বিজয়নগরের কৃষিব্যবস্থা:

পণ্ডিত নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী লিখেছেন যে, বিজয়নগরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ গ্রামে বসবাস করত এবং তাদের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি-উৎপাদন। জমির মালিকানা সকল বৃত্তির মানুষের কাছেই সামাজিক মর্যাদার দ্যোতক হিসেবে বিবেচিত হত। এইভাবে গ্রামগুলি কৃষক ও ভূস্বামীদের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছিল। শাস্ত্রীর ভাষায়: “The village was thus primarily a settlement of peasants, and its assembly an association of landlords.” অতীত কাল থেকেই এখানে কৃষিযোগ্য জমি গ্রামের অধিবাসীদের মধ্যে সময়ভিত্তিক (Periodical) বণ্টন করা হত। ছোটো-বড়ো ভূস্বামী ছাড়াও ছিল অসংখ্য ভূমিহীন ক্ষেতমজুর। এই ‘কৃষক সর্বহারা’ (agrarian proletariat) শ্রেণি ছিল কৃষি-উৎপাদনের প্রধান শক্তি। তবে এদের অধিকাংশের অবস্থা ছিল ভূমিদাসদের সমতুল্য। সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বহীন এই শ্রেণির মানুষ নিজেদের অবস্থার রূপান্তর ঘটানোর কোনো ক্ষমতাই ধরত না। কামার, কুমোর, তাঁতি ইত্যাদি ক্ষুদ্র কারিগরদের গ্রামে আটকে রাখার জন্য কিছু কিছু জমি চাষের অধিকার দেওয়া হত। নিম্নবর্গের গৃহভৃত্যদের কাজের বিনিময়েও কিছু জমি বরাদ্দ করা হত।

দৈনিক কৃষি-মজুরদের সাধারণত উৎপন্ন শস্যে মজুরি দেওয়া হত। বর্গাচাষ বিজয়নগরে জনপ্রিয় ছিল। বিশেষত মঠ ও মন্দিরের জমিগুলি বর্গা বা ভাগচাষীদের মধ্যে বণ্টন করে চাষাবাদ করা হত। নীলকণ্ঠ শাস্ত্রীর মতে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ধরনের বর্গাচাষে কৃষক বা বর্গাদার জমির আংশিক মালিকানার অধিকারী হয়ে যেতেন।

খাদ্যশস্য ও ডালজাতীয় শস্য উৎপাদনের পাশাপাশি বিজয়নগরে ফুল, ফল ও অন্যান্য কাঁচা আনাজের চাষ জনপ্রিয় ছিল। কালক্রমে বিভিন্ন অর্থকরী বাণিজ্যিক পণ্য যেমন তুলা, আখ ইত্যাদি চাষের দিকেও বিজয়নগরের কৃষকেরা নজর দেয়। বড়ো বড়ো বাগিচাগুলিতে পান, সুপারি, আদা, হলুদ, ও নানারকম ফল-ফুল চাষ করা হত। পর্যটক আব্দুর রজ্জাক বিজয়নগরে গোলাপ ব্যবসায়ীদের সংখ্যাধিক্যের কারণ প্রসঙ্গে বলেছেন যে, বিজয়নগরে খাদ্যের মতোই জনজীবনে গোলাপের ব্যবহার গুরুত্ব পেত।

বিজয়নগরে জলসেচের ব্যবস্থার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হত। এজন্য নদী ও খালের ওপর বাঁধ দিয়ে কৃষিজমিতে জলের জোগান দেওয়া হত। যেসব একালায় প্রাকৃতিকভাবে জল জোগানের সুযোগ ছিল না, সেখানে জলাশয় খনন করে জমিতে জলসেচ দেওয়া হত। সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এই সকল জলাশয় রক্ষাণাবেক্ষণে বিশেষ নজর রাখতেন। অনাবাদী জমিকে কৃষিজমিতে উন্নীত করার জন্য কৃষকদের উৎসাহ দেওয়া হত। এই সকল ক্ষেত্রে উদ্যোগী কৃষকদের করভার লাঘব করে কিংবা বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে উৎসাহিত করা হত।

