রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত মার্কসীয় আলোচনা থেকে স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয় যে রাষ্ট্র চিরন্তন বা শাশ্বত প্রতিষ্ঠান নয়। মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় উৎপাদন শক্তি বিকাশের একটি বিশেষ পর্যায়ে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সমাজে শ্রেণীর উদ্ভব ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। ব্যক্তিগত সম্পত্তি সংরক্ষণ এবং অন্যান্য শ্রেণীর উপর শাসন-শোষণ কায়েম করার জন্য বলপ্রয়োগকারী সংগঠন হিসাবে সৃষ্টি হয়েছে রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র হল শ্রেণী-শাসন ও শ্রেণী-প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার এক বলপ্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। লেনিনের অভিমত অনুসারে রাষ্ট্র হল মানবসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এক ধরনের শাসনতন্ত্র। রাষ্ট্রের চেহারা বা রূপের ক্ষেত্রে প্রতি যুগেই বিভিন্ন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তবে প্রকৃতিগত বিচারে সকল রাষ্ট্রই হল শ্রেণী-রাষ্ট্র এবং শোষণমূলক। তবে মূল কাঠামো উপরি-কাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আবার উপরি-কাঠামোও মূল কাঠামোকে প্রভাবিত করে থাকে।

দাস-সমাজে রাষ্ট্র

দাস-মালিক রাষ্ট্র: দাস-সমাজ দাস ও দাস-মালিকে বিভক্ত। এবং এই দাস সমাজই হল প্রথম শ্রেণীবিভক্ত সমাজ। সমাজ-বিকাশের ধারায় এ হল শ্রেণী-শাসিত সমাজের স্তর। এই সমাজে যাবতীয় উৎপাদন-উপাদানের মালিকানা এবং সমগ্র আর্থনীতিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দাস মালিকদের হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। দাস-সমাজে রাষ্ট্রের আকৃতি ছিল মোটামুটিভাবে ছোট। এর ভৌগোলিক আয়তন সংকীর্ণ সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এই রাষ্ট্রের কাজকর্মের পরিধিও ছিল সীমাবদ্ধ। দাস-সমাজে রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ছিল আর্থনীতিক ভিত্তির উপরি-কাঠামো হিসাবে দাস-মালিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। সমকালীন রাষ্ট্রীয় আইনের পরিপ্রেক্ষিতে ক্রীতদাসরা দাস-মালিকের অস্থাবর সম্পত্তি হিসাবে বিবেচিত হত। এই রাষ্ট্রের মাধ্যমে দাস-মালিক ক্রীতদাসদের উপর আধিপত্য অব্যাহত রাখত। প্রাচীন গ্রীস ও রোমে এই ধরনের রাষ্ট্রের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। দাস-মালিকদের স্বার্থেই এই রাষ্ট্র পরিচালিত হত। লেনিনের অভিমত অনুসারে রাজতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক, অভিজাততান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক প্রভৃতি যে ধরনেরই হোক না কেন, দাস-সমাজে রাষ্ট্র ছিল দাস-মালিক রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের মূল কাজ ছিল দাসদের শোষণ এবং দাস মালিকদের সম্পত্তি-স্বার্থ সংরক্ষণ।

সামন্ত-সমাজে রাষ্ট্র

সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র: মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় দাস-সমাজের পরে এসেছে সামন্তসমাজ। শ্রেণী-শাসিত সমাজে দ্বিতীয় স্তর হল এই সামন্ততান্ত্রিক সমাজ। সামন্ত-সমাজও মূলত দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত। এই দু’টি শ্রেণী হল সামন্ত-জমিদার এবং কৃষক-ভূমিদাস। দাস-সমাজের ক্রীতদাসত্ব সামস্ত-সমাজে ভূমিদাসত্বে রূপান্তরিত হল। শ্রেণীবিভক্ত সমাজের মূল বিষয়টি এখানেও পুরোপুরি বর্তমান থাকে। এই বিষয়টি হল শ্রেণী-শোষণ। তবে দাস-সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে সামন্ত-সমাজে শোষণের প্রকৃতির কিছু পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু শ্রেণী-সমাজের সারবস্তু শোষণ ও বলপ্রয়োগের ব্যবস্থা অব্যাহত থাকে। তবে শোষণের প্রকৃতির পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে দাস-মালিক রাষ্ট্র সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়। রাষ্ট্র-যন্ত্রটির উৎপত্তি হয়েছে দাস-সমাজে। সামপ্ত-সমাজে সামত্ত-প্রভুরা দাস-মালিকদের হাত থেকে রাষ্ট্রযন্ত্রটি দখল করে নেয়। তারপর সামস্তশ্রেণীর সম্পত্তি-স্বার্থের দিকে নজর রেখে তার প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করা হয়। তারপর সংখ্যালঘু সামন্তপ্রভুদের স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সামস্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রটিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভূমিদাসদের উপর শাসনশোষণ কায়েম করার জন্য ব্যবহার করা হয়। সমগ্র মধ্যযুগ জুড়ে ইউরোপে সামন্তবাদের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। সামন্ত সমাজেও রাজতন্ত্র ও সাধারণতন্ত্র পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল সামন্ত-প্রভুদের হাতে শ্রেণীস্বার্থ সংরক্ষণের ও বলপ্রয়োগের একটি হাতিয়ার বিশেষ। লেনিনের অভিমত অনুসারে, জমিদার-শ্রেণীর এমন একটি যন্ত্রের প্রয়োজন ছিল যার সাহায্যে নিজেদের ক্ষমতা কায়েম করা যাবে, আধিপত্য অব্যাহত রাখা যাবে ও অসংখ্য কৃষক ভূমিদাসদের অধীনে রাখা যাবে। এই যন্ত্রটিই হল সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র।

