উত্তর-কমিউনিস্ট রাষ্ট্রসমূহে কমিউনিজম থেকে নতুন ব্যবস্থায় রূপান্তর বা উপনীত হওয়ার বিষয়টি সর্বাংশে সহজ-সরল নয়, বহুলাংশে বলপ্রয়োগমূলক হিসাবে প্রতীয়মান হয়। কারণ আমজনতা নতুন বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বাধ্য হয়। সাবেকি পরিচয় পরিহার করে নতুন ব্যক্তিবর্গও সমষ্টিগত সত্তার অনুসন্ধানের সামিল হয়। পূর্ববর্তী কমিউনিস্ট আমলে জনসাধারণ এমন একটি মতাদর্শের আওতায় ছিল যা সর্বান্তভুক্তিমূলক। কমিডনিজমের পতনের পর জনজীবন থেকে এই সর্বপরিবেষ্টনমূলক মতাদর্শ অপসারিত হয়েছে। তারফলে একটি সামাজিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। এই শূন্যতা পূরণ করা আবশ্যক। বৃহত্তর ব্যক্তিগত কাজকর্মের ব্যাপারে উত্তর-কমিউনিস্ট সমাজের সম্ভাবনাসূচক ক্ষমতা আছে। কিন্তু এই ক্ষমতার সঙ্গে সংযুক্ত ব্যাপক ঝুঁকি।

উত্তর-কমিউনিস্ট দেশগুলিতে সমাজব্যবস্থার রূপান্তরের অভিব্যক্তি ঘটেছে বিভিন্নভাবে। সমাজহ ব্যক্তিবর্গের পূর্ববর্তী কমিউনিস্ট আমলের সামাজিক পরিচিতি পরিহার করে প্রাক্ কমিউনিস্ট সমাজের পরিচিতির পুনর্নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সামাজিক পরিচিতির পরিবর্তনের প্রক্রিয়া নরনারীর সম্পর্কের বিদ্যমান প্রকৃতিকে প্রভাবিত করে। কমিউনিস্ট আমলে নারী-পুরুষের সাম্যের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। মহিলাদের শ্রমিকশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং বিবিধ সামাজিক সুবিধা প্রধান করা হয়। তারফলে নারীকল্যাণমূলক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পায়। যাইহোক কমিউনিজমের অবসান ঘটল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট আমলের সংশ্লিষ্ট নীতি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ বহুলাংশে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে বিরূপ সমালোচনা ও বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। নারী-পুরুষের সাম্যের কথা বলা হলেও বাস্তবে এই সাম্য সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। উত্তর-কমিউনিস্ট আমলে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সংস্কার কর্মসূচী গৃহীত হয়। তার ফলে মহিলা ও পরিবারের জন্য কমিউনিস্ট আমলে স্বীকৃত সামাজিক নিরাপত্তামূলক ব্যাপক ব্যবস্থায় উত্তর-কমিউনিস্ট আমলে বিশেষভাবে কাটছাঁট করা হয়। উত্তর-কমিউনিস্ট আমলে সামাজিক ক্ষেত্রে ধর্মের প্রভাব-প্রতিপত্তির পুনরুত্থান ঘটে। তার ফলে কমিউনিস্ট আমলে অভিপ্রেত এবং স্বীকৃত নারীজাতির ভূমিকা এবং অনুসৃত রীতি-নীতি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। কমিউনিস্ট আমলের কিছু কার্যধারার তীব্র বিরোধিতা করা হয়। নির্বিবাদে গর্ভপাতের বিষয়টিকে কঠোরভাবে আক্রমণ করা হয়।

