প্রশ্নঃ নীতিবিদ্যা ও ধর্মের সম্পর্ক নিয়ে দার্শনিকদের মতবাদ আলােচনা কর।

অথবা, নীতিবিদ্যা ও ধর্মের সাদৃশ্য নিয়ে দার্শনিকদের মতবাদ আলােচনা কর।

অথবা, নীতিবিদ্যা কিভাবে ধর্মের সাথে সম্পর্কিত অথবা, নীতিবিদ্যা ও ধর্মের মধ্যে কি কি সম্পর্ক রয়েছে আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ নীতিবিদ্যা সমাজে বসবাসকারী মানুষের আচরণ সম্পৰ্কীয় বিজ্ঞান। সামাজিক জীব হিসেবে। মানুষকে সমাজে বসবাস করতে হলে নীতিবিদ্যার জ্ঞান থাকা জরুরি। কারণ নীতিবিদ্যা মানুষের আচরণ ভালাে-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সৎ-অসৎ, বিচার করে। মানুষ বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন জীব। বুদ্ধিবৃত্তি মানব প্রকৃতির এমন একটি গুণ, যা মানুষকে শুধু অন্যান্য জীব থেকে পৃথকই করেনি। বরং মানুষকে অন্যান্য জীব থেকে একটি উচ্চতর আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব বলা হয়। তাই মানুষ মানব জীবন সম্পর্কে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে। সুতরাং মানুষ বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন জীব বলেই নৈতিক জীবন-যাপন করতে পারে। তাই নীতিবিদ্যার জ্ঞান থাকা একান্ত জরুরি। নিম্নে নীতিবিদ্যা ও ধর্মের সম্পর্ক আলােকপাত করা হলাে-

নীতিবিদ্যার সংজ্ঞাঃ নীতিবিজ্ঞানের ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘Ethics’; যা গ্রিক শব্দ ‘Ethica’ হতে উদ্ভূত হয়েছে। Ethica’ শব্দের অর্থ হলাে রীতিনীতি বা আচার-আচরণ ইত্যাদি। এসব শব্দের তাৎপর্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নীতিবিদ্যাকে আচরণ সম্পৰ্কীয় বিজ্ঞান বলা হয়। সুতরাং নীতিবিজ্ঞান নৈতিক আদর্শের মানদণ্ডের ভিত্তিতে সমাজের মানুষের আচরণের মূল্যায়ন করে থাকে। নীতি বিজ্ঞান সম্পর্কে বিভিন্ন চিন্তাবিদ বিভিন্ন মতবাদ দিয়েছেন।

ম্যাকেঞ্জি নীতিবিজ্ঞানের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেন, “আচরণের ন্যায় বা ভালাে নিয়ে যে আলােচনা তাকে নীতিবিদ্যা বলে। এ বিদ্যা আচরণ সম্পৰ্কীয় সাধারণ মতবাদ এবং এ বিদ্যা ন্যায় বা অন্যায় ও ভালাে বা মন্দ প্রবন্দতার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের ক্রিয়াবলি আলােচনা করে।” [Jhon S. Mackenzie, A Manual of Ethics, (1964),P.1]

নীতিবিজ্ঞানের সংজ্ঞায় উইলিয়াম লিলি বলেন, “নীতিবিদ্যা হচ্ছে সমাজে বসবাসকারী মানুষের আচরণ সম্পৰ্কীয় এমন একটা আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান, যা এই আচরণকে ন্যায় বা অন্যায়, ভালাে বা মন্দ বা অন্য কোনাে একই ধরনের পন্থায় বিচার করে।” [William Lillie, An Introduction to Ethics London, 1966]

সুতরাং উল্লিখিত সংজ্ঞাগুলাের আলােকে বলা যায় যে, নীতিবিদ্যা আচরণ সম্পৰ্কীয় বিজ্ঞান।

ধর্মঃ ধর্ম “ধৃ” ধাতু থেকে উদ্ভূত। যার অর্থ ধারণ করা। সাধারণ মানুষ ধর্মকে ধারণ করে ঈশ্বরের প্রতি নিজের আনুগত্য প্রকাশ করে এবং ইহজগৎ ও পরজগতে শাস্তি ভােগ করার আশা পােষণ করে। ধর্ম এক অদৃশ্য শক্তির সাথে আমাদের সম্পর্ক স্থাপন করে।

দার্শনিক আল্লামা ইকবাল বলেন, “Religion is not a departmental affair. It is neither our thought, no more feeling, no more action; it is an expression of the whole man.”

