প্রশ্নঃ ভাববাদ কী? শেলিং-এর অতীন্দ্রিয় ভাববাদ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, ভাববাদ বলতে কী বুঝ? শেলিং-এর অতীন্দ্রিয় ভাববাদ আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ দর্শনের ইতিহাসে ভাববাদ একটি প্রাচীন মতবাদ। এ মতবাদটি দর্শনে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আলােচিত হয়ে আসছে। ভাববাদ অনুযায়ী ভাব বা আত্মই একমাত্র সত্য। বাহ্য বস্তুর মন নিরপেক্ষ কোনাে স্বতন্ত্র সত্তা নেই। দর্শনে ভাববাদের ওপর ভিত্তি করে উদ্ভূত মতবাদগুলাের মধ্যে শেলিং-এর অতীন্দ্রিয় ভাববাদ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।

ভাববাদের সংজ্ঞাঃ জ্ঞানবিদ্যার দিক থেকে যে মতবাদ অনুসারে জ্ঞেয়বস্তুর জ্ঞান নিরপেক্ষ কোনাে আস্তত্ব নেই। জ্ঞেয়বস্তুর অস্তিত্ব তথা জ্ঞান ওপর নির্ভরশীল তাকে ভাববাদ বলে। ভাববাদ অনুসারে জ্ঞেয়বস্তু কোনাে নিরপেক্ষ সত্তা নয়; বরং জ্ঞাননির্ভর ব্যাহ্যসত্তা। এ মতবাদ অনুসারে বস্তুর অস্তিত্ব মন বা চেতনার ওপর নির্ভরশীল। আর এ মতবাদে বিশ্বাসীদেরকে ভাববাদী বলা হয়। ভাববাদের মতে, ভাব বা ধারণা বা আত্মাই একমাত্র প্রকৃত সত্তা। এ মতবাদ অনুসারে বাহ্য বস্তুর মন নিরপেক্ষ কোনাে স্বতন্ত্র সত্তা নেই। বাহ্য বহু মানুষের বা ঈশ্বরের জ্ঞানের বিষয় হিসেবে বিদ্যমান বা অস্তিতুশীল সত্তা সম্পর্কীয় মতবাদ হিসাবে ভাববাদকে আধ্যাত্মিক মতবাদ বা আধ্যত্মবাদও বলা হয়ে থাকে।

শেলিং-এর অতীন্দ্রিয় ভাববাদঃ শেলিং তার দার্শনিক আলােচনা ফিকর্টে এর পরব্রহ্মবাদ দিয়ে শুরু করেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি অতীন্দ্রিয়বাদে এসে উপস্থিত হন। তার মতে, জড় ও মন উভয়েরই পরস্পরকে প্রয়ােজন। তার মতে, মন যেমন জড় ও প্রকৃতির সৃষ্টি করে এবং মনকে প্রকৃতি সীমাবদ্ধ করে; তেমনি প্রকৃতিও মনকে সৃষ্টি করে এবং প্রকৃতিকে মন সীমাবদ্ধ করে। প্রকৃতি মনকে সৃষ্টি করতে না পারলে মন ও প্রকৃতিকে সৃষ্টি করতে পারবে না। বার্কলি যথার্থই বলেছিলেন, মনের ধারণা ব্যতীত বস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব সম্ভব নয়। মন ছাড়া বস্তুর কোনাে অস্তিত্ব নেই। ফিকটেও ঠিক একই অর্থে বলেছেন, মন বা অহং বস্তু সৃষ্টি করে কিন্তু কোথাও বস্তু ব্যতীত মন থাকতে পারে না। অতএব, বহির্জগতের অস্তিত্ব মনের অস্তিত্বের একটি নিশ্চয়ত্মক শর্ত এই প্রয়ােজনীয় কথাটি বার্কলি ও ফিকটে উভয়েই ভুলে যান। বিশ্বপ্রকৃতি পরমসত্তা না হলে অহং বা মনকে ও পরম তত্ত্ব বলা যায় না। পরমসত্তাকে পরমতত্ত্ব বলা উচিত নয়, মন বা অহং এবং বিশ্বপ্রকৃতি মূলত অভিন্ন। আমরা বলতে পারি যে, হয় বিশ্বপ্রকৃতি মনকে সৃষ্টি করে নতুবা মন বিশ্বপ্রকৃতিকে সৃষ্টি করে। আমরা যদি বলি বিশ্ব প্রকৃতি মনকে সৃষ্টি করে, তাহলে আমরা প্রত্যক্ষবাদে বিশ্বাসী হই। চিন্তা ও বস্তু, মন ও বিশ্ব প্রকৃতি এদের উভয়েরই উৎপত্তি হয় একটি উন্নততর নিয়ম থেকে যা এদের কোনােটা না হলেও এদের কারণ এটি একটি নিরপেক্ষ নিয়ম, যা এদের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে এদেরকে চালিত করে। শেলিং বিশ্বপ্রকৃতি এবং অহং-এর বাইরে অতীন্দ্রিয় সত্তাকে চরম সত্তা বলে অভিহিত করেছেন। এটি দৃশ্য বা আত্মা বা প্রকৃতি এবং অদৃশ্য প্রকৃতি বা মন এই উভয়ের তত্ত্বের মধ্যস্থ নিয়ম বিশেষ যা সবকিছুর ধারক বাহক ও চালক। এই নিয়ম ধারণার জগতের ইন্দ্রিয় বহির্ভূত আদর্শ নিয়ম, তাই শেলিং তার ভাববাদের নাম দিয়েছেন অতীন্দ্রিয় ভাববাদ।

সমালােচনাঃ শেলিং-এর ভাববাদ বিভিন্নভাবে সমালােচিত হয়েছে। নিম্নে শেলিং-এর অতীন্দ্রিয় ভাববাদের কিছু ত্রুটি উপস্থাপন করা হলাে-

প্রথমত, শেলিং তার মতবাদে অতীন্দ্রিয় মতবাদের যথার্থ ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। পরমতত্ত্ব শুধুমাত্র অতীন্দ্রিয় নয় বরং মন ও বিশ্ব প্রকৃতিতেও প্রকাশিত ও বিধৃত। আবার এদের বাইরেও এর অস্তিত্ব রয়েছে। মােটকথা এটা সবকিছুর ওপর একটি উন্নততর ঐক্যসুত্র।

দ্বিতীয়তঃ শেলিং-এর ভাববাদ বিশ্ব প্রকৃতি ও মনের যথার্থ ও ন্যায্য ব্যাখ্যা দিতে পারে না। এটি ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিশ্বপ্রকৃতি ও মনকে অস্তিত্বহীন করে তােলে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়বস্তুর সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে যে কয়টি ভাববাদী মতবাদের উদ্ভব হয়েছে শেলিং-এর অতীন্দ্রিয় ভাববাদ সেগুলাের মধ্যে অন্যতম। শেলিং-এর ভাববাদে কিছু কিছু ত্রুটি থাকলেও এই মতবাদের গুরুতুকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। তিনি তার ভাববাদ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যে দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন তা খুবই যৌক্তিক ও বাস্তব। তাই বলা যায়, সমালােচনা সত্ত্বেও তার মতবাদ প্রশংসার দাবি রাখে নিঃসন্দেহে।