আলাউদ্দিন হুসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি:)

আলাউদ্দিন হুসেন শাহ ও তাঁর বংশধরদের শাসনকাল ইতিহাসে হুসেন শাহি বংশের আমল হিসেবে পরিচিত। হুসেন শাহি সুলতানের আমলেও বাংলাদেশ তাঁর রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও আর্থসামাজিক প্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম ছিল। হুসেন শাহি বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন হুসেন-এর প্রকৃত পরিচয় ও পূর্ব-ইতিহাস অনেকটাই অনুমাননির্ভর। মুদ্রা ও শিলালিপির সাক্ষ্য থেকে মনে হয় যে, তিনি আরব বা তুর্কিস্থানের সৈয়দ বংশের সন্তান। ‘রিয়াজ-উস্-সালাতিন’ গ্রন্থের বিবরণ মতে, হুসেন পিতার সাথে বাংলায় আসেন এবং মুর্শিদাবাদের চাঁদপাড়া গ্রামে বসবাস করতে থাকেন। এই অঞ্চলে সুলতান হুসেন শাহ-র বহু লিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। অন্য মতে, হুসেন বহিরাগত নন, বাংলারই সন্তান। বুকানন-এর মতে, হুসেন রংপুর জেলার অন্তর্গত দেবনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। হুসেন শাহের মাতা যে হিন্দু ছিলেন এমন কিংবদন্তীও প্রচলিত আছে। বাবরের আত্মজীবনীতে হুসেনের পুত্র নসরৎ শাহকে ‘বাঙালি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো কোনো চৈতন্য-জীবনী গ্রন্থে হুসেনের দেহ ‘কৃষ্ণবর্ণ” ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই সকল মতামতের ভিত্তিতে ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন যে, হুসেন শাহ বিদেশি নয়, বাঙালি ছিলেন। বহু পূর্বে বাংলাদেশে আগত কোনো এক সৈয়দবংশে সম্ভবত তাঁর জন্ম হয়েছিল।

‘তরকৎ-ই-আকবরী’, ‘রিয়াজ-উস্-সালাতিন’, ‘বাবরনামা’ প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে প্রমাণিত হয় যে, সিংহাসনলাভের পূর্বে সৈয়দ হুসেন বাংলার হাবশি সুলতান মুজফ্ফর শাহের উজির ছিলেন। শাসক হিসেবে মুজফ্ফর ছিলেন ভীষণ অত্যাচারী। উজির হিসেবে হুসেন শাহ দ্বৈত ভূমিকা পালন করেন। একদিকে তিনি সুলতানের শোষণমূলক কাজকর্মে মদত দেন, অন্যদিকে বিক্ষুব্ধ অভিজাতদের কাছে সুলতানের আচরণের বিরূপ সমালোচনা করেন। নিন্দনীয় হলেও এরূপ আচরণ দ্বারা তিনি মুজফফ্ফ শাহের বিরোধীদের আস্থা অর্জন করেন এবং বিদ্রোহী পাইকদের (পদাতিক) সহায়তায় সুলতানকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন। ফেরিস্তার মতে, হুসেন শাহ প্রভুহস্তা ছিলেন না। মুজফ্ফরের মৃত্যুর পর রাজ্যে যে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছিল, তার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য হিন্দু মুসলমান সন্তরা তাঁকে সিংহাসনে বসার অনুরোধ করেছিলেন। অতঃপর তিনি সিংহাসনে বসে আলাউদ্দিন হুসেন শাহ নাম নিয়ে শাসন শুরু করেন।

প্রশাসক হিসেবে হুসেন শাহ বিচক্ষণতা ও দৃঢ়তার পরিচয় দেন। ‘রিয়াজ’ গ্রন্থ ও ফেরিস্তার বিবরণ থেকে জানা যায় যে, হুসেন শাহ রাজ্যের প্রভাবশালী অমাত্যদের সমর্থন না পাওয়ার জন্য এক চুক্তি দ্বারা মাটির ওপরের সমস্ত ধনসম্পত্তির ওপর অমাত্যদের এবং মাটির নীচে সঞ্চিত সম্পদের ওপর সুলতানের অধিকার স্বীকার করে নিয়েছিলেন। সন্ধি অনুযায়ী অমাত্য ও তাদের সহযোগী পাইকরা গৌড়ের ধনসম্পত্তি লুণ্ঠন করতে থাকেন। কিছুদিনের মধ্যেই তাদের আচার-আচরণ সুলতানের মর্যাদা ও দায়িত্ববোধকে আহত করে। ফলে হুসেন শাহ প্রথমে এই লুঠতরাজ বন্ধ করার অনুরোধ জানান। কিন্তু সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হলে তিনি কঠোর হাতে লুণ্ঠনকারীদের দমন করেন। প্রায় বারো হাজার লুঠেরাকে তিনি হত্যা করেন। লুণ্ঠিত দ্রব্যাদি তিনি পুনরুদ্ধার করেন। এই সময় তিনি প্রায় ১৩ শত সোনার থালা ও বহু ধনসম্পদ লাভ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তখন উচ্চবিত্ত লোকেরা সোনার থালাতেই খাওয়াদাওয়া করতে অভ্যস্ত ছিলেন। যাই হোক্, ক্রুর কূটনীতি ও হীন চাতুরি দ্বারা ক্ষমতা দখল করলেও হুসেন শাহ সত্বর রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপন করে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। বিচক্ষণ হুসেন শাহ দ্রুততা ও কঠোরতার সাথে পাইকদের দলকে ভেঙে দেন এবং প্রাসাদরক্ষার কাজে নতুন রক্ষীদল নিযুক্ত করেন। বিশৃঙ্খলার ওপর উৎস হাবশিদের তিনি বাংলা থেকে বিতাড়িত করেন। এরা গুজরাট ও দাক্ষিণাত্যে গিয়ে আশ্রয় নেন। বিভিন্ন সরকারি পদে ক্ষমতাসম্পন্ন সৈয়দ, মুঘল ও আফগানদের নিযুক্ত করে তিনি প্রশাসন যন্ত্রকে গতিশীল করে তোলেন।

