প্রশ্নঃ বুদ্ধিবাদ, অভিজ্ঞতাবাদ ও বিচারবাদের একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ দাও। এ তিনটি মতবাদের মধ্যে তুমি কোনটিকে সবচেয়ে বেশি সন্তোষজনক মনে কর এবং কেন?
অথবা, বুদ্ধিবাদ, অভিজ্ঞতাবাদ ও বিচারবাদের একটি তুলনামূলক ব্যাখ্যা দাও। এ তিনটি মতবাদের মধ্যে কোনটিকে তুমি সমর্থন কর এবং কেন?
ভূমিকাঃ আধুনিক দর্শন মূলত জ্ঞানবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল। যে বিদ্যায় জ্ঞান বা জ্ঞানের উৎপত্তি, স্বরূপ ও বিষয়বস্তু, ক্যাটাগরি, বৈধতা বা সত্যতা নিয়ে আলােচনা করা হয় তাকে জ্ঞানবিদ্যা (Epistemology) বলা হয়ে থাকে। ‘Epistemology’ শব্দটি জে, এফ ফেরিয়ার (J. F. Ferier) তার Institutes of Metaphysics-এ সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন, এবং তখন থেকেই এ শব্দটি বহুল প্রচলিত হয়ে আসছে। এই জ্ঞানবিদ্যা হলাে দর্শনের প্রথম ও প্রধান শাখা।
বুদ্ধিবাদ (Rationalism): বুদ্ধিবাদের মূল বক্তব্য হলাে জ্ঞান বুদ্ধি দিয়েই লাভ করা যায়। ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি তা যথার্থ জ্ঞান নয়। আর যদি তা জ্ঞান হয়ও তা সত্যিকারের জ্ঞান নয়। সে জ্ঞান অসঙ্গত এবং অসম্পূর্ণ। জ্ঞান শাশ্বত এবং সনাতন। ইন্দ্রিয় আমাদের এ ধরনের জ্ঞান দিতে পারে না। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে পরিবর্তিত হয়। যা আমাদের কাছে সত্য তা অন্যের কাছে মিথ্যাও হতে পারে। দেশ-কালের পরিবর্তনে জ্ঞানের পরিবর্তন হয়। বুদ্ধিবাদীরা বাহ্য-অভিজ্ঞতাকে বর্জন করে বুদ্ধি যথার্থ জ্ঞানলাভের উৎস এবং উপায় হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাদের মতে, আত্মা সক্রিয়। বুদ্ধি আত্মার স্বাভাবিক গুণ। মন নিজের অন্তর্ধারণা থেকে সক্রিয়ভাবে জ্ঞান উৎপন্ন করে। বুদ্ধি আবার বিচারশক্তির সাহায্যে অনিশ্চিত এবং অসঙ্গত জ্ঞানকে নিশ্চিত এবং সঙ্গত জ্ঞান থেকে পৃথক করে চিনতে পারে। এছাড়া মন নিশ্চিত এবং জ্ঞানদানে তার নিজের বৈশিষ্ট্য বজায় রাখে। প্রাচীন গ্রিসের নৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্যোগের সুযােগ নিয়ে একদল তার্কিক পণ্ডিতের আবির্ভাব হয়। যারা সােফিস্ট নামে পরিচিত। প্রাচীন গ্রিসের বুদ্ধিবাদী দার্শনিক সক্রেটিস এবং প্লেটো এদের মতো অস্বীকার করে বদ্ধিকেই জ্ঞানলাভের একমাত্র উপায় বলে স্বীকার করেন। নব্য পাশ্চাত্য দর্শনের জনক বুদ্ধিবাদের প্রধান হলেন রেনে ডেকার্ট। স্পিনােজা, ভলফ এবং লাইবনিজ নামকরা বুদ্ধিবাদী দার্শনিক, যারা সবাই স্বীকার করেন যে বুদ্ধির সাহায্যে নিশ্চিত ও যথার্থ জ্ঞান লাভ হয়। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান সঠিক নয়। এ জ্ঞান অসঙ্গত এবং অযথার্থ।
