান মােতাবেক তার পাওনা অর্থ গ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন।

আলােচনা

যথাকালে ধারক (Holder in due course): উপরােক্ত ধারার ভাষ্য মােতাবেক, যথাকালে ধারক তিনিই, যিনি অঙ্গীকারপত্র, বিনিময়পত্র ও চেক-এর দখল লাভ করেন, তিনি দলিলের প্রাপক বা স্বত্বগ্রহীতাও হতে পারেন বা আদিষ্ট দেয় দলিলের কোন ব্যক্তির উক্ত দলিলে উল্লিখিত অর্থ। প্রদেয় হবার পূর্বে বৈধ ও ত্রুটিহীন স্বত্ব বিদ্যমান ছিল, যার নিকট হতে দলিলের স্বত্ব লাভ করেছেন।

সুতরাং দেখা যায় যে, কোন ব্যক্তিকে নিয়মানুসারে স্বত্বাধিকারী বা ধারক হিসেবে প্রতিপন্ন করতে হলে তাকে প্রমাণ করতে হবে যে,

(ক) তিনি মূল্যবান প্রতিদানের বিনিময়ে দলিলের দখল পেয়েছেন;

(খ) বাহক-দেয় দলিলের ক্ষেত্রে তিনি দলিলের দখল লাভ করেছেন বা আদিষ্ট-দেয় দলিলের ক্ষেত্রে। তিনি দলিলের প্রাপক বা স্বত্বগ্রহীতা;

(গ) দলিলের মেয়াদপূর্তীর পূর্বেই তিনি দলিলের দখল পেয়েছেন; এবং

(ঘ) দলিল গ্রহণের সময় এমন কোন ন্যায়সঙ্গত কারণ বর্তমান ছিল না যাতে তিনি বিশ্বাস করতে পারেন যে, পৃষ্ঠাঙ্কনকারীর স্বত্বে কোন দোষ আছে।

উক্ত শর্তগুলাের কোন একটি বিদ্যমান না থাকলে ঐ স্বত্বাধিকারী নিয়মানুসারে ধারক হিসেবে গণ্য হবেন না। হস্তান্তরযােগ্য দলিলে পৃষ্ঠাঙ্কনকারীর স্বত্বের ক্রটি সম্পর্কে অবগত কেউ উক্ত দলিলের হস্তান্তরগ্রহীতা হলে যথাকালে ধারক বিবেচিত হবেন না (এআইআর ১৯৩০ মাদ্রাজ ১৪১)। তবে স্বত্বগ্রহীতা পৃষ্ঠাঙ্কনকারীর উক্ত দলিলে ত্রুটিযুক্ত স্বত্ব সম্পর্কে জ্ঞাত না হবার যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকে, তবে অত্র আইনের ১১৮ ধারা মােতাবেক তিনি যথাকালে ধারক হিসেবে গ্রাহ্য হবেন (এআইআর ১৯২৪ পাটনা ৫২১0। এতদ্বিষয়ে উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে-

উদাহরণসমূহ (Examples):

(ক) হস্তান্তরযােগ্য দলিলটি ছিন্ন করে একত্রে আঠা লাগান হয়েছে অথবা উহা রবার দিয়ে মুছে দেয়া হয়েছে। হস্তান্তরযােগ্য দলিলটি সন্দেহজনক [Baxendlale v. Bennett (1878) 3QBD 525]।

(খ) প্রকৃত সময় বা সহি করার সময়ে পরবর্তী তারিখ দেয়া চেক (post-dated cheque) কোন ত্রুটিপূর্ণ স্বত্বাধিকারের ইঙ্গিত বহন করে না। সুতরাং অন্যান্য শর্তাবলী পালিত হলে সে চেক এর গ্রাহক যথাকালে ধারক হতে পারে (Hithcock v. Edwards (1889) 60 LT 636)।

(গ) বিলটি যদি আদিষ্ট-দেয় হয় তবে যথানিয়মে ধারক হতে পৃষ্ঠাঙ্কনকারী বা প্রাপককে উহার বিলটি যে প্রতিদান পেয়েছেন, তা দেখাবার প্রয়ােজন নেই। কিন্তু বিলটি বাহক-দেয় হলে উহার অধিকারী ব্যক্তি যথানিয়মে ধারক হতে পারে, যদি প্রতিদান দিয়ে তিনি বিলটির অধিকার পেয়ে থাকেন (Madhya Bharat Khadi Sangha v. Bal Kishan Kapoo and others, AIR (1979) All 253)

উল্লেখ্য যে, একটি প্রতারণামূলে প্রাপ্ত হস্তান্তরযােগ্য দলিল ধারককে পৃষ্ঠাঙ্কিত হলে, সেক্ষেত্রে এমন অনুমান করা যাবে না যে, উক্ত ধারক যথাকালে ধারক। অর্থাৎ তাকে প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি দলিলটি মূল্যের বিনিময়ে পরিশােধের পূর্বেই পেয়েছেন [এআইআর ১৯২৮ মাদ্রাজ ১২৩৮ (ডিবি)]।