পুঁজিবাদী সমাজে রাষ্ট্র

পুঁজিবাদী রাষ্ট্র: সমাজবিকাশের ধারায় সামন্ত-সমাজের পরেই পুঁজিবাদী সমাজের আবির্ভাব ঘটে। প্রকৃত প্রস্তাবে সামন্ত-সমাজের মধ্যেই পুঁজিবাদের উন্মেষ ঘটে। পুঁজিবাদী সমাজও হল একটি শ্রেণীবিভক্ত ও শ্রেণী-শাসিত সমাজ। এবং এই ধরনের সমাজের মধ্যে সর্বাধিক বিকশিত সমাজ। পুঁজিবাদী সমাজকে লেনিন প্রত্যক্ষ করেছেন। সমকালীন অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি পুঁজিবাদী সমাজের রাষ্ট্র প্রসঙ্গে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। পুঁজিবাদী সমাজও হল শ্রেণীবিভক্ত সমাজ। এই সমাজের দু’টি মূল শ্রেণী হল শোষক পুঁজিপতি শ্রেণী এবং শোষিত সর্বহারা শ্রেণী। এ হল পুঁজিবাদী সমাজের পরিবর্তিত নতুন রূপ। বুর্জোয়া বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদী সমাজ আকারে প্রকারে নতুন রূপ ধারণ করে। এই বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্রটি সামন্ত-প্রভুদের হাত থেকে পুঁজিপতি শ্রেণীর হাতে আসে। পুঁজিপতি শ্রেণী নিজেদের প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে এই রাষ্ট্রযন্ত্রটির সংস্কার সাধন বা রদবদল করে। এই রাষ্ট্র পুঁজি শোষণের যন্ত্র হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। সর্বহারা শ্রমিক ও মেহনতি কৃষকদের উপর শাসন-শোষণ কায়েম করার জন্য পুঁজিপতি শ্রেণী কলকারখানার শ্রমিক এবং গরীব কৃষি-শ্রমিকদের উপর তাদের শোষণ ও আধিপত্যকে অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা করে। তবে এই বুর্জোয়া রাষ্ট্রের বাইরের আবরণটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সাম্য, স্বাধীনতা, সংসদীয় গণতন্ত্র, জনসাধারণের সার্বভৌমিকতা, সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার প্রভৃতি উদারনীতিক রাজনীতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন উপাদান বা বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়। বহিরাবরণের এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রের থেকে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র অনেক বেশী অগ্রসরপ্রাপ্ত। প্রকৃত প্রস্তাবে পুঁজিই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের মাধ্যমে সমগ্র সমাজের উপর প্রভুত্ব কায়েম করে। এই রাষ্ট্র হল বুর্জোয়া রাষ্ট্র। সকল শ্রমজীবী মানুষকে এই রাষ্ট্র শোষণ করে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র শ্রেণী-শাসন, শ্রেণী-শোষণ, দমন-পীড়ন ও বলপ্রয়োগের এক সক্রিয় মাধ্যম। বস্তুত বুর্জোয়া শ্রেণী সামগ্রিকভাবে নিজেদের শ্রেণী-স্বার্থ এবং বিশেষত সম্পত্তিস্বার্থের অনুকূলে রাষ্ট্র কাঠামোকে গড়ে তোলে। তার শ্রেণীগত আধিপত্যকে অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে এই বুর্জোয়া রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র সংসদীয় গণতান্ত্রিক, সাংবিধানিক, রাজতান্ত্রিক, প্রজাতান্ত্রিক, প্রকাশ্য একনায়কতান্ত্রিক, ফ্যাসিবাদী প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। এতদ্‌সত্ত্বেও এই রাষ্ট্রের শোষণ ও পীড়নমূলক প্রকৃতির কোন পরিবর্তন ঘটে না। বুর্জোয়া রাষ্ট্র হল শ্রমিক-কৃষককে শোষণ করার জন্য বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতে একটি কার্যকর হাতিয়ার। এঙ্গেলসের অভিমত অনুসারে ধরন গঠন নির্বিশেষে আধুনিক রাষ্ট্র হল পুঁজিপতিদের রাষ্ট্র। এ হল সমগ্র জাতীয় পুঁজির এক আদর্শ অভিব্যক্তি।

