অথবা, সৃজনমূলক বিবর্তনবাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর। উন্মেষমুলক বিবর্তনবাদের সাথে এর কোনাে সম্পর্ক আছে কি? তুলে ধর।

ভূমিকাঃ বিশ্বজগৎ নিয়ত পরিবর্তনশীল। বিভিন্ন সৃষ্টির ভিতর দিয়ে এই পরিবর্তন চিরধাবমান। কিন্তু এই পরিবর্তন নিয়ত সুশৃখল। এই সুশৃঙ্খল পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমরা খুঁজে পেয়েছি জগতের অভিব্যক্তি বা বিবর্তনের ধারাকে।

বিবর্তনঃ ক্রমিক এবং শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে কোনাে বস্তু তার অন্তর্নিহিত শক্তি বা ক্রিয়ার ফলে যখন সরল থেকে জটিল অবস্থায় পরিবর্তিত হয় তখন সেই ক্রমবিকাশের পদ্ধতি বা প্রক্রিয়াকে অভিব্যক্তি বা বিবর্তন বলা হয়। সাধারণত অভিব্যক্ত হওয়া বলতে বুবি প্রকাশিত বা বিকশিত হওয়া। অভিব্যক্তি হলাে, প্রকাশ বা ক্রমবিকাশ। ইংরেজি Evolve কথাটির অর্থও প্রকাশিত হওয়া। যা অপ্রকাশিত, ধীর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তার ক্রমবিকাশই হলাে অভিব্যক্তি। এই জগৎ ও জগতের যাবতীয় বস্তুর যে রূপ বর্তমানে আমরা প্রত্যক্ষ করছি তার পেছনে আছে এক সুদীর্ঘ পরিবর্তনের ইতিহাস। সুতরাং অভিব্যক্তিবাদ অনুসারে জগৎ ও জগতের যাবতীয় বস্তু সরল অবস্থায় পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এই পরিবর্তন হলাে ক্রমিক পরিবর্তন। সংক্ষেপে বলা যায় “Evolution is the gradual becoming of things through a gradual process.”

সৃজনমূলক বিবর্তনবাদঃ আমাদের আলােচ্য বিষয় হচ্ছে সৃজনমূলক বিবর্তনবাদ। নিম্নে সৃজনমূলক বিবর্তনবাদ আলােচনা করা হলাে-

বার্গসের মতবাদঃ ফরাসি দার্শনিক Henn Bergson সৃজনমূলক অভিব্যক্তিবাদের প্রবর্তক। তার মতে, বিবর্তনপ্রক্রিয়া অনিয়ন্ত্রিত, অজ্ঞাতপূর্ব ও সৃজনমূলক। নতুন নতুন পথে নতুন নতুন জিনিস সৃষ্টি করে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে এগিয়ে যায়। পুরাতন কোনাে জিনিসের আবির্ভাব বিবর্তন প্রক্রিয়ায় নেই। সম্পূর্ণ নতুন জিনিস সৃষ্টি করাই বিবর্তনের কাজ। সুতরাং পুনরাবির্ভাব নয়, সৃষ্টিই জগতের মূল লক্ষ্য।

র্গসের মতে, বিবর্তনপ্রক্রিয়া যান্ত্রিক নয়, উদ্দেশ্যমূলকও নয়। তা স্বাধীন ও সৃজনধর্মী। এ কারণে তিনি যন্ত্রবাদ ও উদ্দেশ্যবাদের অযৌক্তিকতা প্রদর্শন করেন। যন্ত্রবাদ অনুসারে বিবর্তনপ্রক্রিয়ায় প্রত্যেক পূর্বস্তর উত্তরস্তরকে নিয়ন্ত্রিত করে। এই নিয়ন্ত্রণের কোনাে ব্যতিক্রম কল্পনাই করা যায় না। যন্ত্রবাদ অনুসারে প্রাণকে জড় নিয়ন্ত্রিত করে। আর প্রাণ মনকে নিয়ন্ত্রণ করে।

জড় থেকে যখন প্রাণের উদ্ভব হয়, আবার প্রাণ থেকে যখন মনের উদ্ভব হয় তখন কোনাে নতুন জিনিসের সৃষ্টি হয়। প্রাণ জড়ের জটিলতম রূপ, আর মন প্রাণের জটিলতম রূপ। সুতরাং যন্ত্রবাদীদের মতে, নিয়ন্ত্রণ পুনরাবির্ভাব বিবর্তনক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য। বার্গসের মত, প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। এখানে পুনরাবির্ভাবের কোনাে স্থান নেই। সুতরাং তিনি যন্ত্রবাদের ব্যাখ্যা অযৌক্তিক বলে প্রত্যাখ্যান করেন।

বার্গসের মতে, উদ্দেশ্যবাদ বিপরীত যন্ত্রবাদ মাত্র। যন্ত্রবাদ অনুসারে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় প্রত্যেক পূর্বস্তর উত্তরস্তরকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু উদ্দেশ্যবাদ অনুসারে উত্তরস্তরই পূর্বস্তরকে নিয়ন্ত্রণ করে। সমস্ত বিবর্তনপ্রক্রিয়াই উদ্দেশ্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যন্ত্রবাদ অনুসারে, বর্তমান অতীতের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। উদ্দেশ্যবাদ অনুসারে, বর্তমান ভবিষ্যতের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। উভয় মতবাদই বিবর্তনপ্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ স্বীকার করে।