সুতরাং ধর্ম বলতে আমরা বুঝি, যে অনুভূতিকে যা কোনাে অতিপ্রাকৃত সত্তায় মানুষের বিশ্বাস, সে বিশ্বাস তার জীবনের মূল অনুভূতি ও ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে।

ধর্ম ও নীতিবিদ্যাঃ নীতিবিদ্যা নৈতিকতা সম্পর্কীয় বিদস। পক্ষান্তরে, ধর্ম হচ্ছে এমন এক অতিপ্রাকৃত সত্তায়। বিশ্বাস, যা বিশ্বাসকারীকে এমন আবেগজনিত ভাবে প্রভাবিত করে যে, তা তাকে অতিপ্রাকৃত সত্তার দিকে চালিত কতকগুলাে ক্রিয়া সম্পাদন করে। ধর্ম সমগ্র বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা, ধারক ও নৈতিক কর্তা হিসেবে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপনের কথা বলে। ধর্ম ঈশ্বরকে নৈতিক কর্তা হিসেবে মনে করে বলে নীতিবিদ্যা ও ধর্মের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।

নীতিবিদ্যা ও ধর্ম সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদঃ নীতিবিদ্যার সাথে ধর্মের সম্পর্ক নিয়ে বেশ বির্তক আছে। নিচে তা আলােচনা করা হলাে-

ডেকার্ট, লক ও প্যালের মতেঃ তারা মনে করেন যে, নৈতিক ধারণার উদ্ভব ধর্ম থেকে। নৈতিক নিয়ম ঈশ্বরের আদেশ। ঈশ্বর খেয়াল-খুশিমত যা ইচ্ছা তা করতে পারে না। নৈতিকতাবােধের চালিকাশক্তি মানুষের পছন্দ, বিচার বিবেচনা ও বিবেক থেকে আসে। নৈতিকতা ব্যক্তির নৈতিক পছন্দ ও সিদ্ধান্ত থেকে আসে। নৈতিক আদেশ ঈশ্বরের আদেশ, এ কথা বলে যদি নৈতিকতাবােধের প্রেরণা বাইর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তা নৈতিক পদবাচ্য হওয়ার যােগ্যতা হারিয়ে ফেলে।

কান্ট ও মার্টিনিউর মতেঃ তাদের মতে-ধর্মীয় ধারণা নৈতিকতা থেকে আসে। নৈতিকতা আমাদের জীবনের মূল বিষয়। কিন্তু তা ইচ্ছার স্বধীনতা, আত্মা, অমরত্ব ও ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রকাশ করে। পুণ্য ও শান্তিকে একই সাথে অবশ্যই চলতে হবে। কিন্তু বাস্তবে এদের মিল পাওয়া যায় না। পুরস্কার ও শাস্তি সর্বশক্তিমান সত্তা দ্বারা প্রাপ্ত হয়, যাকে ঈশ্বর বলে। আমরা আমাদের বিবেকের দ্বারা ন্যায় ও অন্যায়কে জানি।

আধুনিক বিশ্লেষকদের মতেঃ যদিও নৈতিক ও ধর্মের মধ্যে যৌক্তিক ও ব্যবহারিক সম্পর্ক রয়েছে, তথাপি মানুষের চিন্তায় ও আচরণের সময় এ দুটির পার্থক্য করা হয়। আর এ অর্থে কোনাে ব্যক্তি ধর্ম-নিরপেক্ষ মনােভাব পােষণ করেও নৈতিকতা পালন করতে পারেন। পক্ষান্তরে, কোনাে ব্যক্তি ধর্মীয় মনােভাব পােষণ করেও নৈতিকতা পালন নাও করতে পারেন। সব মানুষের ধারণাশক্তি সমান থাকে না। আবার, নৈতিক বিবেচনাবিহীন ধর্ম অনৈতিক প্রবণতা দেখায় এবং ফলে ধর্ম তার তাৎপর্যের অনেক কিছু হারিয়ে ফেলে। আর তাই বলা যায়- নীতিবিদ্যা ও ধর্ম একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে পারে।