সমাজতান্ত্রিক সমাজে রাষ্ট্র

সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র: পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় বিকশিত উৎপাদন-শক্তি ও বিদ্যমান উৎপাদন-সম্পর্কের মধ্যে মীমাংসার অতীত বিরোধ আটকান যায় না। এই অনপনেয় সংঘাতের পরিণতিতে পুঁজিবাদের পতন ঘটে। এবং অনিবার্যভাবে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার আবির্ভাব ঘটে। শ্রমজীবী জনতার সংগ্রামের সাফল্যের ভিত্তিতে পুঁজিবাদের পতন এবং সমাজতন্ত্রের পত্তন সুনিশ্চিত হয়। সমাজতান্ত্রিক সমাজে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠে তা হল মেহনতি মানুষের রাষ্ট্র সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সংখ্যাগত ও গুণগত বিচারে এই রাষ্ট্রব্যবস্থার চেহারা-চরিত্র নতুন ধরনের। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শ্রমজীবী জনসাধারণ নিজেদের শাসকশ্রেণীতে উন্নীত করে। আগেকার সকল সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছে মুষ্টিমেয় মানুষের দ্বারা তাদেরই স্বার্থে। সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাতেই রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালনার অধিকার সংখ্যাগুরু শোষিত মানুষের হাতে আসে। এতদিন পরে শোষিত শ্রমিক-শ্রেণী রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী হয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র শোষণের হাতিয়ার নয়। এই রাষ্ট্র যাবতীয় শোষণের অবসান ঘটায় এবং সাম্যবাদী সমাজের বনিয়াদ গড়ে তোলে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণের উপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে শ্রম ও বণ্টনের সমতা রক্ষার স্বার্থে সক্রিয় ও সহায়ক ভূমিকা গ্রহণ করে। উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপন্নের উপর সামাজিক মালিকানার স্বীকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিকশিত উৎপাদন শক্তি এবং বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে বিরোধের বিলুপ্তি ঘটায়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যাবতীয় বিরোধের বিলুপ্তি ঘটে, সংঘর্ষের সৃষ্টি হয় না। আগেকার শ্রেণীবিভক্ত সকল সমাজব্যবস্থাতেই রাষ্ট্র ছিল অনিবার্যভাবে শোষণমূলক প্রকৃতির। কিন্তু মেহনতি মানুষের এই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র তা নয়। সুতরাং পুরাতন ও প্রচলিত অর্থে একে রাষ্ট্র বলা চলে না। এতদ্‌সত্ত্বেও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, রাষ্ট্র হিসাবেই অভিহিত হয়।

সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে কালক্রমে সম্পূর্ণভাবে সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। সাম্যবাদী সমাজ হল পূর্ণাঙ্গ একটি শ্রেণীহীন সমাজ। এই সমাজে শ্রেণীভেদ বা শ্রেণীবৈষম্য থাকে না। এখানে শ্রেণী শাসন ও শ্রেণী-শোষণের অবসান ঘটে। এই অবস্থায় শ্রেণী-শাসন ও শ্রেণী-শোষণের হাতিয়ার হিসাবে পরিচিত রাষ্ট্র অপ্রয়োজনীয় প্রতিপন্ন হয়। রাষ্ট্র হল শ্রেণী-শাসন ও শ্রেণী-শোষণের হাতিয়ার। সাম্যবাদী সমাজে কোন শ্রেণী নেই; নেই শ্রেণী-শাসন ও শ্রেণী-শোষণ। সুতরাং রাষ্ট্র এখানে অপ্রয়োজনীয়। সাম্যবাদী সমাজে অপ্রয়োজনীয় হয়ে রাষ্ট্র অবলুপ্ত হয়।

রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতি সমালোচনা:

বিরুদ্ধবাদীরা উপরিউক্ত আলোচনাকে রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতি সংক্রান্ত সঠিক ব্যাখ্যা বলে মনে করেন না। তাঁরা কয়েকটি বিশেষ ত্রুটির উল্লেখ করেন।

(১) সমাজের উৎপাদন-ক্রিয়াজনিত দু’টি মূল শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সার্বজনীনতা স্বীকার করা নির্দিষ্ট আর্থনীতিক যায় না। সমালোচকদের মতানুসারে সমাজে বহুবিধ গোষ্ঠী বর্তমান। এই সমস্ত গোষ্ঠীকে শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় না।