সাধারণভাবে কৃষকদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য নির্ভর করত অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর। তবে এজন্য কৃষকদের অধীন জমির বন্দোবস্তের শর্তাদি ও রাজস্ব আদায়কারী সংগঠনের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ধর্মপ্রতিষ্ঠান বা জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের জমিতে চাষরত কৃষকদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল। ভূস্বামী হিসেবে মঠ বা মন্দির কর্তৃপক্ষ অনেক বেশি সহনশীল ও উদার ছিলেন। উচ্চপদস্থ কর্মচারী বা অভিজাতদের মালিকানাধীন জমির কৃষকদের ওপর করের বোঝা ছিল সাধারণভাবে নিপীড়নমূলক। নায়ঙ্কর ব্যবস্থা জোরালো হলে কৃষকেরা নায়কদের নির্ধারিত মূল্যে নগদ অর্থে শস্য কিনতে বাধ্য হত। এতে কৃষকদের অবস্থার দারুণ অবনতি ঘটে।

কৃষিকাজের পাশাপাশি গোপালন ও দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপাদন ( cattle-raising and dairy farming) বিজয়নগর রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কৃষিজমির বাইরে গোচারণ ক্ষেত্র নির্দিষ্ট করা থাকত। মন্দির-কর্তৃপক্ষের অধীনে বহু গবাদিপশু থাকত। বিভিন্ন মন্দিরে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের জন্য জ্বালানি হিসেবে ঘি ব্যবহার করা হত। এ ছাড়া অভিজাত শ্রেণির খাদ্যতালিকায় গব্যঘৃত ছিল অতি-আবশ্যিক একটি পদ। স্বভাবতই, গোপালন বিজয়নগর রাজ্যে একটি প্রয়োজনীয় ও লাভজনক বৃত্তি হিসেবে গণ্য হত।

পর্যটক পায়েজ-এর বিবরণ থেকে বিজয়নগর রাজ্যের কৃষিজীবনের একটা সার্বিক চিত্র পাওয়া সম্ভব। তিনি লিখেছেন, “এদেশে প্রচুর ধান, অন্যান্য শস্য, শিম-জাতীয় ফসল আমাদের দেশে হয় না এমন সব শস্য উৎপন্ন হয় ; কার্পাসের প্রচুর চাষ হয়। এদেশে অসংখ্য গ্রাম, শহর ও বড়ো বড়ো নগর আছে। কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে রাজাদের সজাগ দৃষ্টি ছিল। বেশি সংখ্যক জমিকে সেচের আওতায় আনার জন্য এবং অনাবাদী জমিকে চাষযোগ্য করে তোলার জন্য সরকারের তরফে নানা ব্যবস্থা গৃহীত হয়।”

বিজয়নগরের করব্যবস্থা:

বিজয়নগরের করব্যবস্থার কেন্দ্রে ছিল ভূমিরাজস্ব। এ ছাড়াও প্রজাদের কাছ থেকে সম্পদ-কর, বিক্রয় কর, যুদ্ধ-কর, বিবাহ কর, বেগার-শ্রম ইত্যাদি আদায় করা হত।