হুসেন শাহকে রাজত্বকালের অধিকাংশ সময় যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকতে হয়েছিল। রাজত্বের প্রথম থেকেই তিনি মুদ্রায় নিজেকে ‘কামরূপ-কামতা-জাজনগর-উড়িষ্যা-বিজয়ী’ বলে অভিহিত করে এই সকল রাজ্যজয়ে উদ্যোগী হন। রিয়াজ, বুকাননের বিবরণ, ‘অসম বুরঞ্জী’ অনুসারে অনুমিত হয় যে, হুসেন শাহ কামতাপুর ও কামরূপ রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে প্রাথমিক সাফল্য পেয়েছিলেন। কয়েক বছরের চেষ্টায় কামতাপুর (কোচরাজ্য) ও কামরূপ (পশ্চিম আসাম) তিনি সম্পূর্ণ দখল করেন। তবে এই সকল স্থায়ীভাবে বাংলার শাসনাধীনে এসেছিল কিনা, তা সঠিকভাবে বলা যায় না। শিহাবউদ্দিন তালিশ রচিত ‘তারিখ-ফতে-ই-আসাম’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, হুসেন শাস আসাম রাজ্য দখল করে নিজ পুত্রকে সেখানকার শাসক নিযুক্ত করেছিলেন। গোলাম হোসেন (রিয়াজ-উস্ সালাতিন) এই বক্তব্য সমর্থন করেছেন। এই বিজয়ের শেষ পরিণতি হুসেন শাহের পক্ষে শুভ হয়নি। শেষ পর্যন্ত অসম-যুদ্ধে বাংলার সুলতান শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিলেন। হুসেন শাহ উড়িষ্যা রাজ্যের সাথেও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। তবে এই যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী মত পাওয়া যায়। ‘রিয়াজ’ ও ত্রিপুরার ‘রাজামালা’র সাক্ষ্য অনুযায়ী উড়িষ্যার বিরুদ্ধে হুসেন শাহ বিজয়ী হয়েছিলেন। অন্যদিকে বৈষ্ণবগ্রন্থ ‘ভক্তিভাগবত, উড়িষ্যারাজ প্রতাপরুদ্রের ‘সরস্বতী বিলাসম’ ও পুরীর জগন্নাথ-মন্দিরের ‘মাদলাপঞ্জী’র মতে, উড়িষ্যার প্রতাপরুদ্রই বাংলার সুলতান হুসেন শাহকে পরাজিত করেছিলেন। যাই হোক্, একথা ঠিক যে, (১) হুসেন শাহের সাথে উড়িষ্যা রাজ্যের যুদ্ধ হয়েছিল এবং (২) এই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে কোনো পক্ষই স্থায়ী ফল লাভ করতে পারেনি। তবে এই আক্রমণকালে হুসেন শাহ যে পুরীর জগন্নাথ-মন্দিরসহ উড়িষ্যার বহু মন্দির ও দেবমূর্তি (জগন্নাথদেবের মূর্তি ছাড়া) ধ্বংস করেছিলেন, তা একাধিক ‘চৈতন্যচরিত’ গ্রন্থে ও ‘মাদলাপঞ্জী ‘তে উল্লেখ করা হয়েছে। ত্রিপুরা রাজ্যের সাথেও হুসেন শাহ সংঘর্ষে লিপ্ত হন। সম্ভবত, ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই হুসেন শাহ ত্রিপুরার অংশবিশেষ জয় করতে পেরেছিলেন। ত্রিপুরার রাজবংশের ইতিবৃত্ত ‘রাজমালা’র সাক্ষ্য অনুসারে হুসেন শাহ ত্রিপুরার বিরুদ্ধে প্রাথমিক সাফল্য পেলেও শেষ পর্যন্ত ত্রিপুরা বাহিনীর হাতে সুলতানি বাহিনীর প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। অন্যদিকে হুসেন শাহের লিপি, কবীন্দ্র পরমেশ্বরের মহাভারত প্রভৃতি থেকে হুসেন শাহের সাফল্যের বিবরণ পাওয়া যায়।

