সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের আবির্ভাব
সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র হল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটি বিশেষ ও আধুনিক রূপ। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের আদর্শের উপর ভিত্তি করে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে সর্বহারাদের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের পথ প্রশস্ত হয়। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র হল পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে ও সাম্যবাদে উত্তরণের এক অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায়। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র বলতে বোঝায় জনগণের ব্যাপক অংশের গণতন্ত্র, মেহনতী মানুষের গণতন্ত্র। এ হল সর্বহারার গণতন্ত্র (Proletarian democracy) বা সর্বহারার একনায়কত্ব (Dictatorship of the prole tariat)। সর্বহারার একনায়কত্বেই গণতন্ত্রের এই নতুন বিকশিত রূপটির আবির্ভাব ঘটে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিনাশ সাধনের পর সর্বহারার একনায়কত্বের হাতিয়ার হিসাবে সৃষ্টি হয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের। এই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাতেই গণতন্ত্রের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধিত হয়। এবং গণতন্ত্রের এই সর্বোচ্চ বিকশিত রূপই হল সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র। সমাজতন্ত্রের বিকাশের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের বিকাশ ও সমৃদ্ধি সম্পর্কযুক্ত।
সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের ধারণা
সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র সম্পর্কে লেনিন বলেছেন: “It is a political system which gives maximum of democracy for the workers and peasants, at the same time, it marks a break with bourgeois democracy and the rise of a new epoch-making type of democracy namely proletarian democracy or the dictatorship of the proletariat.” সাম্য, স্বাধীনতা, মৈত্রী প্রভৃতি আদর্শগুলি এর মূল নীতি হিসাবে গণ্য হয়। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র হল সমগ্র মেহনতী জনতার গণতন্ত্র। এ হল সর্বহারা শ্রেণীর গণতন্ত্র। এখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে শোষকশ্রেণীগুলিকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়। লেনিনের অভিমত অনুসারে সর্বহারার একনায়কত্ব হল এক নতুন ধরনের উচ্চতর গণতন্ত্র। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র সামগ্রিক বিচারে এক বৈপ্লবিক আদর্শে পরিণত হয়। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সঙ্গে এর পার্থক্য মৌলিক এবং গুণগত ও সংখ্যাগত। এই গণতন্ত্র শ্রেণীহীন ও শোষণহীন গণতন্ত্রের ভিত্তিকে সুদৃঢ় ও সম্প্রসারিত করে এবং মানবজাতির শৃঙ্খলামোচনের সংগ্রামকে সফল করে। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের দৃষ্টান্ত হিসাবে কিউবা ও গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের শাসনব্যবস্থার উল্লেখ করা হয়। মূলত কমিউনিস্ট দেশগুলির কথা বলা হলেও বর্তমানে কতকগুলি অ-কমিউনিস্ট দেশও গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই সমাজতন্ত্রের মৌলিক আদর্শগুলিকে বাস্তবে রূপায়িত করার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন আদর্শগত পার্থক্যের অস্তিত্ব সত্ত্বেও সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের কতকগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়।
(১) আর্থনীতিক সাম্য: মার্কসীয় চিন্তাবিদদের মতানুসারে গণতন্ত্র বলতে এমন এক সমাজব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে সামাজিক, রাজনীতিক ও আর্থনীতিক সাম্য বর্তমান। উদারনীতিক গণতন্ত্রে সাম্যের কথা বলা হয়, কিন্তু আর্থনীতিক বৈষম্য ও শোষণের অবসানের উপর জোর দেওয়া হয় না। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে আর্থনীতিক সাম্যের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ধনবৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় গণতন্ত্র মুষ্টিমেয় বিত্তবান শ্রেণীর স্বার্থ সাধনের যন্ত্রে পরিণত হয়। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠিত না হলে সামাজিক বা রাজনীতিক কোনো ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করা যায় না। আর্থনীতিক সাম্যের ভিত্তিতে শোষণশূন্য ও শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থাতেই কেবল প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
(২) ব্যক্তিগত মালিকানা ও সম্পত্তির বিলোপ: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে উৎপাদনের উপাদানসমূহের উপর ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। আর্থনীতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য এটা দরকার। তা ছাড়া ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার শোষণের সূত্রপাত করে। তাই এই অধিকার স্বীকার করা হয় না। সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানে উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। সমাজের ধনসম্পদের ন্যায়সঙ্গত বণ্টন ও পরিকল্পিত অর্থব্যবস্থার মাধ্যমে জনসাধারণের সামগ্রিক আর্থনীতিক উন্নয়নের চেষ্টা করা হয়।