প্রতিদান (Consideration): অত্র ধারায় যথাকালে ধারকের উপর দলিল লাভের জন্য প্রতিদানের আবশ্যকতার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং হস্তান্তরযােগ্য দলিলের ক্ষেত্রে “প্রতিদান” বলতে কি বুঝায় তা জানা দরকার। সহজ কথায় প্রতিদান হল “এক পক্ষ কর্তৃক অন্যপক্ষকে চুক্তি করার জন্য বিনিময় মূল্য”। হস্তান্তরযােগ্য দলিলের ক্ষেত্রে যথাকালে ধারক হতে হলে দলিল লাভে তার প্রতিদান অবশ্যই মূল্যবান হতে হবে, অর্থাৎ একটি সাধারণ চুক্তি সম্পাদনে যেরূপ প্রতিদান থাকে এতেও অন্ততঃ তা থাকতে হবে। তবে প্রতিদানের অতীত মূল্য বা বর্তমান মূল্য [20 Bom. 755] থাকতে পারে এবং তা পর্যাপ্ত হতেও পারে আবার নাও হতে পারে [3 Cal. 192]। এ প্রতিদান আইনসম্মত বা আইন দ্বারা নিষিদ্ধ বা গণ পরিকল্পনা দ্বারা নিবৃত্ত হতে পারেনা। সুতরাং একটি হস্তান্তরযােগ্য দলিলের স্বতুগ্রহীতা প্রতিদানের বিনিময়ে ধারক হবার আগ পর্যন্ত যথাকালে ধারক হতে পারেন না।

যথানিয়মে ধারকের অধিকার ও সুবিধাসমূহ (Rights and Privileges of a Holder in Due Course): যথানিয়মে ধারকের অধিকার ও সুবিধাসমূহ নিম্নরূপঃ

(১) ক্রটিপূর্ণ হলেও মালিকানা বৈধঃ হস্তান্তরযােগ্য দলিল আইনের ৫৮ ধারার বিধান মতে, যে হস্তান্তরকারী বা স্বত্ব-দাতার স্বরে কোন দোষ থাকলেও (অর্থাৎ হস্তান্তরকারী যদি অবৈধ উপায়ে দলিল লাভ করে থাকে), যথানিয়মে ধারক দলিলের নিখুঁত স্বত্ব লাভ করে থাকে। যেমন—ক একখানা চেক চুরি করল এবং জাল সহি করে পৃষ্ঠাঙ্কনপূর্বক খ-কে স্বত্বান্তর করল। উক্ত চেক খ যথানিয়মে ধারক হিসেবে পেয়েছে হিসেবে গণ্য হবে। আবার, যদি গ প্রতারণামূলকভাবে কোন সম্প্রদেয়পত্র লাভ করে থাকে তাহলে সে অর্থপ্রাপ্তির ডিক্রী পাবে। কিন্তু গ যদি তা ঘ-এর নিকট এমন অবস্থায় হস্তান্তরিত করে যার দ্বারা ঘ যথাকালে। ধারক হয় তাহলে ঘ অর্থপ্রাপ্তির জন্য মামলা করে প্রদেয় অর্থ আদায় করতে পারে। অর্থ প্রদানকারী পক্ষ গ-এর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযােগ করতে পারেন, ঘ-এর বিরুদ্ধে নয়।

অসম্পূর্ণ দলিলের বৈধ মালিকানাঃ অত্র আইনের ২০ ধারার বিধান মতে, যেকোন অসম্পূর্ণ দলিলে (inchoate instrument) হস্তান্তরকারী যদি দলিল প্রস্তুতকারকের নির্ধারিত অঙ্কের অধিক অঙ্ক লিখে দলিল সম্পূর্ণ করে, তাহলে যথানিয়মে ধারক দলিলে লিখিত অর্থ পাবার অধিকারী হয়। কিন্তু অন্যান্য ধারকগণ কেবলমাত্র প্রস্তুতকারকের নির্দেশিত বা নির্ধারিত অর্থই পেতে পারে।

(৩) শর্ত সাপেক্ষ দলিলঃ অত্র আইনের ৪৬ ও ৪৭ ধারায় বর্ণিত রয়েছে যে, যথানিয়মে ধারক কোন শর্তাধীন দলিল লাভ করবার পর পূর্ববর্তী পক্ষকে তজ্জন্য দায়ী করতে পারে। কিন্তু অন্যান্য ধারকগণ তা পারেনা, কারণ শর্তসাপেক্ষে বা বিশেষ উদ্দেশ্যে হস্তান্তরিত দলিলের স্বত্ব হস্তান্তরযােগ্য নহে।

(৪) নিজ নামে মামলাঃ যথানিয়মে ধারক অর্থ প্রদানকারী পক্ষসমূহের বিরুদ্ধে নিজ নামে মামলা করতে পারে।

(৫) দায়ঃ হস্তান্তরযােগ্য দলিল আইনের ৩৬ ধারা অনুযায়ী বলা যায়, দলিল পরিশােধ না হওয়া পর্যন্ত যথানিয়মে ধারকের নিকট দলিলের পূর্ববর্তী সকল পক্ষ দায়ী থাকে।