ধর্ম ও নীতিবিদ্যার সম্পর্ক বা সাদৃশ্যঃ ধর্ম হলাে বিশ্বাসের ব্যাপার। নীতিবিদ্যাও সে রকম। ধর্ম আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস করে। নীতিবিদ্যা ও আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস করে। নৈতিক আদর্শ হলাে জীবনের অন্যতম পরম আদর্শ। যাকে ক্ষুদ্র জীবনে লাভ করা যায় না। এ জন্য আত্মার অমরত্বকে স্বীকার করে না নিলে মানুষের এ নৈতিক প্রচেষ্টার কোনাে সার্থকতা থাকে না। যেহেতু ধর্ম ও নীতি আত্মার অমরত্বকে স্বীকার করে নেয়, তাই উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। নিচে নীতিবিদ্যার সাথে ধর্মের সম্পর্ক আলােকপাত করা হলাে-

১. ধর্ম নীতিবিদ্যার জনকঃ ধর্মকে নীতিবিদ্যার জনক বলা হয়। নীতি ও নৈতিক আদর্শ ঈশ্বরের অবদান। ঈশ্বর নিজ ইচ্ছায় নীতি ও নিষেধ সৃষ্টি করেন। তার বিধান-ই নৈতিক জীবনের শ্রেষ্ঠ বিধান। এ বিধান পালন করলে মানষ শান্তি পায়। ভঙ্গ করলে শাস্তি পাবে। তাই প্রথমে ঈশ্বর পরে ধর্ম তারপর নীতি। তাই ধর্মকে নীতিবিদ্যার জনক বলা হয়।

বিশ্লেষণঃ এ মতবাদ গ্রহণযােগ্য নয়। ভালাে-মন্দ, ঈশ্বরের খেয়াল-খুশির উপর নির্ভর করে না। যদি তাই হতাে তবে ঈশ্বর ভালোকে মন্দ এবং মন্দকে ভালাে বলে নির্দেশ দিতে পারতেন। প্রকৃত পক্ষে ঈশ্বর নৈতিক আদর্শের পূর্ণ প্রকাশ। যা তার স্বভাবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তাই ভালাে। আর যা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় তা মন্দ। এ মতবাদ অনুযায়ী নীতিবােধ বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। শাস্তির ভয়ে বা পুরস্কারের আশায় যে কাজ করা হয় তার কোনাে নৈতিক মূল্য নেই।

২. নীতি ধর্মের জনকঃ আমরা বিশ্বাস করি যে, মানুষ সৎ আচরণ করলে সুখ পায় এবং অসৎ আচরণ করলে শাস্তি পায়। কিন্তু বাস্তব জীবনে আমরা সৎ ব্যক্তিকে সব সময় সুখী হতে এবং অসৎ ব্যক্তিকে শাস্তি পেতে দেখি না। সাধুতার সাথে সুখের সম্পর্ক বিশ্লেষক নয় সংশ্লেষক।

৩. নীতি ও ধর্ম ঈশ্বরের ধারণা দেয়ঃ সদাচার যদি সুখ না আনে এবং অসদাচার যদি দুঃখ না দেয় তবে নৈতিক জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। তাই কান্টের মতে- কোনাে নৈতিক শক্তি এ বিশ্বের পেছনে কাজ করছে যা ভালাে আচরণের সাথে বেসুখের এবং খারাপ আচরণের সাথে শাস্তির সংযােগ সাধন করে। এ জীবনে না হােক পরবর্তী জীবনে সাধু ব্যক্তিকে পুরস্কৃত করবে এবং খারাপ ব্যক্তিকে শাস্তি দেবে। এ নৈতিক শক্তিই হলাে সর্বশক্তিমান সর্বজ্ঞ ঈশ্বর। তাই বলা যায়, নীতি এবং ধর্ম ঈশ্বরের ধারণা দেয়।