অভিজ্ঞতাবাদ (Empiricism): অভিজ্ঞতাবাদ অভিজ্ঞতাকেই জ্ঞানের উৎস বলে মনে করে। ব্রিটিশ দার্শনিক লক, বার্কলি ও হিউম জ্ঞানের বিচার-বিশ্লেষণের পর এ সিদ্ধান্তে আসেন যে সংবেদন এবং অনুভূতি থেকে জ্ঞানের উৎপত্তি হয়। সংবেদনের সাহায্যে আমরা বহির্জগতের বস্তুর জ্ঞান লাভ করি। অন্তর্দর্শনে আমরা নিজেদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন পাই। সংবেদনে আমরা যে বস্তুবিশেষের জ্ঞান পাই, তার থেকে আরােহ পদ্ধতিতে সামান্যীকরণের দ্বারা সাধারণ সত্য ও সাধারণ ধারণার জ্ঞান লাভ করি। তাদের মতে, অমূর্ত সাধারণ সত্যও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে লাভ করা যায়। এমনকি কার্যকরণ সম্বন্ধ নিয়ম, ওদাত্ম নিয়ম, বিরােধ নিয়ম প্রভৃতি স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম ও অভিজ্ঞতাপূর্ব সাধারণ সত্য নয়। এগুলােও ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভরশীল এবং সামান্যীকরণের ফল। সুতরাং জ্ঞান সম্পূর্ণভাবে অভিজ্ঞতার সাহায্যে হয়, আবার এ অভিজ্ঞতা কখনও কখনও পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের সাহায্যও নেয়। দর্শনের জন্মকালেই অভিজ্ঞতাবাদের জন্ম। গ্রিক দর্শনের জনক থেলিস পানিকে দেখলেন আবাসভূমি আওনিয়া দ্বীপের চারদিকে। পানির ধারণা তার অভিজ্ঞতালব্ধ। সােফিন্টদের মতে, মানুষই সবকিছুর পরিমাপক। অর্থাৎ মানুষের অভিজ্ঞতাই সত্য-মিথ্যা, ভাল-মন্দ, সুন্দর-অসুন্দর ঠিক করবে। মধ্যযুগের ঠিক করবে। মধ্যযুগের বিখ্যাত অভিজ্ঞতাবাদী বেকন বলেন, প্রত্যেক অভিজ্ঞতা থেকেই জ্ঞানের উপকরণ পাওয়া যায়। আধুনিককালে ব্রিটিশ দানক লক অভিজ্ঞতাবাদের জনক। তারপর বার্কলি ও শেষে হিউম অভিজ্ঞতাবাদের একটা সম্পূর্ণ এবং সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেন। সাম্প্রতিককালের যৌক্তিক দৃষ্টবাদীদের এ দলভুক্ত করা যেতে পারে।
বিচারবাদ (Criticism): বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ উভয়ই চরম মতবাদ। বুদ্ধিবাদ বুদ্ধির ওপর এবং অভিজ্ঞতাবাদ অভিজ্ঞতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করে। বিখ্যাত বিচারবাদী জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট নিজের মতবাদে বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের সমন্বয় সাধন করার চেষ্টা করেছেন। কান্ট দেখালেন যে, জ্ঞানের উৎপত্তির ক্ষেত্রে বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা উভয়েরই অবদান আছে। কোনােটিকে বাদ দিয়ে জ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। কান্টের মতে, অন্য বস্তুর মতাে জ্ঞানেরও দুটি দিক আছে। একটি তার আকার যা বুদ্ধির কাছে থেকে পাওয়া যায়। আর একটি উপাদান যা সংবেদন বা অভিজ্ঞতার কাছে থেকে পাওয়া যা। কান্ট দেখালেন যে, বুদ্ধি কেবল আকার দিতে পারে। আর অভিজ্ঞতা কেবল জ্ঞানের উপাদান দিতে পারে, কিন্তু জ্ঞানের আকার দিতে পারে না। সুতরাং এ দু’টো মতবাদের সমন্বয় সাধন করেই যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যায় বলে তিনি মনে করেন। এ জন্য তার মতবাদকে বিচারবাদ বলা হয়।