ছোটোখাটো আরো বহু সংঘর্ষে হুসেন শাহ লিপ্ত হয়েছিলেন। আরাকানীদের বিতাড়িত করে তিনি চট্টগ্রাম পুনর্দখল করেন। ত্রিহুতের একাংশ সমেত বর্তমান বিহারের কতকাংশ তিনি বাংলার শাসনাধীনে আনতে সক্ষম হন। পাটনা ও মুঙ্গেরে তাঁর শিলালিপি পাওয়া গেছে। পোর্তুগীজ বণিকদের বিরুদ্ধেও হুসেন শাহ সফল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাঁর শাসনকালেই বাংলাদেশে পোর্তুগীজ বণিকরা প্রথম প্রবেশ করে। এদের উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রামে কুঠি নির্মাণ করে বাণিজ্য চালানো। কিন্তু পোর্তুগীজদের উচ্চাশা এবং অন্যায়ভাবে ক্ষমতাবিস্তারের প্রবণতা সম্পর্কে সুলতান অবহিত ছিলেন। তাই তিনি প্রথম থেকেই পোর্তুগীজদের সাথে কঠোর ব্যবহার করেন এবং বাংলার মাটি থেকে তাদের বিতাড়িত করেন। হুসেন শাহ একবার দিল্লির সুলতানের মুখোমুখি হয়েছিলেন। জৌনপুরের বিতাড়িত শাসক হুসেন শার্কির সাথে দিল্লির সুলতান সিকন্দর লোদীর বিরোধের সুত্রে হুসেন শার্কি বাংলার সুলতানের সাহায্যপ্রার্থী হলে দিল্লির সাথে বাংলার সংঘর্ষ-সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। বিহারের ‘বাঢ়’ নামক স্থানে উভয়পক্ষের বাহিনী পরস্পরের মুখোমুখি হয়। অবশ্য শেষ পর্যন্ত উভয়ের মধ্যে এক সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। দিল্লির সুলতান হুসেন শাহের সাথে সমতার ভিত্তিতে চুক্তি স্বাক্ষর করলে হুসেন শাহের মর্যাদা নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি পায়।

হুসেন শাহ বাংলার রাজধানী গৌড় থেকে নিকটবর্তী একডালায় স্থানান্তরিত করেন। সম্ভবত, একডালার অধিক নিরাপত্তা এবং ক্রমাগত লুণ্ঠনের ফলে গৌড় নগরীর শ্রীহীন হয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে হুসেন শাহ রাজধানী স্থানান্তরের কথা চিন্তা করেন। ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে হুসেন শাহ মারা যান।

মধ্যযুগের বাংলায় হুসেন শাহ মর্যাদাপূর্ণ ও বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর শাসনকালকে বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবদীপ্ত অধ্যায়’ বলে অনেকেই মনে করেন। যোদ্ধা, শাসক এবং শিক্ষা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তিনি যথেষ্ট দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন। এক অনিশ্চিত ও অস্থির পরিস্থিতিতে তিনি বাংলার সিংহাসনে বসেন। তাঁর পূর্ববর্তী কয়েকজন শাসক পরপর আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিল। ফলে রাজ্যজুড়ে দেখা দিয়েছিল অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা। উচ্চাকাঙ্ক্ষী হাবশি কর্মচারী, ক্ষমতালোভী পাইকদল এবং সুযোগসন্ধানী অভিজাত ও সামন্তবর্গের গোষ্ঠী-স্বার্থপূরণের অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাঝে হুসেন শাহ সিংহাসনে বসেছিলেন। অদম্য মনোবল, একান্ত ইচ্ছা এবং দূরদর্শিতার সফল প্রয়োগের দ্বারা তিনি এই জটিল পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেন। দেশে কঠোর হাতে আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যসীমা বৃদ্ধি করে তিনি অনন্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। বাংলাদেশের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ এবং বিহারের একাংশ তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল। কামরূপ, কামতারাজ্য, উড়িষ্যা এবং ত্রিপুরার কোনো কোনো অংশের ওপরেও তিনি সাময়িকভাবে বাংলার কর্তৃত্ব জারি করেন। চট্টগ্রাম থেকে আরাকানীদের বিতাড়িত করে এবং পোর্তুগীজ বণিকদের ঘাঁটি গড়ার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়ে সুলতান হুসেন শাহ রাজ্যের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করেন। বিশাল আয়তনবিশিষ্ট এই রাজ্যে দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর অপ্রতিহতভাবে রাজত্ব করে তিনি প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