৪. নৈতিক বাধ্যবাধকতা বােধঃ নৈতিক বাধ্যবাধকতা বােধ থেকেই ঈশ্বরের ধারণা জন্মে। তাছাড়া নৈতিক পূর্ণতার একটা রূপ যখন আমরা কল্পনা তখন বাস্তবে কোনাে মানুষের মধ্যে এ আদর্শের পূর্ণতা পাই না। কিন্তু এ আদর্শ যদি বাস্ত বনা হয়। শুধু কল্পনার বিষয় হয় তবে মানুষ এ আদর্শের প্রতি আস্থা হারাবে। মানুষের চরিত্রকে তা প্রভাবিত করবে না। অতএব, আমরা বিশ্বাস করি যে, নৈতিকতা যার মধ্যে রূপ লাভ করছে তিনি ঈশ্বর।

৫. ধর্ম ও নীতিবিদ্যা নৈতিকতা শেখায়ঃ নীতিবিদ্যা ও ধর্মের সম্পর্ক নিয়ে বেশ বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও এদের মধ্যে সাদৃশ্য ও আছে। ধর্ম ও নীতিবিদ্যা নৈতিকতা শেখায়। সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র সঠিকভাবে চলতে পারে, যা ধর্ম ও নীতিবিদ্যা থেকে জানা যায়। প্রকৃত পক্ষে, নীতিজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ দেশ তথা বিশ্বের অমূল্য সম্পদ। তাই বলা যায়, নৈতিকতা শেখায় কেবল ধর্ম ও নীতিবিদ্যা।

৬. ধর্মীয় বিধির সাথে মিলঃ নীতিবিদ্যা ও ধর্ম যদিও দুটো স্বতন্ত্র বিদ্যা। তথাপি অনেক ক্ষেত্রে নৈতিক নিয়ম বা বিধির সাথে ধর্মীয় বিধির যথেষ্ট মিল দেখা যায়।

ধর্ম ও নীতিবিদ্যার বৈসাদৃশ্যঃ ধর্ম ও নীতিবিদ্যার নিজস্ব উৎস আছে। কেননা সুষ্ঠু নৈতিক সূত্রের উপর নির্ভরশীল না হয়ে ধর্ম থাকতে পারে না। আবার ধর্মকে স্বীকার না করেও অনেক লােক নৈতিকতা পালন করতে পারে। এ দিক থেকে ধর্ম ও নৈতিকতার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও ধর্ম ও নীতিবিদ্যা ২টি স্বতন্ত্র বিষয়। ধর্ম ও নীতিবিদ্যার পার্থক্য নিম্নে দেওয়া হলাে-

প্রথমতঃ নৈতিকতার চেয়ে কর্তব্যের একটা ব্যাপকতর পরিসর ধর্মের অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান, প্রার্থনা ধর্মের অন্তর্ভুক্ত। পক্ষান্তরে, নৈতিকতার এসব কর্তব্যের সাথে কোনাে সরাসরি যােগাযােগ নেই।

দ্বিতীয়তঃ নৈতিকতার চেয়ে ধর্মের মধ্যে একটা অধিকতর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আবেগমূলক অনুভূতি রয়েছে। আবেগের দ্বারা স্পর্শিত নৈতিকতা হিসেবে ধর্ম সম্পর্কে ম্যাথিউ আর্নল্ডের প্রসিদ্ধ সংজ্ঞার দ্বারা নৈতিকতা ও ধর্মের এই পার্থক্য বিশেষভাবে ধরা পড়ে।

তৃতীয়তঃ নৈতিকতা কেবল মানুষের আচার-আচরণ নিয়ে জড়িত। পক্ষান্তরে, ধর্ম মানুষের সমগ্র ব্যক্তিত্ব নিয়ে জড়িত।

চতুর্থতঃ ধর্মের আলােচ্য বিষয় ঈশ্বর এবং নৈতিকতার কেন্দ্র বিন্দু মানুষ। এটা বেশ বােধগম্য যে, অতি প্রাকৃত সত্তার উল্লেখ ছাড়াও বিশুদ্ধ মানবিক নৈতিকতা থাকতে পারে। পক্ষান্তরে, অতি-প্রাকৃত সত্তার উল্লেখ ছাড়া ধর্মের অপরিহার্য স্বরূপ নষ্ট হয়ে যায়।

