উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতির অস্তিত্ব:
সিন্ধু উপত্যকার উত্তর-পূর্বে কাশ্মীরে নব্যপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এখানে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নক্ষেত্রটি আবিষ্কৃত হয়েছে বুরজহোমে। ‘বুরজহোম’ কথার অর্থ ‘ভূর্জবৃক্ষের ক্ষেত্র’। এর অবস্থান শ্রীনগরের ১৬ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে। রেডিও কার্বন পদ্ধতিতে মনে করা হয় যে, এই পর্যায় বিস্তৃত ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ২৪১৮ থেকে ১৫৯৩ অব্দের আগে পর্যন্ত। সুপ্রসারিত ঝিলের পাশে বড় বড় গর্তের মধ্যে নব্যপ্রস্তরযুগে আবাস গড়া হয়েছিল। গর্তের গভীরতা ছিল ৩.৯৬ মিটার। ব্যাস ছিল ৪.৫৭ মিটার এবং প্রবেশমুখটি ছিল ২.৭৪ মিটার। তবে, সবগুলি গর্ত আবাস একই পরিধিবিশিষ্ট অবশ্যই ছিল না। ওঠা-নামার জন্য সিঁড়ি ব্যবহার করা হত। এদের অর্থনীতির কেন্দ্রে ছিল শিকার এবং সাপ ধরা। কৃষিকাজের সাথেও এদের প্রাথমিক পরিচয় ঘটেছিল। বুরজহোমে চারটি পর্যায় আবিষ্কৃত হয়েছে। এর ওপরের দিকে প্রথম দুটি নব্যপ্রস্তরযুগীয়, শেষ পর্যায়ে (উচ্চতম) মানুষ মাটির ওপরে গৃহ নির্মাণ করে। বাড়িগুলির মেঝে ও দেওয়ালে কাদামাটির প্রলেপ দেওয়া হত। মৃৎপাত্রগুলি হস্তনির্মিত এবং আগুনে পোড়ানো। নানা আকারের মৃৎপাত্রগুলি ছিল কালো এবং চক্চকে। মসৃণ পাথরের হাতিয়ারের পাশাপাশি হাড়ের হাতিয়ার ব্যবহার করা হত। পাথরের কুঠার, বল্লম, হাড়ের শলা, সূঁচ, ছুরি ইত্যাদি পাওয়া গেছে। বুরজহোমে ডিম্বাকৃতি কবর ও কঙ্কাল পাওয়া গেছে। তবে ব্যবহার্য দ্রব্য অলংকার সম্ভবত দেওয়া হত না। এখানে কবরের নতুনত্ব হল যে, মৃত প্রভুর সাথে তার পালিত কুকুরকেও কবর দেওয়া হত। এমন নিদর্শন উপমহাদেশের অন্য কোথাও পাওয়া যায়নি। অভিমপর্বে ধনুকের ব্যবহারের জন্য তামার তৈরী একটি ‘বানমুখ’ পাওয়া গেছে।
কাশ্মীরের আর একটি নব্যযুগীয় প্রত্নক্ষেত্র হল গুফব্রুল (Gufkral)। শ্রীনগরের ৪১ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত এই বসতির লোকেরা কৃষিকাজ ও পশুপালনের সাথে যুক্ত ছিল। এখানেও নিম্নতম পর্যায়ে মানুষ গর্ত-গৃহে বসবাস করতে অভ্যস্ত ছিল। এই পর্যায়ে কোন মৃৎপাত্র পাওয়া যায় নি। কৃষি-উৎপাদনে গম, বার্লি, যব, মসুর এবং গৃহপালিত পশুর মধ্যে ছাগল, ভেড়া, গরু ইত্যাদি জনপ্রিয় ছিল। এই প্রত্নক্ষেত্রের সময়কাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২৪০০ থেকে ১৬০০ অব্দ। মধ্যপর্যায়ে ধূসররঙের হস্তনির্মিত মৃৎপাত্র নির্মিত হত। উচ্চতম পর্বে চাকার তৈরী রঙিন মৃৎপাত্রের নিদর্শন দেখা যায়। সম্ভবত এরা উলের কাপড় বুনতে সক্ষম ছিল। এই সময় পশু শিকার কমে গিয়ে পশুপালন বৃত্তি অধিক জনপ্রিয় হয়েছিল। হরপ্পা সংস্কৃতির সমসাময়িক হলেও, হরপ্পা সভ্যতার সাথে গুল সংস্কৃতির কোন যোগ ছিল না।
পূর্বে নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতির অস্তিত্ব :
পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের অনেকগুলি অঞ্চলে নব্যপ্রস্তরযুগীয় আয়ুধ ও দ্রব্যসম্ভার পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ক্ষেত্র হল বিহারের পাটনা, হাজারিবাগ, সিংভূম, সাঁওতাল পরগণা; পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, দার্জিলিং, নদীয়া; আসামের গারো ও নাগা পাহাড় এবং কাছাড় জেলা প্রভৃতি। পাটনা শহরের ৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে গঙ্গার উত্তর উপকূলে চিরান্দ গ্রামে নব্যপ্রস্তর যুগীয় বসতির নিদর্শন পাওয়া গেছে। চিরান্দ সংস্কৃতি প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ অব্দের পুরানো। গঙ্গা, শোন, গণ্ডক ও ঘর্ঘরা, এই চারটি নদীর সঙ্গমে প্রসারিত ভূমিখণ্ডে এই বসতি গড়ে উঠেছিল। লক্ষ্যণীয় যে, চিরান্দে প্রস্তরনির্মিত হাতিয়ার বিশেষ পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে, হরিণের সিং (antlers) থেকে কার্যকরী হাতিয়ার কেবল এই প্রত্নক্ষেত্রতেই পাওয়া গেছে। মৃৎপাত্র ছিল মূলত হাতে তৈরী। ধূসর ও লাল রং-এর মৃৎপাত্র বেশি পাওয়া গেছে। তবে কালো এবং লাল-কালো