মার্কস-পূর্ব আলোচনা: কার্ল মার্কসের আগে অনেক সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীর রচনায় মানবসমাজের ক্রমবিকাশের এক ধরনের পরিচয় পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে যাঁদের নাম উল্লেখ করা দরকার তাঁরা হলেন অগস্ত কঁৎ, টাইলর, হার্বাট স্পেনসার প্রমুখ। এঁরা বিবর্তনবাদী হিসাবে পরিচিত। এঁদের অভিমত অনুযায়ী মানবসমাজ অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তর থেকে উচ্চস্তরে উপনীত হয়েছে। তবে মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ব্যাখ্যায় এ সময় ধর্মীয় আধিদৈবিক ধারণারই প্রাধান্য ছিল। ডারউনের বিবর্তনবাদে প্রথম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার পরিচয় পাওয়া যায়। সমাজের ক্রমবিকাশের সূত্রে ও সুবাদে মানুষেরও ক্রমবিকাশ ঘটেছে। এই প্রসঙ্গে মর্গান (Lewis Henry Morgan)-এর ১৮১৭ সালে প্রকাশিত Ancient Society শীর্ষক গ্রন্থটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মর্গান সমাজবিকাশের তিনটি স্তরের কথা বলেছেন। এই তিনটি স্তর বা যুগ হল: বন্যযুগ (savagery), বর্বর যুগ (barbarian) এবং সত্যযুগ (civilization)।
মার্কসের আলোচনা: মার্কসীয় দর্শন অনুযায়ী মানুষ কেবলমাত্র ‘বুদ্ধিশীল’ (homo sapien) নয়, ‘সৃষ্টিশীল’ (homo faber)-ও। মানুষের গঠনক্ষমতা আছে। তদনুসারে মানুষ প্রকৃতির রূপান্তর সাধন এবং বিভিন্নরকম সৃষ্টি করতে পারে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যুদ্ধ অবিরাম। এই দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরী হয় মানুষের জীবিকা উপার্জনের পথ। মার্কস-এঙ্গেলস রচিত The German Ideology শীর্ষক গ্রন্থটিতে প্রথম মানবসমাজের স্তর বিকাশ সম্পর্কে জানা যায়। এই গ্রন্থটিতে ‘প্রাচীন’, ‘সামন্ত’ ও ‘পুঁজিবাদী’ এই ভাবে সমাজবিকাশের স্তরগুলিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। পরবর্তী কালে মার্কস-এর Preface to the Critique of Political Economy শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এই বইটিতে এশীয় সমাজ, প্রাচীন সমাজ, সামত্ত সমাজ ও বুর্জোয়া সমাজের কথা বলা হয়।
মানবসমাজের প্রকৃতি উৎপাদন ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল: মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারাকে সামাজিক ও আর্থনীতিক বিকাশের মান অনুযায়ী কতকগুলি স্তর বা পর্যায়ে বিভক্ত করা হয়। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন-সম্পর্কের চরিত্রই হল সামাজিক প্রগতির মান নির্ধারণের মাপকাঠি। সমাজের ক্রমবিকাশের যে-কোন স্তরে বৈষয়িক সম্পদের উৎপাদনই হল মানবিক সমাজজীবনের ভিত্তি। উৎপাদন ব্যবস্থার দিক বর্তমান: (১) সমাজের উৎপাদন শক্তি (forces of production) এবং (২) সমাজের উৎপাদন সম্পর্ক (relation of production)। উৎপাদন শক্তি বলতে বৈষয়িক দ্রব্যাদি উৎপাদনের উপকরণসমূহ (instruments of production) এবং শ্রমকৌশল ও মানুষের উৎপাদন-অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাকে বোঝায়। আবার সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গ এককভাবে উৎপাদন করে না। মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বা দলবদ্ধভাবে উৎপাদন করে। সমাজে উৎপাদন সম্পর্ক বলতে উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে বোঝায়। উৎপাদনের উপাদানের উপর মালিকানার ভিত্তিতে উৎপাদন-সম্পর্ক নির্ধারিত হয়। উৎপাদন শক্তির পরিবর্তন ঘটে উৎপাদনের যন্ত্রপাতির পরিবর্তন ও উন্নতির ফলে। উৎপাদন শক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তনশীল, তাই সমাজও গতিশীল। স্ট্যালিন (Stalin) – এর মতানুসারে কোন একটি যুগের পরিবর্তনকে সেই যুগের উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের ভিতরকার দ্বন্দ্ব দিয়ে বিচার করতে হবে।
উৎপাদন ব্যবস্থার ভিত্তিতেই সমাজের আর্থনীতিক কাঠামো গঠিত হয়। আবার এই আর্থনীতিক কাঠামো অনুসারে রাষ্ট্রব্যবস্থা; আইন, শাসন, বিচার প্রভৃতি সরকারী কার্যকলাপ; ধর্ম, দর্শন প্রভৃতি সর্ববিধ মানবিক অভিব্যক্তি, এক কথায় সমাজব্যবস্থার উপরের গঠনবিন্যাস বা উপরি-সৌধ (super-structure) গড়ে উঠে।