হুসেন শাহ দীর্ঘকাল যুদ্ধে লিপ্ত থাকলেও দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ব্যাহত হয়নি। কারণ সব যুদ্ধই সংঘটিত হয়েছিল দেশের বাইরে। তাঁর প্রতি যে জনসাধারণের গভীর আস্থা ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া অসম্ভব নয়। সেনাবাহিনী-সহ তিনি দীর্ঘ সময় রাজ্যের বাইরে কাটালেও কদাপি তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র হয়নি। মধ্যযুগীয় রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতাদখলের রাজনীতির যুগে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী থেকে শুরু করে প্রজাসাধারণ যে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা বজায় রেখেছিলেন, এটা অবশ্যই তাঁর ব্যক্তিগত কৃতিত্বের ফল।

প্রশাসক হিসেবে হুসেন শাহর নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি বহু ঐতিহাসিকের প্রশংসা অর্জন করেছে। সমকালীন মুসলমান ঐতিহাসিক ও কাহিনিকার ছাড়াও কোনো কোনো হিন্দু-কবির রচনাতেও তাঁর নিরপেক্ষ রাজচরিত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। সমসাময়িক কালে বাংলায় আগত পর্যটক ভার্থেমা এবং বারবোসা-র বিবরণীতেও হুসেন শাহের প্রশংসা করা হয়েছে। উচ্চ রাজপদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সুলতান ধর্ম বা গোষ্ঠীস্বার্থের পরিবর্তে প্রশাসনের দাবিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। তাই সরকারি পদে নিয়োগের মাপকাঠি ছিল পদপ্রার্থীর যোগ্যতা ও দক্ষতা। মুসলমানদের পাশাপাশি বহু হিন্দুকেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করতেন। হুসেন শাহের উচ্চপদস্থ হিন্দু-কর্মচারীদের মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য দুটি নাম হল সনাতন গোস্বামী ও রূপ গোস্বামী। এঁরা ছিলেন সহোদর ভাই। সনাতনের উপাধি ছিল ‘সাকর মল্লিক’ বা ছোটো রাজা। তিনি হুসেন শাহের মন্ত্রী, সভাসদ হিসেবে প্রভুত ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। ছোটো ভাই রূপ ছিলেন হুসেন শাহের মন্ত্রী এবং ব্যক্তিগত সচিব (দবির খাস)। এ ছাড়া বল্লভ, শ্রীকান্ত, চিরঞ্জীব সেন, মুকুন্দ, দামোদর, কেশব প্রমুখ বহু বিশিষ্ট হিন্দু হুসেন শাহের সচিব, কর্মী, চিকিৎসক হিসেবে সম্মানিত ছিলেন। প্রশাসনিক বিভাগ ও রাজকর্মচারীদের বেতনের জন্য নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের রাজস্ব বরাদ্দ ছিল।

শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক রূপেও হুসেন শাহ সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের প্রশংসা অর্জন করেছেন। শিক্ষা ও শিক্ষিত ব্যক্তির প্রতি সুলতানের গভীর শ্রদ্ধাবোধ ছিল। জ্ঞানীগুণী ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতার কাজে হুসেন শাহ ছিলেন আন্তরিক। রূপ, সনাতন, কেশব, যশোরাজ খাঁ, দামোদর প্রমুখ কবি হুসেন শাহের অমাত্য বা কর্মচারী ছিলেন। রূপ গোস্বামী সংস্কৃতে ‘বিদগ্ধমাধব’ ও ‘ললিতামাধধ্ব’ নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। হুসেন শাহের প্রচেষ্টায় তখন বাংলা সাহিত্যের চর্চাতেও নতুন জোয়ার আসে। তাঁর সেনাপতি পরাগল খাঁ’র আগ্রহে পরমেশ্বর কবীন্দ্র নামক জনৈক কবি সমগ্র মহাভারত বাংলায় অনুবাদ করেন। বিপ্রদাস পিপিলাই, শ্রীকর নন্দী প্রমুখ সমসাময়িক কবিদের কাব্যেও হুসেন শাহের নামোল্লেখ পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার-সহ কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন যে, হুসেন শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় মালাধর বসু শ্রীমদ্ভাগবতগীতা’ বাংলায় অনুবাদ করে ‘গুণরাজ খাঁ’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণের পথিকৃৎ এবং ধর্মসহিষ্ণুতার প্রচারক শ্রীচৈতন্য হুসেন শাহের রাজত্বকালেই তাঁর মত ও দর্শন প্রচার করে জনজীবনে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। সুলতানের উদ্যোগে জনৈক মুসলমান পণ্ডিত ‘ধনুর্বিদা’ নামে একটি পুস্তক রচনা করে তা হুসেন শাহকে উৎসর্গ করেন।