মিশ্রিত রঙের মৃৎপাত্রও ছিল। কৃষিকাজে এদের যথেষ্ট দক্ষতা ছিল। ধান চাষ বিশেষ গুরুত্ব পেত। মৃতদেহকে ঘরের মেঝেতে কবর দেওয়া হত। তিনধরনের সমাধি পাওয়া গেছে। আসাম প্রদেশের পার্বত্য এলাকায় এবং মেঘালয়ের গারো পাহাড়ে নব্যপ্রস্তরযুগীয় বসতির সন্ধান পাওয়া গেছে। পশ্চিমবঙ্গে পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতির প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের চিহ্ন পাওয়া গেছে। প্রথম পর্যায়ে ধান চাষ হত। মৃৎপাত্রে সুতো দিয়ে সূক্ষ্ম নক্শা করার চিহ্ন পাওয়া যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ধান চাষের ব্যাপকতা এবং কুমোরের চাকার ব্যবহার লক্ষণীয়। মৃৎপাত্রের মধ্যে বয়াম, বেসিন, প্লেট ও ঘটি জাতীয় গৃহস্থালির সামগ্রী জনপ্রিয় ছিল। লাল-কালো, উজ্জ্বল-লাল এবং চকোলেট রং দ্বারা মৃৎপাত্রগুলির সৌন্দর্য বাড়ানো হত। উল্লেখ্য যে, পূর্বভারতে নব্যপ্রস্তরযুগের যে-সব নিদর্শন পাওয়া গেছে, তা উৎখননের ফলে প্রাপ্ত নয়। এগুলি অধিকাংশই মাটির উপরের অংশে বা নদীর শুষ্ক খাতে পাওয়া গেছে।
দক্ষিণভারতে নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতি :
দক্ষিণ-ভারতে অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক ও তামিলনাড়ুতে নব্যপ্রস্তরযুগীয় প্রায় ৮৫০টি বসতির চিহ্ন আবিষ্কৃত হয়েছে। কর্ণাটকের মাস্কি, ব্রত্নগিরি, হাল্লুর, সঙ্গনকন্তু, টেকনকোটা, কোডেকল, পিকলিহাল প্রভৃতি, অন্ধ্রপ্রদেশের উটপুর এবং তামিলনাড়ুতে পাইয়মপল্লি অঞ্চলে নব্যপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতির অস্তিত্ব জানা যায়। এই কাজে বহু আগেই সাফল্য পান ব্রুস ফুট (R. Bruce Foote)। কৃষ্ণা নদীর অববাহিকায় তিনি অনেকগুলি নব্যপ্রস্তরযুগীয় কুঠার উদ্ধার করেছিলেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে স্যার মার্টিমার হুইলার যখন কাজ চালিয়ে উল্লেখিত অঞ্চলগুলিতে নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতির অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছেন। রামশরণ শর্মার মতে, খ্রিষ্টপূর্ব ২৪০০ অব্দ থেকে ১০০০ অব্দের মধ্যে এই সংস্কৃতিগুলির অস্তিত্ব ছিল।
দক্ষিণ ভারতে নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতির ধারাকে তিনটি অবিচ্ছিন্ন অন্তর্দশায় বিভক্ত করা যায়। প্রথম পর্যায়ে এরা ছিল মূলত পশুপালনকারী। গৃহপালিত পশুর মধ্যে প্রধান ছিল গোরু, মোষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি। এদের বসতিগুলি পাহাড়ের মাথায় কিংবা দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী সমভূমিতে গড়ে উঠেছিল। নিকটবর্তী অরণ্যভূমিতে পশুখামারগুলি অবস্থিত ছিল। হাতিয়ারের মধ্যে ছিল পাথরের তৈরী মসৃণ কুঠার এবং ছুরির পাত (blade)। পাথরের পেশাই যন্ত্র পাওয়া গেছে। সম্ভবত ডাল জাতীয় শস্য তারা উৎপাদন করত। মৃৎপাত্র ছিল হস্তনির্মিত এবং ধূসর ও বাদামী রঙ বিশিষ্ট। পাহাড়ের গায়ে চিত্রাঙ্কণের আভাস পাওয়া যায়। ধাতুর অস্তিত্ব ছিল কিনা, জানা যায় না। এই পর্যায়ের সময়কাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২৪০০-১৮৩০ অব্দ। দ্বিতীয় অন্তর্দর্শার পরিধি আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৩০-১৫০০ খ্রিষ্টপূর্ব। এই পর্যায়ে মাটির ঘর নির্মাণ শুরু হয়। তবে দেওয়ালের উচ্চতা ছিল খুবই কম। পাথরের হাতিয়ারের উন্নতমান ও বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। তামা ও ব্রোঞ্জের সাথে এই পর্বে পরিচয় ঘটেছিল। দক্ষিণভারতীয় নব্যযুগীয় সংস্কৃতির তৃতীয় পর্যায় শেষ হয় খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দে। এই পর্বে ধাতুর ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। মৃৎপাত্র নির্মাণে চাকার ব্যবহার ঘটে। তামা ও ব্রোঞ্জের তৈজসপত্র ছাড়াও তামার সূক্ষ্ম বড়শি নির্মাণ সম্ভব হয়েছিল। প্রস্তর আয়ুধ নির্মাণের কাজেও প্রভূত উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। মৃতদেহ ঘরের মেঝেতে কবর দেওয়া হত। মৃতদেহের সাথে পানীয় খাবার পাত্র দেওয়ার রীতি ছিল।
Leave a comment