(৩) সকলের জন্য সমান অধিকারের স্বীকৃতি: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে নাগরিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক, রাজনীতিক ও আর্থনীতিক অধিকারগুলি রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হয়। সকল অধিকার ও ন্যায়নীতির উৎস হিসাবে সমাজতান্ত্রিক এবং আর্থনীতিক অধিকার ও ন্যায়নীতির কথা বলা হয়। জনসাধারণের সর্বোচ্চ বিকাশের উপর সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। তাই এখানে সর্বসাধারণের জন্য ব্যাপক আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক অধিকারের স্বীকৃতি ও সংরক্ষণের কথা বলা হয়। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় নাগরিকগণ কর্মের অধিকার, উপযুক্ত পারিশ্রমিকের অধিকার, অক্ষম অবস্থায় ভরণ-পোষণের অধিকার প্রভৃতি আর্থনীতিক অধিকারের সঙ্গে শিক্ষার অধিকার, ধর্মাচরণের অধিকার প্রভৃতি পৌর অধিকার এবং নির্বাচন করার, নির্বাচিত হওয়ার অধিকার প্রভৃতি রাজনীতিক অধিকার ভোগ করতে পারে। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান সামাজিক, রাজনীতিক ও আর্থনীতিক অধিকার স্বীকার করা হয়। কার্যক্ষেত্রে সকলে যাতে এই অধিকারগুলি ভোগ করতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। গণ-প্রজাতন্ত্রী চীন, কিউবা প্রভৃতি সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থায় অর্থনীতিক, রাজনীতিক ও সামাজিক অধিকারগুলি স্বীকার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
(৪) ব্যক্তি স্বাধীনতার উপলব্ধি: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে আর্থনীতিক সাম্য ও স্বাধীনতা থাকে। তাই জনসাধারণ সামাজিক ও রাজনীতিক ক্ষেত্রে অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগের প্রকৃত ও পর্যাপ্ত সুযোগ পায়। এই কারণে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রেই ব্যক্তি-স্বাধীনতার যথার্থ উপলব্ধি সুযোগ পাওয়া যায়।
(৫) শ্রেণী-শোষণ ও শ্রেণী-দ্বন্দ্ব অনুপস্থিত: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে একটিমাত্র শ্রেণীর অস্তিত্ব দেখা যায়। এই শ্রেণী হল শ্রমিক ও কৃষকের সর্বহারা শ্রেণী। একাধিক শ্রেণী থাকে না বলে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে শ্রেণী-শোষণ বা শ্রেণী-দ্বন্দ্ব থাকে না।
(৬) এক-দলীয় ব্যবস্থা: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে একটিমাত্র রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব দেখা যায়। এই দল হল কমিউনিস্ট দল। এখানে একটিমাত্র রাজনীতিক দলই যথেষ্ট বিবেচিত হয়। এখানে একটি মাত্র শ্রেণী থাকায়, শ্রেণী-স্বার্থের সংঘর্ষ না থাকায় এবং সমাজের লক্ষ্য সম্পর্কে সকলে একমত হওয়ায় সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে বিভিন্ন রাজনীতিক দলের অস্তিত্বের প্রয়োজন থাকে না। একটি দলই সংখ্যাগরিষ্ঠ সর্বহারা শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে। সমাজ ও প্রশাসনের সকল ক্ষেত্রে এই দলের অবিসংবাদিত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থের প্রতিনিধি হিসাবে কমিউনিস্ট দল ছাড়া অন্য কোন দলের প্রয়োজন অনুভূত হয় না। রাষ্ট্রের সকল বিষয় গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার (Democratic centralism) নীতি অনুসারে পরিচালিত হয়।
(৭) সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে গণ-সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব বাস্তবে রূপায়িত হয়। কারণ এখানে নির্দিষ্ট সময় অন্তর সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাই এখানে জনসাধারণ সকল ক্ষমতার মূল উৎস হিসাবে গণ্য হয়। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে আর্থনীতিক সাম্যের ভিত্তিতে ভোটাধিকার সার্থক হয়। তার ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমষ্টিমূলক প্রতিনিধিত্ব সফল হয়। জনগণ রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের ব্যাপক সুযোগ লাভ করে। সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের সার্বভৌমত্বের ধারণাকে বাস্তবে রূপায়ণ করা যায়। কারণ এখানে জনসাধারণের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে। এই ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে জনগণের অধিকার স্বীকৃত ও সংরক্ষিত থাকে। প্রকৃত প্রস্তাবে জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার যথার্থ অধিকারী হয়।
(৮) শ্রম ও ভোগ রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে রাষ্ট্র শ্রম ও ভোগের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। প্রত্যেকে তার সামর্থ্য অনুসারে কাজ করবে এবং কাজ অনুসারে ভোগ করবে’— এই নীতির ভিত্তিতে এখানে বণ্টনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই প্রত্যেককেই সক্রিয়ভাবে সমাজের উন্নয়নে অংশগ্রহণ করতে হয়। যে কাজ করবে না, সে খেতেও পাবে না’— এই হল মূল নীতি। এ ধরনের সমাজব্যবস্থায় পরশ্রমজীবী কোন শ্রেণীর অস্তিত্ব থাকে না। এই কারণে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে প্রত্যেক ব্যক্তি সমাজের অপরিহার্য অংশ হিসাবে বিবেচিত হয়।