নির্মাতা হিসেবেও হুসেন শাহ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর উদ্যোগে বহু সুদৃশ্য, প্রাসাদ, মসজিদ ও ফটক নির্মিত হয়েছিল। এদের মধ্যে গৌড়ের ‘গুমতি ফটক’ এবং গৌড়ের অনতিদূরে ফিরোজপুরে নির্মিত ‘ছোটো সোনা মসজিদ’ উল্লেখযোগ্য। এদের শিল্পসৌন্দর্য এখনো শিল্পরসিকদের বিস্মিত করে। বীরভূমের ‘বাদশাহি সড়ক’ এবং ‘গণ্ডক নদীর বাঁধ’ তাঁর আরও দুটি অনবদ্য সৃষ্টি। এ ছাড়া রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে তিনি বহু সরাইখানা ও মাদ্রাসা নির্মাণ করে পথচারী ও শিক্ষানুরাগীদের শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হুসেন শাহের সার্বিক সাফল্যের নিরিখে কোনো কোনো ঐতিহাসিক তাঁকে “বাংলার শ্রেষ্ঠ সুলতান” বলে উল্লেখ করেছেন। ব্লখম্যান্ (Blochman) লিখেছেন : “The name of Hussain Shah, the good, is still remembered from the frontiers of Orissa to the Brahamaputra.” এঁদের মতে, হুসেন শাহের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ও বাঙালিজাতি চরম সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। অধ্যাপক বি. এন. রায় লিখেছেন : “Viewed as a whole, it may be said, without much exaggeration that under Sultan Hussain Shah Bengal enjoyed such a spell of peace, prosperity and all round progress as she had not done before under any other Sultan.”

ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ আধুনিক ঐতিহাসিকেরা সুলতান হুসেন শাহের কৃতিত্বের উপরিলিখিত মূল্যায়ন সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্ন হল : তাঁর সামরিক অভিযানগুলি কতটা সুফলপ্রসূ ছিল ; সমকালীন সাহিত্যের উন্নতির সাথে তিনি সরাসরি কতটা জড়িত ছিলেন; তিনি প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ ও সমদর্শী ছিলেন কিনা ইত্যাদি। এঁদের মতে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই হুসেন শাহের দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতা খুঁজে পাওয়া কষ্টকর নয়। প্রথমত, হুসেন শাহ বহু যুদ্ধ করেছেন, বহু অর্থব্যয় করেছেন অভিযান পরিচালনার জন্য। কিন্তু লক্ষণীয় যে, তিনি খুব কম যুদ্ধেই পূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চুক্তি করে তিনি সরে এসেছেন অথবা সামান্য ভূখণ্ড সাময়িকভাবে দখল করতে পেরেছেন। বস্তুত, যুদ্ধে তিনি যে পরিমাণ সময়, শক্তি ও অর্থব্যয় করেছেন—লাভ করেছেন তার তুলনায় খুবই কম। দ্বিতীয়ত, তাঁর আমলে বাংলা সাহিত্যের চর্চা বাড়লেও সেই কাজের সাথে সুলতানের প্রত্যক্ষ যোগ ছিল খুবই কম। সমকালীন কবি-সাহিত্যিকদের কাব্যসৃষ্টির মূলে হুসেন শাহের অনুপ্রেরণা ছিল সামান্যই। এঁদের অনেকের সাথে সুলতানের সাক্ষাৎ-পরিচয়ও ছিল না। হুসেন শাহ কোনো কবি বা পণ্ডিতকে কোনো উপাধি দেননি। মালাধর বসুর সাথে তাঁর নামটি ভ্রমবশত যোগ করা হয়েছে। বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্যভাগবত’-এ বলা হয়েছে, ‘না করে পাণ্ডিত্যচর্চা রাজা সে যবন।’ হুসেন শাহ শিক্ষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষণ করলে সম্ভবত এ ধরনের কথা লেখা হত না। ড. মজুমদারের মতে, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের কোনো পর্বকে ‘হোসেন শাহি আমল’ বলার সার্থকতা নেই। কারণ তাঁর আমলে মাত্র কয়েকটি বাংলা সাহিত্য রচিত হয়েছে এবং সেগুলি বাংলা ভাষা বা সাহিত্যে বিশাল কোনো পরিবর্তনের সূচনা করেনি। এমনকি পদাবলী সাহিত্যের স্বর্ণযুগ এসেছিল হুসেন শাহের অনেক পরে। কবি জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস প্রমুখের আবির্ভাবের পরে বাংলার পদাবলী সাহিত্যের চরম উন্নতি ঘটেছিল ; এবং এঁরা কাব্যচর্চা করেছিলেন হুসেন শাহের মৃত্যুর কয়েক দশক পরে।