(২) আবার একথাও সঠিক নয় যে, শোষকশ্রেণীর স্বার্থেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়।

(৩) সমালোচকদের মতানুসারে সমাজ ও ইতিহাসের মার্কসীয় বস্তুবাদী ব্যাখ্যা একদেশদর্শী আর্থনীতিক নিয়ন্ত্রণবাদের (Economic Determinism) নামান্তর। ক্ষেত্রবিশেষে সমাজের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ধর্ম বিষয়ক উপাদানগুলিই আর্থনীতিক শক্তির উপর প্রাধান্য বিস্তার করে। তাই রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভব ও প্রকৃতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন উপাদানকে মূল শক্তি হিসাবে নির্দিষ্ট করা ঠিক নয়।

সমালোচকগণ মার্কসীয় দ্বন্দ্ববাদকে যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারেননি। সমালোচকগণ ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে বিকৃত করে ‘আর্থনীতিক নিয়ন্ত্ৰণবাদ’ বলে উল্লেখ করেছেন। রাষ্ট্র ও রাজনীতি ক্ষেত্রে উৎপাদন ক্রিয়াজনিত সামাজিক-আর্থনীতিক শক্তিসমূহের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বর্তমান। মার্কসবাদীরা তাঁদের তত্ত্বের মাধ্যমে তা উপস্থিত করেছেন এবং রাষ্ট্র চিন্তার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছেন।

(৪) মার্কসবাদে বলা হয় যে পুঁজির বিকাশের সঙ্গে প্রলেতারিয়েতের দুরবস্থা কার্যকারণ সম্পর্কের মত ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। অর্থাৎ পুঁজি যত বিকশিত হবে মেহনতি মানুষের অবস্থার তত অবনতি ঘটবে। কিন্তু বাস্তবে এই বক্তব্য ভ্রান্ত প্রতিপন্ন হয়েছে। উন্নত ও বিকশিত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে প্রলেতারিয়েতের অবস্থার উন্নতি হয়েছে।

(৫) মার্কসীয় রাষ্ট্রদর্শন অনুসারে রাষ্ট্র হল শ্রেণী-শাসন ও শ্রেণী-শোষণের যন্ত্রবিশেষ। মুষ্টিমেয় বিত্তবান মানুষের স্বার্থে দরিদ্র জনতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র যন্ত্রকে ব্যবহার করা হয়। এই তত্ত্বে রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক ভূমিকাটিকে একেবারে উপেক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের এই কল্যাণমূলক প্রকৃতিকে অগ্রাহ্য করা যায় না।

(৬) মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে সকল সভ্য দেশেই কমিউনিস্ট বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। 

(৭) মার্কসবাদে সমাজবিকাশের ধারায় অপ্রয়োজনীয় হয়ে রাষ্ট্রের অবলুপ্তির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।

(৮) সমালোচকদের অভিমত অনুসারে মার্কসবাদ নিয়তিবাদী। কারণ মার্কসীয় তত্ত্বে বলা হয় যে, সমাজবিকাশের ধারায় একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের জায়গায় সঙ্গে সঙ্গে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে অন্য একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটবে।

(৯) বিভিন্ন দেশের শ্রমজীবী জনতা শ্রেণী-সংগ্রামের পরিবর্তে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর আস্থাশীল হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ প্রলেতারিয়েত শ্রেণী নিজেদের বৈষয়িক অবস্থার উন্নতির স্বার্থে কৌশল ও পদ্ধতিগত পরিবর্তনের পথ অবলম্বন করেছে। ইউরো-কমিউনিজমের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে মার্কসীয় তত্ত্ব ও পদ্ধতির সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।

উপরিউক্ত বিরূপ সমালোচনাসমূহ মার্কসবাদীরা স্বীকার করেন না। এ সবের জবাবে তাঁদেরও কিছু  বক্তব্য বর্তমান। তাঁদের মতানুসার মার্কসবাদকে নিয়তিবাদী বলা যায় না। মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে সমাজে বৈষয়িক শক্তি ও আর্থ-সামাজিক বিন্যাসের পরিবর্তন সাধিত হয় মানুষের সচেতন ও সক্রিয় কর্ম-প্রচেষ্টার মাধ্যমে। তা ছাড়া পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে জনকল্যাণমূলক ভূমিকা একটি আবরণ বিশেষ এবং এই আবরণ বিভ্রান্তিকর। রাষ্ট্রের শোষণমূলক চরিত্রকে আড়াল করার এ হল এক অপকৌশল। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সম্পত্তিবান শ্রেণীর স্বার্থে রাষ্ট্রের শোষণমূলক ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না।