(৯) মেহনতী মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণ: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে রাষ্ট্রের কাজ হল সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থ রক্ষা করা। সংখ্যাগরিষ্ঠ মেহনতী মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণই হল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যে সর্বহারা শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসাবে কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়ে থাকে। কমিউনিস্ট পার্টি ও জনগণের নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয় বলেই এই ব্যবস্থায় সরকারী কর্মচারীরা কোন জনবিরোধী কাজ করতে পারে না। তা ছাড়া স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তারের সুযোগও এই ব্যবস্থায় অত্যন্ত কম।
(১০) বিচার-বিভাগের ভূমিকা: উদারনীতিক গণতন্ত্রে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার কথা বলা হয়। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে বিচার-বিভাগ স্বাধীনতা ও নিরপক্ষেতা বিসর্জন দিয়ে সমাজতান্ত্রিক স্বার্থরক্ষায় উপযোগী ভূমিকা পালন করে। এখানে বিচার-বিভাগের উদ্দেশ্য হল সমাজতন্ত্রকে সুদৃঢ় করা এবং শত্রুদের শাস্তিবিধান।
(১১) গণ-সংস্কৃতির বিকাশ: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে গণ-সংযোগের মাধ্যমগুলির উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ কার্যকর হয়। শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপ প্রভৃতি সবকিছুই সমাজতান্ত্রিক আদর্শ অনুসারে নিয়ন্ত্রিত হয়। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে সুস্থ, স্বাভাবিক ও প্রগতিশীল গণ-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে।
(১২) ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে এক নতুন মূল্যবোধের সৃষ্টি হয়। এই মূল্যবোধ যাবতীয় ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে। কুসংস্কার ও অন্ধ ধর্মবিশ্বাস থেকে মানুষের মন মুক্ত হয়। জনগণের মধ্যে রাজনীতিক চেতনা এবং প্রগতিশীল ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে। তার ফলে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রেই যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গড়ে ওঠে।
(১৩) ব্যাপক গণ-নিয়ন্ত্রণ: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র আমলাতান্ত্রিক প্রাধান্য থেকে মুক্ত থাকে। রাষ্ট্রব্যবস্থার সকল ক্ষেত্রে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকার জন্য আমলাতান্ত্রিক কুফলগুলি রদ করা সম্ভব হয়। গণতন্ত্রের ভিত্তিকে সম্প্রসারিত করার স্বার্থে জনসাধারণের ব্যাপক অংশগ্রহণ আবশ্যক। এই কারণে গণসংগঠনসমূহের ভূমিকার উপর সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে। এই ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক সমস্যাদির পর্যালোচনার ব্যাপারে গণসংগঠনগুলি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসাবে ভূমিকা পালন করে। এ ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় সমাজের চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলির প্রভাব-প্রতিপত্তির পরিধিও সীমাবদ্ধ। ব্যাপক গণ-নিয়ন্ত্রণের জন্য আমলাতান্ত্রিক প্রাধান্যের অবসান ঘটে।
(১৪) সর্বহারার আন্তর্জাতিকতা: সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের নীতি সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে অস্বীকৃত। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র বিশ্বের বিভিন্ন অংশে সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে মানুষের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। মার্কসীয় মতবাদ অনুসারে দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষের কাছে ঐক্যের আহ্বান জানান হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে সর্বহারার আন্তর্জাতিকতা হল সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
(১৫) সমগ্র জনগণের গণতন্ত্র: সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে সর্বহারার একনায়কত্বে এক নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা হয়। ক্রমশ এই রাষ্ট্রব্যবস্থা সমগ্র জনগণের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সাম্যবাদী সমাজ গঠনের লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র অগ্রসর হতে থাকে। এই পথে রাষ্ট্রের অবলুপ্তি ত্বরান্বিত হয়।
উপসংহার: বস্তুত উদারনীতিক গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের কথা বলা হয়। মার্কসীয় দর্শনে গণতন্ত্রের ধারণাকে বলিষ্ঠভাবে সমর্থন করা হয়, কিন্তু উদারনীতিক গণতন্ত্রের তত্ত্ব ও প্রয়োগকে সমর্থন করা হয় না। দাবি করা হয় যে, সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই প্রকৃত গণতন্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত। অনেকে তাই এই ব্যবস্থাকে ‘প্রকৃত গণতন্ত্র’ (Real Democracy) বলে থাকেন। আবার এই ব্যবস্থাকে ‘বৈপ্লবিক গণতন্ত্র’ (Revolutionary Democracy) নামেও অভিহিত করা হয়। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র সর্বহারার গণতন্ত্র থেকে সৃষ্ট হয় এবং পুঁজিবাদকে ধ্বংস করে ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে। এখানে এক নতুন, ঐতিহাসিক ও উচ্চস্তরের গণসার্বভৌমিকতার প্রকাশ ঘটে। এই ব্যবস্থা শোষণ বঞ্চনার অভিশাপ থেকে মুক্ত। এখানে রাজনীতিক গণতন্ত্রের সঙ্গে আর্থনীতিক গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র এইভাবে প্রকৃত গণতন্ত্রের মর্যাদা লাভ করে।
Leave a comment