বার্গসের মতে, বিবর্তন প্রক্রিয়া স্বাধীন ও সৃজনধর্মী। নতুন নতুন জিনিস সৃষ্টি করাই বিবর্তন প্রক্রিয়ার কাজ। বার্গসো হেরাক্লিটাসের মতাে মনে করেন, গতিই জগতের একমাত্র বৈশিষ্ট্য। জগৎজুড়ে এক বিরাট পরিবর্তনের সােত বয়ে চলেছে। এখানে কিছুই সত্য নয়। এই গতিকে কখনও তিনি প্রাণপ্রবাহ বা প্রাণশক্তি বলে অভিহিত করেছেন। এই প্রাণপ্রবাহ প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জিনিস সৃষ্টি করে চলছে। প্রাণপ্রবাহের উত্তরাতি সম্পর্কে পূর্বমুহূর্তে কিছুই বলা যায় না। যা আছে তার আবির্ভাব প্রাণপ্রবাহের সৃষ্টিপ্রক্রিয়ায় নেই। এই প্রবাহকে তিনি কালপ্রবাহ বলে ভেবেছেন।

সমালােচনাঃ বিবর্তনের ইতিহাসে বার্গসের সৃজনমূলক বিবর্তনবাদ নিঃসন্দেহে একটি অভিনব ও মৌলিক মতবাদ। কিন্তু মতবাদটি নিম্নলিখিত অসঙ্গতিগুলাে দেখা যায়।

(১) এ মত বিজ্ঞানসম্মত নয়ঃ বার্গসের মতবাদ বিজ্ঞানসম্মত নয়। বিবর্তনের বিভিন্ন স্তরে কার্যকারণ সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের কথা অস্বীকার করে তিনি সর্বজনস্বীকৃত কার্যকারণ নিয়মের বৈজ্ঞানিক নীতিকে অস্বীকার করেছেন।

(২) এ মত অযৌক্তিকঃ বার্গসো যে সম্পূর্ণ নতুন সৃষ্টির কথা বলেছেন, তার সত্যতা স্থির মস্তিষ্কে ভেবে দেখা দরকার। এই বিশ্বে সম্পূর্ণ নতুন বলে কিছু আছে কি?

(৩) এ মত বােধগম্য নয়ঃ বার্গসো বিবর্তনপ্রক্রিয়াকে বন্ধনমুক্ত প্রাণপ্রবাহের অন্ধ উন্মাদনা বলেছেন। কিন্তু জগতের সুন্দর, সুসজ্জিত ও সুসামঞ্জস্য গঠনবৈশিষ্ট্য অন্ধ উন্মাদনা থেকে কি করে সৃষ্টি হয় তা আমরা বুঝতে পরি না।

(৪) বার্গসের এ মত গ্রহণীয় নয়ঃ বার্গসের মতে, প্রাণপ্রবাহের বিপরীত গতি থেকেই জড়ের সৃষ্টি। কিন্তু প্রাণপ্রবাহকে কে বাধা দেবে? প্রাণপ্রবাহ নিজে থেকেই বাধা সৃষ্টি করছে, এই অভিমত যুক্তিগ্রাহ্য নয়।

উন্মেষমূলক বিবর্তনবাদঃ উন্মেষমূলক বিবর্তবাদ একটি অভিনব বিবর্তনবাদ। এমতানুসারে জগতের বিবর্তনপ্রক্রিয়ার প্রতি স্তরে নতুন নতুন সত্তা বা গুণের উন্মেষ ঘটে, যা পূর্ববর্তী স্তরে পুনর্বিন্যাস নয়। উন্মেষবাদীদের মতে, মন প্রাণ থেকে আর প্রাণ জড় থেকে উন্মােষিত হলেও প্রাণের মধ্যে এমন এক গুণ বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা জড়ের নেই, আবার মনের মধ্যে এমন গুণ রয়েছে যা প্রাণের মধ্যে নেই। তাদের মতে, জড় থেকে প্রাণ এবং প্রাণ থেকে মন পর্যায়ক্রমে নিরবচ্ছিন্ন থাকলেও প্রাণ জড়ের জটিল আকার মাত্র নয়, প্রাণ হলাে নতুন গুণ ও শক্তিবিশিষ্ট এমন এক সত্তা যা উন্মেষের আগে জড় ও প্রাণ প্রভৃতি স্তরের মধ্যে নিহিত ছিল না। উন্মেষবাদের দুজন সফল প্রবক্তা হলেন মর্গান এবং আলেকজান্ডার। আমরা এদের মত সংক্ষেপে আলােচনা করব।

মর্গানের উন্মেষমূলক বিবর্তনবাদঃ মর্গানের মতে, বিবর্তনপ্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরে নতুন উন্মােষিত গুণের আবির্ভাব ঘটে। তিনি বিবর্তনপ্রক্রিয়ার অনুকূল একটি শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করেন। তিনি এই শক্তি বা সক্রিয়তাকে কখনও মন, কখনও আত্মা আবার কখনও স্রষ্টা নামে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, এই শক্তিই আকর্ষণীশক্তিরূপে কাজ করে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বার্গসের সৃজনমূলক বিবর্তনবাদ যতটা হৃদয়গ্রাহ্য ততটা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। প্রাণপ্রবাহের অন্ধসৃষ্টি, ব্যাকুলতা কল্পনায় তিনি যথেষ্ট কল্পনাশক্তির পরিচয় দিয়েছেন। তার লেখা পড়লে আমাদের চিত্ত তৃপ্ত হয়, কল্পনায় রং লাগে। কিন্তু আমাদের বুদ্ধির দরবারে তা তেমন সাড়া জাগাতে পারে না।