উপস্থাপনাঃ পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে ষােড়শ শতাব্দী সড় ইউরােপে পুনর্জাগরণের যুগ। এ সময় বহির্বিশ্বে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার জন্য সউরােপীয়দের মধ্যে নতুন উদ্যমের সৃষ্টি হয়। ফলে ভারত উপমহাদেশের সাথে প্রত্যক্ষ বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ইউরােপীয় বণিকরা উৎসুক হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে ইউরােপীয় বণিকরা তাদের অক্লান্ত চেষ্টার ফলে ভারত উপমহাদেশের সাথে প্রত্যক্ষ বাণিজ্যের সুযােগ লাভ করে।
ভারত উপমহাদেশে ইউরােপীয়দের আগমন:
১. পর্তুগীজদের আগমনঃ ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম পর্তুগীজ বণিকরা ভারত উপমহাদেশে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে আগমন করে। পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা সর্বপ্রথম ভারত উপমহাদেশে আসার নতুন নৌপথ আবিষ্কার করেন। কালক্রমে তারা কালিকট, কোচিন, গােয়া, দমন, দিউ, সালসেট, বােসিন, সিংহল, বােম্বাই ও হুগলীতে বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করে। প্রায় এক শতাব্দী পর্যন্ত তারা বাণিজ্য ক্ষেত্রে আধিপত্য বজায় রাখে। পরবর্তীতে ইংরেজ ও ফরাসিদের আগমনে এ আধিপত্য ক্ষুন্ন হয়।
২. ইংরেজদের আগমনঃ ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ২১৭ জন ইংরেজ বণিক ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ নামে একটি বণিক সংঘ গঠন করে। তারা রাণী এলিজাবেথের কাছ থেকে The Governor and Company of Merchant of London Trading to the India নামক একটি বাণিজ্যিক সনদের মাধ্যমে প্রাচ্যের সকল দেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের অনুমতি ও অধিকার লাভ করে। এছাড়াও তারা পনেরাে বছরের জন্য ভারত উপমহাদেশে একচেটিয়া বাণিজ্যের সনদ লাভ করে ক্রমে ক্রমে বাণিজ্য সম্প্রসারণ করে।
১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্টেন হকিন্স ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস-এর একটি পত্র নিয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাথে সাক্ষাৎ করে বাণিজ্যিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করেন।
১৬১২ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্টেন বেস্ট পর্তুগীজ নৌবহরকে পরাজিত করে সম্রাট জাহাঙ্গীরের এক ফরমানবলে সুরাটে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করেন।
১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস্ স্যার টমাস রােকে দূত হিসেবে জাহাঙ্গীরের দরবারে প্রেরণ করেন। তিনি বাণিজ্য সংক্রান্ত কতগুলাে সুবিধা আদায় করেন।
১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে ‘ফ্রান্সিস ডে’ নামক একজন ইংরেজ করমণ্ডল উপকূলে কিছু জমি ইজারা নিয়ে মাদ্রাজ শহরের গােড়া পত্তন করেন। এখানে একটি বাণিজ্য কেন্দ্র এবং সেন্ট জর্জ দুর্গ স্থাপিত হয়।
১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস পর্তুগীজ রাজকুমারী ক্যাথরিন ব্রাগাঞ্জাকে বিয়ে করে যৌতুকস্বরূপ মুম্বে শহরটি লাভ করেন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাৎসরিক দশ পাউন্ডের বিনিময়ে ইজারা দেন।
১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে জব চার্নক ভাগীরথী নদীর তীরে কালিকট, সুতানটি ও গােবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রাম ক্রয় করে কলকাতা নগর প্রতিষ্ঠা করেন।
৩. ওলন্দাজ ও দিনেমারদের আগমনঃ পর্তুগীজ ও ইংরেজদের দেখাদেখি হল্যান্ড দেশের অধিবাসী ডাচ বা ওলন্দাজরা এবং পরে ডেনমার্কের অধিবাসী দিনেমাররা ভারত উপমহাদেশে বাণিজ্য করতে আসে। ১৬৬০ সালে দিনেমাররা পশ্চিম বঙ্গের শ্রীরামপুরে বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করে। ১৬৭৬ সালে ওলন্দাজরা ‘ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া’ নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে। পরিশেষে ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ তাদের পরাস্ত করে ভারত উপমহাদেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়।
৪. ফরাসিদের আগমনঃ ভারত উপমহাদেশে ফরাসিরা সর্বশেষে আগমন করে। ১৬৬৪ সালে ফরাসিরা বাংলাদেশের চন্দননগর, মাদ্রাজের পণ্ডিচেরী, মালাবার উপকূলে মাহে এবং করমণ্ডল উপকূলে কারিকল নামক স্থানে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের ন্যায় তাদেরও এ দেশে সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্নে পেয়ে বসে। ফলে দু’জাতির মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রাচুর্য ও শক্তির দিক দিয়ে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চেয়ে বেশি উন্নত ছিল। ফলে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে প্রথম ও দ্বিতীয় কর্নাটের যুদ্ধে ফরাসিরা এঁটে ওঠতে না পারায় তাদের সাম্রাজ্য স্থাপনের আকাঙ্ক্ষা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
উপসংহারঃ ভারত উপমহাদেশ ছিল ধনরত্নে পরিপূর্ণ। এ উপমহাদেশের ধনসম্পদের লােভে ইউরােপীয় বণিকরা বাণিজ্য করতে এসে শেষ পর্যন্ত এখানে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। এমনকি উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করে।
Leave a comment