উত্তর-কমিউনিস্ট দেশগুলিতে গোষ্ঠীগত পরিচয়ের প্রকার হিসাবে জাতিসত্তামূলক ও জাতিগত পরিচয়ের স্বাতন্ত্র্য পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। প্রাক্ কমিউনিস্ট আমলে বিভিন্ন ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ, প্রতীক প্রভৃতি একটি জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ বা সুসংহত করত। সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ পুনরায় জনসমাজে প্রাধান্য লাভ করে। জাতীয় গৌরবকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য নেতৃবর্গ ও জনসাধারণের মধ্যে পুনরায় উদ্যোগ আয়োজন পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু এই উদ্যোগ-আয়োজনের সুযোগ-সুবিধা সকল উত্তর-কমিউনিস্ট দেশে সমানভাবে দেখা যায় নি। দেশ ও অঞ্চলভেদে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়েছে।

পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল বহু ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষজন। সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীসমূহের জাতিসত্তাগত স্বাতন্ত্র্য ঐতিহাসিকভাবে অনেকাংশে হীনবল হয়ে পড়েছিল। এই সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাতন্ত্র্যসূচক বংশগত বা জাতীয় প্রতিষ্ঠান খুব বেশী ছিল না। স্বভাবতই তাদের স্বাতন্ত্র্যসূচক পরিচয়কে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ-আয়োজন বড় একটা পরিলক্ষিত হয়নি।

বিপরীতক্রমে পূর্ব ইউরোপের অধিকাংশ দেশে বংশগত ও জাতিগত পরিচয়ের স্বাতন্ত্র্যতাবোধ সুস্পষ্টভাবে বর্তমান ছিল। এই স্বাতন্ত্র্যবোধ সুদীর্ঘকালের বংশপরম্পরাগত। কমিউনিস্ট শাসন কায়েম হওয়ার পরেও সংশ্লিষ্ট সামাজিক কাঠামোসমূহের অস্তিত্ব অব্যাহত থাকে। বরং বলা যায় যে, কর্তৃত্ববাদী কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানসিকতার পরিচায়ক হিসাবে স্বাতন্ত্র্যবোধ অধিকতর শক্তিশালী হয়।

উত্তর-কমিউনিস্ট দেশগুলিতে সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের রূপান্তর প্রক্রিয়ায় সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ হল ধর্ম এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের পুনরুত্থান। পূর্ববর্তী কমিউনিস্ট আমলে কমিউনিস্ট পার্টি ধর্মকে অবদমিত করে রেখেছিল। কমিউনিজমের পতনের পর পুনরায় ধর্ম সামাজিক কাঠামোর উপরের স্তরে উঠে আসে। উত্তর-কমিউনিস্ট বিভিন্ন দেশে এই ধারা পরিলক্ষিত হয়। ধর্মের ভূমিকার এই প্রত্যাবর্তনের সুবাদে অনেক দেশেই সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধসমূহের পুনরায় অভ্যুত্থান ঘটে। তাছাড়া এই পথে ধর্মীয় মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এবং ধর্ম ও রাজনীতির সংঘাত-সংঘর্ষ বৃদ্ধি পায়। জীবনের অভিষ্ট লক্ষ্য এবং সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীগত চেতনা জনসাধারণের মধ্যে সঞ্চারিত করার ক্ষেত্রে ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরকারী দমনপীড়ন, দুর্নীতি এবং আর্থনীতিক দুঃখকষ্টের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মীয় পুনরুত্থানের তাৎপর্য অনস্বীকার্য।

পূর্ব-ইউরোপ এবং পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ বিশেষে পশ্চিমী ভগবদ্বাক্য প্রচার বিষয়ক আন্দোলন বিকাশ ও বিস্তার লাভ করে। ধর্মান্তরিতকরণের ঘটনা ঘটতে থাকে। সমকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য অঞ্চলে বিশেষত মধ্য এশিয়ায় শক্তিশালী ধর্মমত হিসাবে ইসলাম বিশেষভাবে বিকশিত হয়। হাজারে হাজারে মসজিদ ও ধর্মীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বিষয়ে আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা আসে সৌদি আরবিয়ার মত সম্পদশালী মুসলিম দেশগুলি থেকে।

উত্তর কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের রূপান্তরের মূল্যায়ন

