প্রশ্নঃ ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে উদ্দেশ্যমূলক যুক্তি দাও।

অথবা, ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে উদ্দেশ্যমূলক যুক্তি আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ জগৎ এবং জীবনের মৌলিক বিষয়ের যৌক্তিক আলােচনা হল দর্শন। দর্শনের আলােচ্য বিষয়গুলাের মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যতম বিষয়। বিভিন্ন দার্শনিক ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিভিন্ন প্রমাণ দিয়েছেন। এ প্রমাণের মধ্যে চারটি প্রমাণকে দর্শনের ইতিহাসে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয়। তার মধ্যে উদ্দেশ্য বিষয়ক যুক্তি বা প্রমাণ অন্যতম। নিম্নে ঈশ্বরের অস্তিত্ববিষয়ক প্রমাণ হিসেবে উদ্দেশ্যমূলক যুক্তি ব্যাখ্যা করা হলাে-

উদ্দেশ্যমূলক প্রমাণঃ ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণে উদ্দেশ্যমূলক যুক্তিটি খুবই প্রাচীন এবং জনপ্রিয়। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো, এরিস্টটল, মধ্যযুগীয় স্টোয়িকরা, টমাস একুইনাস এবং আধুনিক জর্জ বার্কলি, লাইবনিজ, উইলিয়াম পেলি প্রমুখ দার্শনিক ও চিন্তাবিদ উদ্দেশ্যমূলক যুক্তির প্রবক্তা।

উদ্দেশ্যমূলক শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে Teleological. আর এ শব্দটি এসেছে ইংরেজি Teleology শব্দ থেকে। যার উৎপত্তির মূলে রয়েছে গ্রিক শব্দ Telos. Telos শব্দের বাংলা অর্থ হল উদ্দেশ্য বা পরিণাম। তাই বিশ্বপ্রকৃতির নিয়ম-শৃঙ্খলা ও উদ্দেশ্য-পরিণামের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে যে যুক্তি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণে সচেষ্ট তাকে বলে উদ্দেশ্যবিষয়ক যুক্তি।

উদ্দেশ্যবাদীদের মতে, আমরা যাকে প্রকৃতি বলি তা ঘটনাবলির একটি সুশৃঙখল ব্যাপার। গ্রহগুলাে তার কক্ষপথে নিয়মিত পরিভ্রমণ করে, শস্যবীজের পুষ্টি ও বিকাশ ঘটে একই নিয়মে, ঋতুসমূহের পরিবর্তন ঘটে। প্রত্যেক জিনিসেরই সঙ্গতি রয়েছে এক বিধিবদ্ধ নিয়মের সঙ্গে। সব কিছুই নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রকৃতির এই বিশাল শৃঙ্খলা আপনা-আপনা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। এই নিয়ন্ত্রণের জন্য অবশ্যই একটি বুদ্ধিমান চেতনসত্তার অস্তিত্ব থাকা চাই। আর এ চেতনসত্তাই ঈশ্বর।

উইলিয়াম পেলির মতে, একটি ঘড়ির নকশা এবং কলাকৌশল থেকে আমরা যেমন একজন ঘড়ি নির্মাতার আস্তিত্ব অনুমান করতে পারি, তেমনি প্রকৃতি ও জীবজগতের শৃঙ্খলা ও পরিকল্পনা থেকে একজন পরিকল্পনাকারীর অস্তিত্ব অনুমান করা যায়। আর এ পরিকল্পনাকারীই হলেন ঈশ্বর।

মার্টিনিউর মতে, জগতে নির্বাচন, সংযােগ, ও স্তরভেদ- এই তিনটি ব্যাপারের উপস্থিতিও একজন পরম চেতন বুদ্ধিমান সত্তার অস্তিত্ব প্রমাণ করে। তিনটি মানদণ্ডের নিরিখে শনাক্ত করা যায় এক বুদ্ধিমান মনের কর্মকাণ্ডকে। সুতরাং আমরা দেখতে পাই যে, জগতে প্রতিটি ঘটনাই এক উদ্দেশ্যের সামঞ্জস্য বহন করে। সৌরমণ্ডলে বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহের আবর্তন, দিনের পর রাত, আবার সুখের পর দুঃখ- এ সবই এক উদ্দেশ্য সাধনকারীর অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে ঈশ্বর অস্তিত্বশীল।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, দর্শনে আলােচিত কোন মতবাদই সমালােচনার উর্ধ্বে নয়, তেমনি উদ্দেশ্যবিষয়ক যুক্তিটিও যথেষ্ট সমালােচনার সম্মুখীন হয়। তা সত্ত্বেও ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে উদ্দেশ্যবিষয়ক যুক্তিটি দর্শনে যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে আলােচিত হয়ে থাকে।