সন্তোষজনক মতবাদঃ বুদ্ধিবাদ, বিচারবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের মধ্যে কোনটি সন্তোষজনক মতবাদ, তা নিম্নে আলােচনা করা হলাে-
প্রথমত, বুদ্ধিবাদ জ্ঞানের উৎপত্তি ব্যাখ্যার একটি চরম মতবাদ যা শুধু বুদ্ধিকে বা সহজাত ধারণাকে জ্ঞানের উৎস মনে করে। এই সহজাত ধারণাকে বিভিন্নভাবে সমালােচনা করে বলা যে, সহজাত ধারণা বলে কিছু নেই এবং মানুষের মনে ধারণা বা সত্যকে স্বতঃসিদ্ধ বলে স্বীকার করাও যুক্তিসঙ্গত নয়।
দ্বিতীয়ত, বুদ্ধিবাদীদের মতে, মানুষের মন সক্রিয় ও বুদ্ধি মনের স্বাভাবিক ধর্ম। বুদ্ধির মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান অভ্রান্ত ও নিশ্চিত। কিন্তু যেখানে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বা সত্য স্থান ও কালের বিবর্তনে অনেক সময় পরিবর্তিত হয়, সেখানে বুদ্ধি বা অভিজ্ঞতাপূর্ব ধারণার মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান কিভাবে অভ্রান্ত ও নিশ্চিত হতে পারে তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
তৃতীয়ত, অভিজ্ঞতা জ্ঞানের একটি উৎস ঠিকই, কিন্তু বুদ্ধি বলে জ্ঞানের আরেকটি উৎস আছে এবং প্রকৃত জ্ঞানের জন্য বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা উভয়ের প্রয়ােজন। অথচ দু’টি মতবাদই তাদের নিজস্ব মতবাদকে সঠিক ও অন্যদেরটা ভুল বলে দেখাতে চান।
চতুর্থত, কান্ট জ্ঞানােৎপাদনের ব্যাপারে সংবেদন ও বুদ্ধির সমন্বয় সাধনের প্রয়ােজনীয়তার কথা বলেছেন। কিন্তু কি করে এ বিপরীতমুখী প্রক্রিয়া একত্র হয় এবং জ্ঞান উৎপন্ন করে তা কান্ট পরিষ্কারভাবে বলতে পারেননি, ফলে তার মতবাদ দ্বৈতভাবে বিদ্যমান রয়েছে।
পঞ্চমত, কান্ট দর্শনকে নির্বিচারবাদ ও সংশয়বাদের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই অজ্ঞেয়বাদের সৃষ্টি করেছেন। কেননা তার মতে, অতীন্দ্রিয় জগৎ আছে বটে কিন্তু তা জানা যায় না। এখানে প্রশ্ন হলাে, কোনাে কিছু আছে বলে স্বীকার করা হলে তা কেন জানা যাবে না। তা ছাড়া দেশ ও কাল সম্পর্কে কান্টের যুক্তি সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক মতবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে সন্তোষজনক নয়।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, দর্শনের ইতিহাস পর্যালােচনা করে আমরা দেখি, জ্ঞানােৎপত্তির পিছনে বুদ্ধিবাদ এবং অভিজ্ঞতাবাদ প্রায় দর্শনের জন্মলগ্ন থেকেই সহযাত্রী। জন্মলগ্ন থেকেই তাদের ধর্ম অনুযায়ী বুদ্ধিবাদ কেবল বুদ্ধিকেই এবং অভিজ্ঞতাবাদ কেবল অভিজ্ঞতাকেই গুরুত্ব দেয়। সুতরাং উভয় মতবাদই চরমপন্থী এবং একদেশদর্শী মতবাদ। পক্ষান্তরে বিচারবাদ এই দুই মতবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে জ্ঞানের ক্ষেত্রে বুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতা উভয়কেই স্বীকার করে নেয়। সুতরাং সার্বিক দিক বিচার করলে দেখা যায়, কান্টের বিচারবাদ সন্তোষজনক মতবাদ।
Leave a comment