ঐতিহাসিকদের অনেকেই হুসেন শাহের ধর্মীয় উদারতার প্রশংসা করেছেন। এঁদের বিশ্বাস সুলতান হুসেন শাহ হিন্দু-মুসলমানের প্রতি সমদর্শী নীতি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সমকালীন বিভিন্ন গ্রন্থের বক্তব্য এবং পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে তাঁর মধ্যে উদারতার স্পষ্ট অভাব লক্ষ্য করা যায়। “চৈতন্যভাগবত’ গ্রন্থে হুসেন শাহকে ‘পরম দুর্বার’ ও ‘যবন রাজা’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। “চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে লেখা হয়েছে যে, সুলতানের কর্মচারীরা বৈষ্ণব কীর্তনীয়াদের নানাভাবে অপদস্থ করত। এমনকি কীর্তন করার অপরাধে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে জাতি নষ্ট করার হুমকিও প্রায়শই দেওয়া হত। সুলতান উদারমনা ও ধর্মসহিষ্ণু হলে তাঁর কর্মচারীরা নিশ্চয়ই এ কাজ করতে সাহস পেত না। বৈষ্ণব গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, হুসেন শাহ উড়িষ্যা অভিযানে গিয়ে বহু মন্দির ও দেবমূর্তি ধ্বংস করেছিলেন। সমসাময়িক পোর্তুগীজ পর্যটক বারবোসা লিখেছেন যে, সুলতানকে সন্তুষ্ট করার জন্য তাঁর অধীনস্থ কর্মচারীরা প্রতিদিন বাংলাদেশে বহু হিন্দুকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করত। বিপদ্রাস পিপিলাই-এর মনসামঙ্গল কাব্যে লেখা হয়েছে যে, মুসলমানরা ‘জুলুম’ করত এবং ছৈয়দ (সৈয়দ) মোল্লারা হিন্দুদের কলমা পড়িয়ে মুসলমান করত।

শ্রীচৈতন্যদেবকে হুসেন শাহের রাজত্বকালের সাথে জড়িয়ে সুলতানের ধর্মসহিষ্ণুতার কল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু চৈতন্যদেবের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও খুব ভালো ছিল না। বহুবার সংকীর্তন করতে গিয়ে তিনি কাজি ও তার সাগরেদদের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছেন। প্রসঙ্গত লক্ষণীয় যে, সন্ন্যাসগ্রহণের পর চৈতন্যদেব বাংলা ছেড়ে হিন্দুরাজ্য-শাসিত উড়িষ্যা রাজ্যে চলে গিয়েছিলেন। এমনও অসম্ভব নয় যে, বাংলার সুলতানি শাসনে তিনি স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা করতে না-পেরেই দেশান্তরী হয়েছিলেন। এরূপ ধারণাকে দৃঢ় করে সনাতন গোস্বামীর প্রতি হুসেন শাহের কিছু আচরণ। সনাতন চৈতন্যদেবের সংস্পর্শে এসে ঐহিক জগৎ সম্পর্কে নিস্পৃহ হয়ে পড়েন এবং সুলতানের সাথে উড়িষ্যা অভিযানে যেতে অস্বীকার করেন। এই অপরাধে হুসেন শাহ তাঁর অনুগত ও বিশ্বস্ত মন্ত্রীকে কারারুদ্ধ করে উড়িষ্যা অভিযানে বের হন। সনাতন কোনোক্রমে কারাগার থেকে পালিয়ে নিজের জীবন রক্ষা করেন। অতি বিশ্বস্ত অনুগামীর প্রতি সুলতানের এই ‘লঘু পাপে গুরু দণ্ড’ নীতি নিশ্চয়ই কোনো গভীর ক্ষোভ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। লক্ষণীয় যে, কারাগার থেকে পালিয়ে সনাতন শ্রীচৈতন্যের শরণাপন্ন হয়েছিলেন।

কিছু কিছু উচ্চ রাজপদে হুসেন শাহ হিন্দুদের নিয়োগ করেছিলেন। তাঁর গুণগ্রাহী লেখকরা এই কাজকে হুসেন শাহের উদার মানসিকতার অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থিত করেছেন। কিন্তু একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে হুসেন শাহের এই কাজের মধ্যে নৈতিক উদারতার পরিবর্তে বাস্তব প্রয়োজনবোধের ছবিটাই বেশি প্রকট মনে হবে। বিচক্ষণ সুলতান জানতেন যে, নিছক ধর্মীয় কারণে অযোগ্য মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করলে প্রশাসন ভেঙে পড়বে। ইতিপূর্বে ইলিয়াস শাহের আমলেও হিন্দুরা কোনো কোনো দপ্তরে নিযুক্ত হয়ে তাদের দক্ষতা ও বিশ্বস্ততা প্রমাণ করেছে। তাই হুসেন শাহও প্রশাসনের প্রয়োজনে যোগ্য হিন্দুদের বিভিন্ন পদে নিয়োগ করেছিলেন। বহু পরে মুর্শিদকুলী খাঁ’র আমলেও ঠিক এই কারণে হিন্দুরা রাজপদে নিযুক্তি হতেন।