নৈতিকতা ধর্মের সাথে কতকগুলাে ক্ষেত্রে জড়িতঃ নৈতিকতা ও ধর্মের এই পার্থক্যকরণের দিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, নৈতিকতার সমর্থনের জন্য ধর্মের প্রয়ােজন পড়ে কি-না , বা ধর্ম ছাড়াও নৈতিকতা চিরন্তন হয়ে থাকতে পারে কি-না? নীতিবিদ্যার ইতিহাস আলােচনা করলে দেখা যায়, অনেকে মনে করেন যে, ধর্মের সাহায্য ছাড়াও নৈতিকতার অস্তিত্ব স্বতন্ত্ররূপে চিরন্তন হয়ে থাকতে পারে। আবার, অনেকে মনে করেন যে, নৈতিকতা ধর্মের সাহায্য ছাড়া চলতে পারলেও ধর্মের সাহায্য ছাড়া নৈতিকতার কতিপয় উচচতর রূপ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। নীতিবিদ্যায় ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পৰ্কীয় স্বীকার্য সত্য অত্যাবশ্যকীয় না হলেও প্রয়ােজনীয়। এ দিক থেকে নৈতিকতা ধর্মের সাথে কতকগুলাে ক্ষেত্রে বিশেষভাবে জড়িত।

প্রথমতঃ নৈতিকতা একধরনের তত্ত্ববিদ্যক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যঞ্জনায় প্রকাশ করে। যা ধর্মের দ্বারা সরবরাহ করা হয়ে থাকে।

দ্বিতীয়তঃ ধর্ম নৈতিক মূল্যের বিষয়গত ধারণা দিয়ে থাকে। অনেক সময় নৈতিক সংগ্রামের বাস্তবতা সম্পর্কে মানুষের মনে নৈতিক মূল্য অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সংশয়ের সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু ধর্ম নৈতিক শাসক হিসেবে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার্য সত্য হিসেবে ধরে নিয়ে মানুষের মনের এই নৈতিক সংশয় দূর করতে পারে।

তৃতীয়তঃ নৈতিকতা এমন এক তাড়নাকে প্রকাশ করে যা অতি প্রাকৃত। এই মত তাদের দ্বারাই সমর্থিত হয়ে থাকে, যারা মনে করেন যে, আমাদের মধ্যকার বিবেকের বাণীই ঈশ্বরের বাণী।

চতুর্থতঃ নৈতিকতা নৈর্ব্যক্তিক নিয়ম-এর আনুগত্যের পরিবর্তে বরং ব্যক্তিগত আনুগত্যকে ব্যঞ্জনায় প্রকাশ করে। ব্যক্তিগত ঈশ্বরের প্রতি আমাদের বাধ্যতাবােধের কথা উল্লেখ করে ধর্ম নৈতিক বাধ্যতাবােধের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে।

পঞ্চমতঃ নৈতিকতার সর্বোত্তম ক্ষেত্রে অপ্রাকৃতিক দিক রয়েছে। নৈতিক সূত্রের অনুসন্ধানকারীরা অনেক সময় তাদের ক্রিয়াবলির এই পার্থিব জগতের ফলাফলের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ না রেখে একটা আধ্যাত্মিক জগতের ফলাফলের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ রাখেন। যাকে মূলত নৈতিক’ বলে বিশ্বাস করা হয়। ধর্ম এই নৈতিক শৃঙ্খলার ইঙ্গিত দিয়ে থাকে।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, অনেক চিন্তাবিদ নৈতিকতার সমর্থনে ধর্মের প্রয়ােজনীয়তার ব্যাপারে যেসব যুক্তি উপস্থাপন করে, সেগুলাের মূল্য যাই থাকুক না কেন এবং নৈতিকতার সাথে ধর্মের সম্পর্ক যতই নিবিড় হােক না কেন; এটা বেশ বলা যায় যে, নৈতিকতা ও ধর্ম দুটো স্বতন্ত্র বিষয়। কেননা, নৈতিক কর্তব্য ও ধর্মীয় কর্তব্য এক নয়। কারও ক্ষতি না করা হচ্ছে নৈতিক দায়িত্ব। অপর দিকে, ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করা ও তার আদেশকে পালন করা ধর্মীয় দায়িত্ব। তাই বলা যায় যে, নীতিবিদ্যা ও ধর্মের সম্পর্ক যদিও খুবই ঘনিষ্ঠ, তথাপি নীতিবিদ্যা ও ধর্ম দুটো স্বতন্ত্র বিষয়।