(৬) ভুয়া নামে লিখিত দলিল বৈধ হতে পারেঃ উপরােক্ত আইনের ৪২ ধারায় বলা হয়েছে যে, ভুয়া নামে লিখিত বিনিময়পত্র লেখক বা তার আদিষ্টকে প্রদেয় হলে এবং ভুয়া বিল লেখকের স্বাক্ষর এবং উহার প্রথম বা একমাত্র পৃষ্ঠাঙ্কনকারীর স্বাক্ষর অভিন্ন হলে উক্ত বিলের স্বীকৃতিদাতা যথানিয়মে ধারকের নিকট দায়ী থাকবে।

(৭) যথাকালে ধারকের নিকট হতে হস্তান্তরঃ একই আইনের ৫৩ ধারার বিধান মতে, যথাকালে ধারকের নিকট হতে কোন ব্যক্তি যদি হস্তান্তরযােগ্য দলিল গ্রহণ করলে এবং দলিলটিতে প্রভাব রাখবে এমন প্রতারণা বা অবৈধতার সাথে জড়িত না থাকে, তাহলে তিনি যথাকালে ধারকের সকল অধিকার ও সুবিধা ভােগ করবেন, যেমন-স্বীকৃতিদাতা এবং দলিল পূর্ববর্তী সকল পক্ষ ধারকের নিকট থেকে তা ভােগ করেন।

(৮) দলিলের মৌলিক বৈধতা অস্বীকৃতিতে বাধাঃ উক্ত আইনের ১২০ ধারামতে, যথানিয়মে ধারক কোন দলিলের দরুন মামলা করলে, ঐ দলিল অঙ্গীকারপত্র হলে, তার প্রস্তুতকারক এবং বিনিময়পত্র হলে, তার লেখক বা সম্মানার্থে স্বীকৃতিদাতা প্রথমে যেভাবে দলিল প্রস্তুত হয়েছিল তার বৈধতা আদালতে অস্বীকার করতে পারেনা। কিন্তু নাবালক নাবালকত্বের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে। স্বাক্ষর যদি জাল করা হয় তাহলেও কোন দায় থাকে না।

(৯) প্রাপকের পৃষ্ঠানের ক্ষমতা অস্বীকারে বাধাঃ উক্ত আইনের ১২১ ধারার বিধানে আছে, যথানিয়মে ধারক দলিলের দরুন মামলা করলে, কোন অঙ্গীকারপত্রের প্রস্তুতকারক বা বিনিময়পত্রের স্বীকৃতিদাতা দলিলের তারিখে প্রাপকের দলিল হস্তান্তরের ক্ষমতা ছিল না এ অজুহাতে দলিলের বৈধতা অস্বীকার করতে পারেনা।

(১০) পূর্ববর্তী পক্ষের স্বাক্ষর বা ক্ষমতা অস্বীকারে বাধাঃ উক্ত আইনের ১২২ ধারা মােতাবেক, কোন দলিলের পরবর্তী ধারক যদি মামলা করেন তাহলে কোন পৃষ্ঠাঙ্কনকারী কোন পূর্বপক্ষের স্বাক্ষর বা চুক্তি ক্ষমতা অস্বীকার করতে পারেন না।

ধারক ও যথানিয়মে ধারকের মধ্যে পার্থক্য (Difference between Holder and Holder in due course): এতদুভয়ের মধ্যে নিম্নরূপ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়, যেমনঃ

(১) নিজ নামে দলিলের দখল পাবার যােগ্যতা লাভ করলেই ধারক হওয়া যায়। কিন্তু দলিলের যথানিয়ম ধারক হতে হলে মূল্যের বিনিময়ে উহার দখল পাবার যােগ্যতা লাভ করতে হবে। প্রতিদান ছাড়াও দলিলের ধারক হওয়া যায়।

(২) পৃষ্ঠাঙ্কনের মাধ্যমে দলিল লাভ করলে, ধারক পৃষ্ঠাঙ্কনকারী অপেক্ষা উত্তম স্বত্ব লাভ করে না, অর্থাৎ পৃষ্ঠাঙ্কনকারীর স্বত্বে কোন দোষ থাকলে ধারকের স্বত্বও দোষযুক্ত হয়। কিন্তু যথানিয়মে ধারক এরূপ দোষ সম্পর্কে কোন বিজ্ঞপ্তি না পেলে অথবা দলিল গ্রহণের সময় তৎসম্পর্কে সন্দেহের উদ্রেক হবার কোন কারণ না থাকলে, দলিলের নির্দোষ স্বত্ব লাভ করে।

(৩) অসম্পূর্ণ, ভুয়া বা শর্তাধীন পৃষ্ঠাঙ্কনযুক্ত দলিলের ক্ষেত্রে যথানিয়মে ধারক কতকগুলি বিশেষ সুবিধা বা অধিকার ভােগ করে। কিন্তু ধারক ঐরূপ বিশেষ অধিকার বা সুবিধা লাভ করে না।