ভূমিরাজস্ব নির্ধারণের জন্য সরকার একাধিক বিষয় বিবেচনা করত। উক্ত জমি দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়েছে কিনা বা ব্রাহ্মণদের জন্য উৎসর্গ হয়েছে কিনা, এ ছাড়া জমির পরিমাণ, উৎপাদিকাশক্তি, জমির চরিত্র অর্থাৎ সেচ বা অ-সেচ একালার অন্তর্ভুক্ত কিনা ইত্যাদি বিবেচনা করা হত। জমির উর্বরতার ভিত্তিতে একই অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের কর নির্ধারণ করা হত। মোটামুটিভাবে পরিষ্কার যে, মোট উৎপাদনের ওপর রাজস্ব নির্ধারণ করা হত। ইংরেজ পর্যটক হ্যামিলটনের বিবরণ (১৯ শতক) থেকে জানা যায় যে, রাজা কৃষ্ণদেব রায় জমি জরিপ করে রাজস্ব নির্ধারণের বিষয়ে যত্নবান ছিলেন। সম্ভবত, জলাজমি ও শুকনো জমি তিনি পৃথক পৃথক ভাবে জরিপের ব্যবস্থা করেন। সমকালীন শিলালেখ থেকে জমি জরিপের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন মাপ ব্যবহারের কথা জানা যায়। আবার একই এলাকায় দু-ধরনের মাপ ব্যবহার হচ্ছে এমন দৃষ্টান্তও আছে। সরকার অবশ্য একই ধরনের মাপ ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিল। বৃদ্ধচলম-এর একটি শিলালেখ থেকে জানা যায় যে, একই রকম মাপ চালু না-থাকার ফলে কৃষকেরা ঘন ঘন বাসস্থান পরিবর্তন করত। এতে কৃষি-উৎপাদন ব্যাহত হবার সম্ভাবনা ছিল। সাধারণভাবে সরকার উৎপাদনের এক-ষষ্ঠাংশ রাজস্ব হিসেবে নিত। ব্রহ্মদেয় জমিতে কুড়ি ভাগের এক ভাগ এবং মন্দিরের জমিতে তিন ভাগের এক ভাগ রাজস্ব আদায়ের রীতি ছিল। হরিহরের আমলে শস্যের পরিবর্তে নগদ টাকায় খাজনা নেবার ব্যবস্থা করা হয়। জমির উর্বরতা, বীজের ব্যবহার ও শস্যের গড় মূল্যের ভিত্তিতে শস্যকে টাকায় রূপান্তরিত করা হত। পণ্ডিত শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার সহ অনেকেই মনে করেন যে, বিজয়নগরের করের হার ছিল যথেষ্ট উঁচু। বিদেশি পর্যটকরা বিজয়নগরের শাসকদের অতুল সম্পদ ও বিলাসবৈভবের যে বিবরণ দিয়েছেন, তার ভিত্তিতে অনুমান করা যায় যে, প্রজাদের ওপর যথেচ্ছ কর আদায় করা হত।

ভূমিরাজস্ব ছাড়াও বিজয়নগর রাজ্যে বৃত্তি কর, সামাজিক কর ইত্যাদি আদায় করা হত। গ্রামের মোড়ল, মেষপালক, ছুতোর, ধোপা, নাপিত, কুমোর, স্বর্ণকার, ব্রাহ্মণ ইত্যাদি বিভিন্ন বৃত্তির জন্য কর দিতে হত। সদাশিব রাও-এর আমলে নাপিতদের কর প্রদান থেকে রেহাই দেওয়া হয়। পেশাভিত্তিক কর বছরে একবার দিতে হত। কুটিরশিল্পের কারিগরদেরও কর দিতে হত। তাঁত, ঘানি, হীরক শিল্প, রেশম-জরি, লৌহ-চুল্লি ইত্যাদি শিল্পে কর আরোপ করা হত। তবে এক্ষেত্রে করের পরিমাণ ও কর নির্ধারণের ভিত্তি কী ছিল—তা স্পষ্ট নয়। সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্যও কর আদায় করা হত; যেমন—বিবাহ কর। কন্যাপক্ষ ও বরপক্ষ উভয়কেই এই কর দিতে হত। গ্রামের মন্দিরে অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য ‘পিদারিভারী’ নামক কর সংগ্রহ করা হত। বিবাহ-কর সবথেকে অ-জনপ্রিয় ছিল। তাই পরবর্তীকালে কৃষ্ণদেব রায় এই কর বাতিল করে দেন। রাজার জন্মদিনে, রাজার পুত্রসন্তানের জন্ম উপলক্ষ্যে সামন্ত ও স্থানীয় নেতারা রাজাকে বিশেষ কর দিতেন। বিচারকার্য সম্পাদনের জন্য প্রাদেশিক কর্তা বা গ্রাম-প্রধান একধরনের কর আদায় করতেন। এই করের একাংশ রাজার প্রাপ্য ছিল। নিচুজাতের লোকদের ধর্মীয় কাজকর্ম করার জন্য গ্রাম-প্রধানরা অধস্তন কর্মী নিয়োগ করতেন। এদের বলা হত ‘দাসারী’। অনুষ্ঠান শুরুর আগে নিচুজাতের লোকেরা ‘দাসারীদের একটা প্রাপ্য দিতে বাধ্য থাকত। এই অর্থের একটা অংশ রাজাকে দেওয়া হত। এই প্রথাকে বলা হত ‘সমাচার’। সরকারি উচ্চ আমলা গ্রাম পরিদর্শনে এলে তাদের কিছু উপঢৌকন দিয়ে বরণ করা বাধ্যতামূলক ছিল।