উপরিলিখিত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একথা স্বীকার্য যে, হুসেন শাহ মধ্যযুগীয় সংকীর্ণতা দ্বারা আচ্ছন্ন ছিলেন না। শাসক এবং মানুষ হিসেবে তিনি মধ্যযুগীয় শাসক থেকে অনেক উন্নতমনা ছিলেন। তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান মুসলমান। কিন্তু উৎকট হিন্দু-বিদ্বেষী বা ধর্মোন্মাদ তিনি ছিলেন না। তাই তাঁর আচরণ কখনোই অ-মুসলমানদের ক্ষেত্রে অসহনীয় হয়ে ওঠেনি। একথা ঠিক যে, সুলতানের মধ্যে কিছুটা সহনশীলতা না-থাকলে শ্রীচৈতন্য বাংলাদেশে তাঁর ধর্মাদর্শ প্রচার করতে পারতেন না। এমন প্রমাণও আছে যে, ত্রিপুরা অভিযানের সময় তাঁর হিন্দু সেনারা গোমতী নদীর তীরে পাথরের প্রতিমা পূজা করেছিল। সুলতান তাদের কাজের বিরোধিতা করেননি। রাজধানীর খুব কাছেই বহু নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণব বসবাস করতেন। আসলে হুসেন শাহ ছিলেন একজন সম্পূর্ণ মুসলিম নরপতি। মুসলমান হিসেবে তিনি নিজ ধর্মের মহিমা প্রচারে পরোক্ষ মদত দিয়েছেন; আবার শাসক হিসেবে অ মুসলমানদের প্রতি অসহনীয় নয় এমন নীতি অনুসরণেরও চেষ্টা করতেন। তাই বলা চলে, হিন্দু বিদ্বেষের বিষময় প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন থেকে হুসেন শাহ মুসলমান-তোষণ নীতি অনুসরণ করেছেন। সুলতানের ওপর আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ থেকেই জনগণ তাঁকে ‘নৃপতিতিলক’, ‘জগভূষণ’ প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করেছিল। অধ্যাপক যদুনাথ সরকার তাঁকে মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন যে, “হুসেন শাহের কাছে আবুল ফজলের মতো কোনো সুহৃদ ও ঐতিহাসিক ছিলেন না; তাই তাঁর মহত্ত্বের বহু তথ্য অজ্ঞাত থেকে গেছে।” অধ্যাপক সরকারের ভাষায় : “Alauddin Hussain Shah was unquestionable the best, if not the greatest, of the medieval rulers of Bengal.”

নসরৎ শাহ (১৫১৯-৩২ খ্রিঃ) :

হুসেন শাহের মৃত্যুর পর বাংলার সিংহাসনে বসেছিলেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র নাসিরউদ্দিন আবুল মুজফ্ফর নসরৎ শাহ। সাধারণভাবে তিনি নসরৎ শাহ নামেই খ্যাত ছিলেন। মুদ্রার সাক্ষ্য থেকে দেখা যায় যে, তিনি পিতার মৃত্যুর অন্তত তিন বছর পূর্বে যুবরাজ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে মুদ্রাপ্রকাশের সুযোগ পান। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, হুসেন শাহের জ্যেষ্ঠপুত্র নসরৎ শাহ নির্বিবাদে সিংহাসনে বসেন। ক্ষমতালাভ করেই তিনি কনিষ্ঠ সতেরো জন ভাইয়ের বরাদ্দ ভাতা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে দেন। এই ঘটনা সত্যি হলে স্বীকার করতে হয় যে, নসরৎ মধ্যযুগীয় সংকীর্ণতা দ্বারা আচ্ছন্ন ছিলেন না। নসরৎ শাহের মোট চৌদ্দ বছরের শাসনকালকে দুটি পর্বে ভাগ করা যায়। তাঁর রাজত্বের প্রথম সাত বছর মোটামুটি শান্তিতে অতিবাহিত হয়েছিল। ফলে এই সময় তিনি শিল্পসাহিত্যের উন্নতির প্রতি মন দিতে পারেন। শেষ সাত বছর ভারতের রাজনীতির পরিবর্তনের ফলে তাঁকে নানাভাবে ব্যস্ত থাকতে হয়।

দিল্লির লোদী সুলতানদের দুর্বলতা এবং মুঘলবীর বাবরের ভারত আক্রমণের ফলে এদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায়। লোদী শাসকদের দুর্বলতার ফলে পাটনা থেকে জৌনপুর পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চল তাঁদের হাতছাড়া হয়ে যায় এবং লোহানী ও ফর্মুলি বংশীয় আফগানদের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। এদের সাথে নসরৎ শাহের মৈত্রী গড়ে ওঠে। এদিকে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে লোদীবংশের পতন ঘটিয়ে মুঘলবীর বাবর দিল্লির শাসন-কর্তৃত্ব দখল করে দ্রুত রাজ্যবিস্তার শুরু করলে আফগান নায়কেরা বিতাড়িত হয়ে নসরৎ শাহের কাছে আশ্রয় নেন। ফলে বাবরের সাথে নসরৎ শাহের সংঘাত-সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। বিচক্ষণ নসরৎ শাহ পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পেরে শেষ পর্যন্ত বাবরকে সন্তুষ্ট করার জন্য তাঁর কাছে নানা উপহার প্রেরণ করেন। পরবর্তীকালে (১৫২৯ খ্রিঃ) মুঘল আফগান দ্বন্দ্বে নসরৎ জড়িয়ে পড়লে বাবরের সাথে তাঁর সংঘর্ষ বাঁধে। এই যুদ্ধে নসরৎ শাহ পরাজিত হন এবং বাবরের হাতে কিছু অঞ্চল ছেড়ে দিয়ে শান্তি স্থাপন করেন। পরবর্তী মুঘল সম্রাট হুমায়ুন বাংলাদেশ আক্রমণের উদ্যোগ নিলে নসরৎ শাহ মুঘলের শত্রু গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে শক্তিসাম্য রক্ষা করেন। এটি তাঁর কূটনৈতিক জ্ঞানের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ‘রিয়াজ’ গ্রন্থের ভিত্তিতে জানা যায় যে, নসরৎ শাহ ত্রিহৄতের রাজাকে পরাজিত করে ওই রাজ্য সম্পূর্ণভাবে দখল করার উদ্যোগ নেন। অহোমদের আক্রমণ থেকে বাংলাকে তিনি রক্ষা করেন। এইভাবে প্রায় সমগ্র বাংলাদেশ ত্রিহৄত ও বিহারের বহুলাংশ এবং উত্তরপ্রদেশের একাংশে তিনি নিজ কর্তৃত্ব কায়েম করতে সক্ষম হন।

