প্রশ্নঃ হাড্ডি খিজির কে? তার পরিচয় দাও।

অথবা, “গণআন্দোলনের যে অংশটা লেখকের অনুমােদন পেয়েছে, নাগরিক পরিসরে তার যথার্থ প্রতিনিধি নিঃসন্দেহে খিজির।”- উক্তিটি সম্পর্কে তােমার মতামত দাও।

অথবা, সংক্ষেপে খিজির চরিত্র বিশ্লেষণ কর।

অথবা, ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসে হাড্ডি খিজির কে? তার পরিচয় দাও।

উত্তরঃ ‘চিলেকোঠার সেপাই’ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটা অসাধারণ উপন্যাস। তার এই সার্থক উপন্যাস সষ্টির পিছনে সবচেয়ে বড়াে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে তার চরিত্র চিত্রণের অসাধারণ দক্ষতা। তিনি তার নিপুণ হাতে চরিত্রগুলাে সৃষ্টি করে ব্যতিক্রমী শিল্পীর মর্যাদা লাভ করেছেন। এ উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হাড্ডি খিজির। সে শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধি।

‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসের বহুল পরিচিত চরিত্র হাড্ডি খিজির। তার নামের উৎপত্তি অস্থিসর্বস্ব লম্বা দেহের জন্য। খিজির মূলত তার মায়ের অবৈধ সন্তান। তার বাপের নাম সে জানে না। তার মায়ের স্বামী ফালু মিস্ত্রির অত্যাচারে সে ছােটোবেলা হতে অতিষ্ট হতে থাকে। ফালু মিস্ত্রি তাকে দেখলেই গাল দিত। ফালু মিস্ত্রির সামনেই সে যেত না। খিজির ছােটোবেলায় লােহারপুলে রিকশা ঠেলে দিয়ে যে দু চার আনা পয়সা পেত ফালু মিয়া এসে তা নিয়ে যেত। পরিমাণ কম হলে ঘাড়ে পিঠে সামনে মার। খিজির ঘুমের মধ্যে বিছানায় প্রস্রাব করত। তার মা তাবিজ-কবচ করে শেষ পর্যন্ত ফরিদাবাদ মাদ্রাসার মৌলবির পানি পড়াতে সেরেছে। ফালুর অত্যাচারে এক সময় খিজির ও তার মা চলে আসে মহাজন রহমতউল্লাহর বাড়িতে। খিজিরের বিয়ে হয় জুম্মনের মায়ের সাথে। বদ স্বভাবের কামরুদ্দিনের হাত থেকে বাঁচিয়ে জুম্মনের মাকে মহাজনের বড়াে স্ত্রী তাকে খিজিরের সাথে বিয়ে দেয় এবং মহাজনের বস্তিতে থাকার ব্যবস্থা করে।

গণআন্দোলনের যে অংশটা লেখকের অনুমােদন পেয়েছে, নাগরিক পরিসরে তার যথার্থ প্রতিনিধি নিঃসন্দেহে খিজির। খিজির একেবারে শুরু থেকেই চার্জড, সক্রিয় এবং উত্তেজিত। তালেবের মৃত্যুর সময় তাকে প্রথম দেখা যায় লােবান জ্বালাচ্ছে। পঞ্চম পরিচ্ছেদে দেখা যায়, খিজির বহুত চার্জড হয়ে ইটা মারছে। খিজির তার ব্যক্তিগত ইতিহাসসহ লম্বা জায়গা জুড়ে মূর্তি পেয়েছে ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ থেকে শুরু করে পরের কয়েক পরিচ্ছেদ জুড়ে। অবশ্য তার ব্যক্তিগত ইতিহাস সামষ্টিক ইতিহাসের সমান্তরালে বা অধীনে বর্ণিত। রহমতউল্লাহহ মহাজন আর তার ভাগনে আলাউদ্দিন মিয়ার বগল ঘেঁষে, তাদের আয়-উপার্জন আর শারীরিক-মানসিক প্রবৃত্তিগত সক্রিয়তার সাথে জড়িয়ে পেঁচিয়ে খিজির বিশিষ্ট হয়ে উঠার পরিসর পায়। লেখক তাকে বেশ খানিকটা পরিসর ছেড়ে দেন তাতে আলবত পক্ষপাত আছে; কিন্তু এক ফোটা আবেগ নেই। আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক কাঠামাের মধ্যে তার অবস্থান একবিন্দুও মহিমান্বিত হয় না। দশম পরিচ্ছেদেই পরিষ্কার বুঝা যায়, মহাজনের প্রতি পুষে রাখা ঘৃণা আর ক্ষোভই খিজিরের মূল প্রেরণা। সমবেত জনতাকে মহাজনের বিরুদ্ধে উস্কে দেওয়ার সমস্ত চেষ্টাই সে চালিয়ে যায়। আলাউদ্দিন মিয়ার ধমক খেয়েও মহাজন যে রঞ্জুর বাপকে হুমকি দিয়েছে, নানাভাবে নাজেহাল করেছে, এমনকি আলাউদ্দিন মিয়া না ঠেকালে ‘মনে লয় দুইচাইরখান চটকানা ভি মাইরা দিত’, এ সংবাদ খিজিরের পুনরাবৃত্তিতেই সবার কানে যায়। মিছিলে মহাজনের বিরুদ্ধে ধুয়া ধরে ওই খিজিরই। দেখা যাচ্ছে, গণআন্দোলনে খিজিরদের জান বাজি রাখা ভূমিকার মূলে রয়েছে তাদের শ্রেণি বাস্তবতা। যার হারানোের কিছু নাই, তার পক্ষেই সম্ভব জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নেমে পড়া।

খিজির ছােটোবেলা থেকে রহমতউল্লাহর খেয়ে মানুষ। শ্রমিক হিসেবে থাকে তার গ্যারেজে। কিন্তু এই খিজিরই একসময় হয়ে উঠে বিপ্লবী। বিভিন্ন প্রকার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের সাথে সাথে খিজির তার মহাজন রহমতউল্লাহর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলে। পরিশেষে সৈনিকের গুলিতে নিহত হয় খিজির।