ভিত্তি ও উপরি-কাঠামো: সমাজের উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তিতে গঠিত আর্থনীতিক কাঠামো হল বনিয়াদ (Base)। এই বনিয়াদের উপর দাঁড়িয়ে আছে আইন সম্পর্কিত ও রাজনীতিক উপরি-কাঠামো (super-structure)। আইন, আদালত, কারাগার, রাজনীতিক, নৈতিক, ধর্মীয়, নান্দনিক, দার্শনিক প্রভৃতি বিষয় উপরি-কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত। বনিয়াদ ও উপরিকাঠামোর মাধ্যমে যে কোন সমাজব্যবস্থার প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য প্রতিপন্ন হয়। সমাজব্যবস্থার আর্থনীতিক ভিত্তি ব্যক্ত হয় বনিয়াদের মাধ্যমে। সমাজব্যবস্থার রাজনীতিক ও ভাবাদর্শগত চিত্র প্রকাশিত হয় উপরিকাঠামোর মাধ্যমে। মানব সমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় একটি সমাজব্যবস্থা থেকে অপর একটি সমাজব্যবস্থার উত্তরণের ক্ষেত্রে বনিয়াদ ও উপরি-কাঠামোতে পরিবর্তন ঘটে। মার্কস মন্তব্য করেছেন: “The sum total of these relations of production constitutes the economic structure of society-the real foundation, on which rises a legal and political superstructure.
আর্থ-সামাজিক বিন্যাসের বিকাশ ও পরিবর্তন: এক সমাজব্যবস্থা থেকে আর একটি সমাজব্যবস্থায় উন্নীত হওয়ার এই প্রক্রিয়াকে বলে সামাজিক বিপ্লব। এই সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে মানবসমাজের রূপান্তর সম্পর্কে বিস্তারিত বিচার-বিশ্লেষণ ঐতিহাসিক বস্তুবাদে বর্তমান। সমাজের আর্থনীতিক ব্যবস্থা ও উপরি-কাঠামোর পারস্পরিক ক্রিয়া সমাজের বিকাশ হিসাবে বিবেচিত হয়। সমাজবিকাশের নির্দিষ্ট পর্যায়কে ঐতিহাসিক বিচারে আর্থ-সামাজিক বিন্যাস হিসাবে গণ্য করা হয়। যে-কোন আর্থ-সামাজিক বিন্যাসই হল পরিবর্তনশীল। কোন আর্থ-সামাজিক বিন্যাসই চিরন্তন বা স্থায়ী নয়। বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক বিন্যাসের বিকাশ ও পরিবর্তনের ইতিহাসই হল মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ইতিহাস। সমাজবিকাশের ধারায় নির্দিষ্ট একটি পর্যায়ে নির্দিষ্ট একটি আর্থ-সামাজিক বিন্যাসের উদ্ভব হয়। কালক্রমে তা পুরাতন হয়ে পড়ে এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তখন আর একটি নতুন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার আবির্ভাব ঘটে। এই প্রক্রিয়া মানবসমাজের প্রগতির পথ হিসাবে পরিগণিত হয়। এবং এই পথেই সমাজ ক্রমশ উন্নততর স্তরের দিকে এগিয়ে চলে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে, যে কোন সমাজের উৎপাদন-প্রণালীই সংশ্লিষ্ট সমাজের আর্থ-সামাজিক বিন্যাস নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্ণায়ক ভূমিকা গ্রহণ করে। এই উৎপাদন-প্রণালীর পার্থক্যের কারণে প্রত্যেক সমাজব্যবস্থার আর্থ-সামাজিক বিন্যাস পৃথক প্রকৃতির হয়ে থাকে।
সমাজ-বিকাশের পাঁচটি পর্যায়: সমাজের আর্থনীতিক কাঠামো ও তার উপরের গঠন বিন্যাস অনুযায়ী মানবসমাজের প্রগতিকে মোটামুটি পাঁচটি পর্যায়ে বিভক্ত করা হয়:
-
(ক) আদিম সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা,
-
(খ) দাস-ব্যবস্থা,
-
(গ) সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা,
-
(ঘ) ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং
-
(ঙ) সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা।
সামাজিক ও আর্থনীতিক বিকাশের মাত্রার পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেক মানবগোষ্ঠী তার অস্তিত্বের নির্দিষ্ট পর্যায়ে উপরি-উল্লিখিত কোন-না-কোন সমাজব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত। মার্কসের মতানুসারে উপরি-উল্লিখিত মানবসমাজের প্রগতির পাঁচটি পর্যায় হল পাঁচ ধরনের আর্থ-সামাজিক বিন্যাস। উৎপাদন শক্তির বিকাশের স্তরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ উৎপাদন সম্পর্কের প্রগতির পরিপ্রেক্ষিতে এই পাঁচ ধরনের আর্থ-সামাজিক বিন্যাসের আবির্ভাব ঘটে।
Leave a comment