পিতার মতোই নসরৎ শাহ শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন। তাঁর উদ্যোগে বহু সুদৃশ্য প্রাসাদ ও সুসজ্জিত মসজিদ নির্মিত হয়। এর মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হল ‘বারদুয়ারী’ বা ‘সোনা মসজিদ’। গৌড়ের প্রখ্যাত ‘কদম রসুল’ ভবনের সংস্কার কাজেও তিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন। এই ভবনের প্রকোষ্ঠে তিনি একটি মঞ্চ নির্মাণ করেন এবং তার ওপরে হজরত মহম্মদের পদচিহ্নযুক্ত একটি কৃষ্ণবর্ণ সুদৃশ্য মর্মরবেদী স্থাপন করেন। বিভিন্ন বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্রেও তিনি একাধিক মসজিদ নির্মাণ করেন। শ্রীকর নন্দী, কবিশেখর প্রমুখ খ্যাতনামা কবিগণ তাঁর অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন। নসরৎ শাহের আমলে মহাভারতের বাংলা অনুবাদ করেন শ্রীকর নন্দী। নসরৎ শাহ ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন। তবে কোনোরকম ধর্মীয় গোঁড়ামি বা পরধর্মবিদ্বেষ তাঁর ছিল না। ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে জনৈক আততায়ীর হাতে নসরৎ শাহ নিহত হন।

পরবর্তী সুলতানগণ : নসরৎ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ফিরোজ শাহ (দ্বিতীয়) সিংহাসনে বসেন। মাত্র এক বছর রাজত্ব করে তিনি পিতৃব্য গিয়াসউদ্দিন মামুদের হাতে নিহত হন। ফিরোজ শাহের আমলে শ্রীধর কবিরাজ নামক জনৈক কবি ‘কালিকামঙ্গল’বা ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য রচনা করেন। সম্ভবত পিতা নসরৎ শাহের জীবিতাবস্থায় ফিরোজ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক শাসকপদে নিযুক্ত ছিলেন। এবং তখনই তিনি এই কাব্যরচনার ব্যাপারে উৎসাহ দেখান।

হুসেন শাহি বংশের শেষ প্রতিনিধি ছিলেন গিয়াসউদ্দিন মামুদ শাহ (১৫৩৩-১৫৩৮ খ্রিঃ)। ইনি ছিলেন দুর্বল, নির্বোধ, অদূরদর্শী ও ইন্দ্রিয়াসক্ত একজন মানুষ। স্বভাবতই রাজ্যের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা ছিল তাঁর সাধ্যাতীত। এই সময়ে মুঘল সম্রাট হুমায়ুন এবং আফগান বীর শেরশাহের মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই চলছিল। এই পরিস্থিতিতে যে ধরনের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা দরকার, তা মামুদ শাহের ছিল না। তাই তিনি রাজনৈতিক চালে বারবার ভুল করেন। হুমায়ুনের বিরুদ্ধে কোনো শক্তিজোটে যোগ দিতে তিনি ব্যর্থ হন। আবার বিহারের জালাল খাঁ’র লোহানীর সাথে মিত্রতাবদ্ধ হয়ে শের খাঁ’কে বাংলার শত্রুতে পরিণত করেন। ফলে শের খাঁ’র নির্দেশে তাঁর ভ্রাতা খাওয়াস খাঁ গৌড়নগরী দখল করে নেন। রাজ্যচ্যুত মামুদ শাহ এই সময়ে শের খাঁ’র বিরুদ্ধে হুমায়ুনের সাহায্য চেয়ে পাঠান। কিন্তু হুমায়ুন চৌসার যুদ্ধে পরাজিত হলে বাংলা শের খাঁ’র হস্তগত হয়। মামুদ শাহ আফগানদের হাতে নিহত হন। এইভাবে বাংলাদেশে হুসেন শাহি বংশের শাসনের অবসান ঘটে এবং দুই শতাধিক বছর ব্যাপী বাংলাদেশের স্বাধীন সুলতানির পরিসমাপ্তি ঘটে।