অথবা, ডেকার্টের বুদ্ধিবাদ জ্ঞানের উৎপত্তিবিষয়ক মতবাদ হিসাবে কতটা গ্রহণযােগ্য?
ভূমিকাঃ আধুনিক দর্শনের প্রাণস্পন্দন হলাে জ্ঞানবিদ্যা ও জ্ঞানের উৎপত্তি এর পরিধি, প্রকৃতি প্রভৃতি এ জ্ঞানবিদ্যার আলােচ্য বিষয়। জ্ঞানের উৎপত্তিসংক্রান্ত যেসব মতবাদ গুরুত্বের সাথে আলােচিত হয়ে আসছে, তার মধ্যে ডেকার্টের বুদ্ধিবাদ উল্লেখযােগ্য। তিনি আধুনিক দর্শনের রূপকার। তিনি তার “Discourse of Method” এবং “Meditation” গ্রন্থে বুদ্ধিবাদ সম্পর্কে আলােচনা করেন।
ডেকার্টের বুদ্ধিবাদঃ যুক্তিবাদী দার্শনিক হওয়ায় সারা দিন দার্শনিক রেনে ডেকার্ট তার দর্শনের শুরুতেই জ্ঞান অর্জনের সহায়ক হসািবে ইন্দ্রিয়ের প্রাধান্যকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেন। তার মতে, ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যক্ষিত জগৎ সত্য নয়। কেননা, প্রতক সন্দেহ করা যায়। তিনি সন্দেহবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তার দার্শনিক চিন্তাধারা শুরু করেন। প্রথমে তিনি নিজের অস্তিত্বকেও সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেন। তবে তিনি সন্দেহবাদী নন। কেননা, পরক্ষণে তিনি দেখলেন যে জগতের সবকিছুকে সন্দেহ করা গেলেও নিজের অসিত্বকে সন্দেহ করা যায় না। কারণ, তাহলে সন্দেহ করার কোনাে পাত্র বাকি থাকে না। নিজের অস্তিত্বে সন্দেহ করলে সন্দেহকারীর অস্তিত্ব প্রমাণ হয়ে যায়। কেননা, সন্দেহ কর্তা ছাড়া সন্দেহ করা সম্ভব নয়। তাই তিনি মন্তব্য করেন, ‘Gogito ergo sum or think therefore exist’. অর্থাৎ আমি চিন্তা করি, তাই আমি অস্তিত্বশীল। আর এভাবেই সংশয় থেকে তিনি নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন এবং পরে বস্তুজগতের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। ডেকার্টের তিনটি অস্তিত্বসূচক বচন হচ্ছেঃ আমি অস্তিত্বশীল, ঈশ্বর অস্তিত্বশীল এবং বস্তুজগৎ অস্তিত্বশীল। ডেকার্টই সর্বপ্রথম তার দর্শনে গণিতিক বা অবরােহ পদ্ধতির প্রয়ােগ করেন। ডেকার্ট তার দর্শনকে সুদৃঢ় করতে তার ধারণাকে তিন ভাগে বিভক্ত করেন। যথা-
(১) সহজাত ধারণাঃ ডেকার্টের মতে, এমন কিছু ধারণা আছে, যা মানুষ জন্মের সময় উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে থাকে। এগুলাে সহজাত ধারণা। যেমন- ঈশ্বর, নিত্য ইত্যাদি, এসব ধারণা স্বতঃসিদ্ধ, সত্য, স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল।
(২) আগন্তুক ধারণাঃ যেসব ধারণা সম্পূর্ণরূপে বাহির থেকে আমাদের মনে প্রবেশ করে সেগুলােকে আগন্তুক ধারণা বলে। যেমনঃ গাছপালা, পাহার-পবর্ত, নদ-নদী ইত্যাদি আমাদের মানব ধারণা।
(৩) কত্রিম ধারণাঃ বিভিন্ন ধারণা একত্রিত হয়ে আমাদের মনে যে নতুন ধারণার সৃষ্টি হয় তাকেই বলে কৃত্রিম ধারণা, কৃত্রিম ধারণা আমাদের মন দ্বারা তৈরি। যেমনঃ সােনার পাহাড়, ঘােড়ার ডিম, পঙ্খীরাজ ঘােড়া ইত্যাদি। ডেকার্টের মতে পঞ্চেন্দিয়ের মাধ্যমে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা নিয়ত পরিবর্তনশীল। তাই এটি যথার্থ জ্ঞানের উৎস হতে পারে না। একমাত্র বুদ্ধির মাধ্যমেই আমরা যথার্থ ও সুস্পষ্ট জ্ঞান পেতে পারি।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ডেকার্টের বুদ্ধিবাদ সমালােচিত হলেও দর্শনের ইতিহাসে তার বুদ্ধিবাদ এক বিশেষ অধ্যায়ের সূচনা করেছে। মূলত তিনি প্রথম দার্শনিক আলােচনায় গাণিতিক পদ্ধতি প্রয়ােগ করেন। তার হাতেই বুদ্ধিবাদ একটি দৃঢ় ও সুস্পষ্ট ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা পায়। তাই তার বুদ্ধিবাদের গুরুত্ব অপরিসীম।
Leave a comment