মধ্যযুগের ভারতে বেগার-শ্রম একটি বহুল প্রচলিত প্রথা। বিজয়নগরেও এই প্রথার প্রচলন ছিল। এই বিনা পারিশ্রমিকের বাধ্যতামূলক শ্রমকে বলা হত উলিয়াম। রাস্তা নির্মাণ, সংস্কার ও সম্প্রসারণ, জলসেচের খাল খনন, মন্দিরের পাঁচিল নির্মাণ ইত্যাদি কাজ বেগার-শ্রম হিসেবেই গণ্য হত। দুর্গ নির্মাণ বা সংস্কারের জন্যও স্থানীয় মানুষ বিনা মজুরিতে শ্রম দিতে বাধ্য হত। তবে এক্ষেত্রে বেগার শ্রম দিতে অপারগ হলে পরিবর্তে ‘কোট্টাজ’ নামক কর দিয়ে রেহাই পাওয়া যেত।

বিজয়নগরের রাজস্ব দপ্তরের নাম ছিল ‘অথবান’। রাজস্ব-বিষয়ক কেন্দ্রীয় কর্মী এটির তত্ত্বাবধান করতেন। রাজস্ব-প্রধানকে সহযোগিতা করতেন প্রদেশ ও জেলা স্তরের আমলাবৃন্দ। কেন্দ্রীয় রাজস্ব দপ্তরকে ছোটো ছোটো ভাগে বিভক্ত করে প্রতিটি বিভাগকে একজন করে দায়িত্বশীল আমলার তত্ত্বাবধানে রাখা হত। কর সংগ্রহের জন্য বিজয়নগরে চারটি প্রথার প্রচলন ছিল। একটি প্রথানুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার নিযুক্ত কর্মচারী সরাসরি উৎপাদকের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করতেন। দ্বিতীয় প্রথায় সরকার কর আদায়ের দায়িত্ব ইজারা হিসেবে কোনো ব্যক্তিকে অর্পণ করত। তৃতীয় প্রথা অনুযায়ী সরকার গ্রামের কিছু মানুষ বা গোষ্ঠীর সাথে ওই এলাকার কর আদায়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হত। চুতর্থ এবং শেষ প্রথাটি হল ‘নায়ক’ নামক এক বিশেষ ধরনের ভূস্বামীর হাতে সরকার সাম্রাজ্যের কিছু অংশ ইজারা দিয়ে নির্দিষ্ট সামরিক সাহায্য ও নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা কর হিসেবে গ্রহণ করত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন অনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টির সময় বিজয়নগর রাজ্যে কৃষকদের কর ছাড় দেওয়া হত। এই কর ছাড়ের ক্ষমতা ছিল একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থাৎ রাজার। ‘ভালুডুর লেখ’ (১৪০২-১৪০৩ খ্রিঃ) এবং ‘আদুতুরাই লেখ’ (১৪৫০ খ্রিঃ) থেকে কর ছাড় দেবার উল্লেখ পাওয়া যায়।