উত্তর কমিউনিস্ট রাষ্ট্রসমূহে সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের রূপান্তর সমভাবে সম্পাদিত হয়েছে এমন নয়। বিভিন্ন দেশে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির রূপান্তর হয়েছে বিভিন্নভাবে। উত্তর-কমিউনিস্ট দেশগুলিতে নারী-পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রগতি ও পশ্চাদগতি উভয়ই পরিলক্ষিত হয়। কমিউনিস্ট জমানায় নরনারীর সাম্যের বিষয়টিকে আড়ম্বরপূর্ণভাবে তুলে ধরা হয়েছিল। যদিও বাস্তবে তা খুব বেশী দূর রূপায়িত হয় নি। কমিউনিজমের পতনের পর উত্তর-কমিউনিস্ট দেশগুলিতে এ ক্ষেত্রে অগ্রগমন ও পশ্চাদপসরণ উভয়ই ঘটেছে। বিশ্বব্যাংকের ‘World Development Indicators 2001, 2005’ সূত্রে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান সূত্রে এ বিষয়ে তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। সরকারের মন্ত্রী পর্যায়ের পদে অপেক্ষাকৃত অধিক সংখ্যক মহিলা আসীন হয়েছেন। কিন্তু অপেক্ষাকৃত কমসংখ্যক মহিলা আইনসভায় নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৯০ সালে সংশ্লিষ্ট দেশগুলির আইনসভায় মহিলাদের প্রতিনিধিত্বের হার ছিল গড়ে ২১ শতাংশ। ২০০৪ সালে এই হার হ্রাস পেয়ে হয় গড়ে ১২ শতাংশ। অথচ উত্তর-কমিউনিস্ট জমানায় পার্লামেন্ট অধিকতর ক্ষমতাশালী হয়েছে। আবার মজুরীর হারে নারী-পুরুষের মধ্যে অল্পবিস্তর পার্থক্য থাকলেও, এ কথা বলা যাবে না যে, মহিলারা বেকারত্ব থেকে অসমানুপাতিকভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। বস্তুত সাম্য, স্বাধীনতা ও প্রগতির পরিে ক্ষতে উত্তর কমিউনিস্ট সকল অভিন্ন অগ্রসর হয় নি। এ বিষয়ে দেশ ভেদে অল্পবিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তবে উত্তর-কমিউনিস্ট রাষ্ট্রসমূহ সাধারণভাবে সামাজিক খাতে খরচ-খরচা বিশেষভাবে হ্রাস করেছে। তার ফলে সন্তান প্রতিপালনের মত বিভিন্ন খাতে মহিলাদের উপর ব্যয়ভার বৃদ্ধি পেয়েছে।

কমিউনিস্ট দুনিয়ার অধিকাংশ অঞ্চল বিগত কয়েক দশক যাবৎ বহুলাংশে শান্তিপূর্ণ আছে। জাতি গোষ্ঠীগত এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীগত সংঘাত-সংঘর্ষের মীমাংসা করা বা বিবাদ-বিসংবাদকে এড়িয়ে যাওয়া বহুলাংশে সম্ভব হয়েছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে জাতিগত ও ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যসূচক পরিচয় জঙ্গী প্রকৃতির গৃহযুদ্ধে ইন্ধন জুগিয়েছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের কতকগুলি অঞ্চলের কথা বলা যায়। উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, আজারবাইজান, চেনিয়া, মলডোভা এবং আরমেনিয়ায় রক্তক্ষয়ী দাঙ্গাহাঙ্গামা হয়েছে। হাজারে হাজারে মানুষের জীবনহানি ঘটেছে। বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধ আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। পূর্ব ইউরোপে যুগোস্লাভিয়ার ভেঙ্গে যাওয়ার ঘটনায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মীয় গোষ্ঠী একে অপরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষের সামিল হয়। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই সংঘর্ষে দু’লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে।