বুর্জোয়া বিপ্লব:

বিপ্লবের ধারণা, প্রকৃতি ও লক্ষ্য সম্পর্কে চিন্তাবিদদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য বর্তমান। বিপ্লব সম্পর্কে দার্শনিকদের বক্তব্যসমূহকে মোটামুটিভাবে দু’ভাগে বিভক্ত করা হয় বিপ্লবের উদারনীতিক তত্ত্ব এবং মার্কসীয় তত্ত্ব। বিপ্লবের উদারনীতিক মতবাদ বুর্জোয়া মতবাদ হিসাবেও পরিচিত। ইংল্যাণ্ডের মিলটন ও লক্, ফ্রান্সের রুশো এবং আমেরিকার জেফারসন প্রমুখ চিত্তাবিদ্‌গণ বিপ্লবের কথা বলেছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে এঁরা বুর্জোয়া বিপ্লবে অংশগ্রহণের জন্য জনগণকে ডাক দিয়েছেন। এর উদ্দেশ্য ছিল সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসানের পর বুর্জোয়াদের রাজনীতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। এই শ্রেণীর দার্শনিকগণ ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার পর স্থিতাবস্থার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তখন উদারনীতিক গণতন্ত্রের প্রবক্তারা প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকেই সর্বশ্রেষ্ঠ আখ্যা দেন এবং জনসাধারণের স্বার্থে এর সংরক্ষণের কথা বলেন।

বিপ্লব সম্পর্কে প্লেটো ও অ্যারিস্টটল:

গ্রীক দার্শনিক প্লেটো বিপ্লব অর্থে এক আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। এই রাষ্ট্রে শ্রমবিভাগ ও কাজকর্মের বিশেষীকরণ থাকবে। এবং তার ভিত্তিতে তিনটি শ্রেণীতে সমাজ বিভক্ত হবে। প্লেটোর মতানুসারে এইভাবে গ্রীক নগর রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অব্যাহত থাকবে। বিপ্লব সম্পর্কে প্লেটোর ধারণা এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অ্যারিস্টটল বিপ্লব বলতে রাষ্ট্রের সংবিধানের পরিবর্তনকে বুঝিয়েছেন। শাসকের পরিবর্তন বা এক ধরনের সরকার কর্তৃক আর এক ধরনের সরকারের অপসারণকেও তিনি বিপ্লব আখ্যা দিয়েছেন। অ্যারিস্টটল বিপ্লবের কারণ, মাত্রা এবং প্রতিরোধ সম্পর্কেও কথা বলেছেন। বিপ্লবের কারণ বলতে গিয়ে সম্পদের অসমবণ্টনের মত বস্তুগত উপাদানের কথা বলেছেন, নেতাদের ক্ষমতালিপ্সার কথা বলেছেন এবং আদর্শগত কারণের কথাও বলেছেন। অ্যারিস্টটল প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে ছিলেন। তাই বিপ্লবকে তিনি রাজনীতিক বিয়োগান্তক ঘটনা হিসাবে দেখেছেন। এই কারণে বিপ্লবের প্রতিষেধক ব্যবস্থাদি সম্পর্কেও তিনি আলোচনা করেছেন।

বিপ্লব সম্পর্কে মিলটন ও অগাস্টাইন:

মিলটন (John Milton) স্বাধীনতা রক্ষার স্বার্থে বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। তাঁর অভিমত হল জনগণের স্বাধীনতার বিরোধী শাসক গোষ্ঠীকে উৎখাত করে নতুন সরকার গঠন করা দরকার। অগাস্টাইন (St. Augustine) বিপ্লব প্রতিরোধ করার কথা বলেছেন। এবং এই উদ্দেশ্যে তিনি হঠকারী শাসককে হত্যা করার কথাও বলেছেন।

বিপ্লব সম্পর্কে লক্, জেফারসন ও রুশো:

ইংল্যাণ্ডের চুক্তিবাদী দার্শনিক লক্ (John Locke) ১৬৮৮ সালের গৌরবময় বিপ্লবকে সমর্থন করেছেন। তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন যে, ব্যক্তির স্বাভাবিক অধিকার সংরক্ষণের স্বার্থে প্রজাসাধারণ রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে। আমেরিকার জেফারসনের বক্তব্য আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের পিছনে প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছে। আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামে নাগরিকদের জীবন, স্বাধীনতা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সংরক্ষণে অসমর্থ সরকারকে বিপ্লবের মাধ্যমে পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। এবং এই পরিবর্তন সাধনকে প্রত্যেকের কর্তব্য হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। চুক্তিবাদী ফরাসী দার্শনিক রুশোর ধ্যান ধারণাও ফরাসী বিপ্লবের পথকে প্রশস্ত করেছে। ইংল্যাণ্ডের গৌরবময় বিপ্লব, আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ফরাসী বিপ্লবে মূলত অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সরকার পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ সরকার পরিবর্তনের উপরই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

উদারনীতিবাদীরা বর্তমানে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজ পরিবর্তনের কথা বলেন: বর্তমানে উদারনীতিক গণতন্ত্রের সমর্থকরা রাজনীতিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বদলে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পরিবর্তনের কথা বলেন। এঁরা এখনকার জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনীতিক ব্যবস্থা হিসাবে মনে করেন। এঁরা গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সমন্বয়ে গণতান্ত্রিক সমাজবাদের কথা বলেন। এঁদের মতানুসারে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বৈধ উপায়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। এই রকম কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আপামর জনসাধারণের ব্যাপক কল্যাণ সাধন সম্ভব। এই ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিবর্তনের জন্য বৈপ্লবিক উপায়ের প্রয়োজন হয় না। এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের সার্বভৌমত্ব বর্তমান থাকে। তাই জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সরকার পরিবর্তন করতে সক্ষম। তাই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মত হিংসাত্মক পদ্ধতি এই ব্যবস্থায় অনাবশ্যক।

বিপ্লবের উদারনীতিক ধারণা:

উদারনীতিক গণতন্ত্রের আধুনিক প্রবক্তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের বিপ্লবের অধিকারকে স্বীকার করেন না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বুর্জোয়া তাত্ত্বিকদের অভিমত অনুসারে বিপ্লব হল অস্বাভাবিক ও অবাঞ্ছিত। বিপ্লবের ফলে সমাজজীবন বিপর্যস্ত হয়। সমাজতত্ত্ববিদ্ কার (L. U. Car)-এর মতানুসারে বিপ্লব হল সামাজিক পরিবর্তনের সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকারক ও বিপজ্জনক ব্যবস্থা। উদারনীতিবাদীরা সরকারী ক্ষমতার হস্তান্তরকেই বিপ্লব হিসাবে বোঝাতে চান। এঁদের মতানুসারে বিপ্লব হল বিধিবহির্ভূতভাবে এবং হিংসাত্মক উপায়ে ক্ষমতাসীন সরকারের পরিবর্তন। স্লেসিংগার (Arthur M. Schlesinger)- এর মতানুসারে আধুনিক উন্নত বিজ্ঞানের কল্যাণে শাসক গোষ্ঠীর হাতে অভাবনীয় ক্ষমতা এসেছে। তার ফলে গণ-বিপ্লবের ধারণা এখন সেকেলে হয়ে গেছে।

বিপ্লব সম্পর্কে সমালোচনা

মার্কসবাদীরা বিপ্লবের উদারনীতিক তত্ত্বের তীব্র সমালোচনা করেন। এ প্রসঙ্গে মার্কসীয় দর্শন অনুসারে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করা হয়।

(১) অত্যন্ত সংকীর্ণ: বিপ্লবের উদারনীতিক সংজ্ঞাকে আপৃথেকার (Herbert Aptheker) উপহাস করে ‘হলিউড মার্কা’ সংজ্ঞা বলেছেন। তাঁর মতানুসারে বিপ্লবের উদারনীতিক ধারণা অবৈজ্ঞানিক ও অত্যন্ত সংকীর্ণ। উদারনীতিক ধারণা অনুসারে বিপ্লব হল কেবলমাত্র সরকার ও সংবিধানের পরিবর্তন। কিন্তু বিপ্লবের মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে সমাজের আর্থনীতিক ও রাজনীতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে।

(২) বিপ্লব ও হিংসা অভিন্ন নয়: বিপ্লবের উদারনীতিক তত্ত্বে বিপ্লব ও হিংসাকে অভিন্ন মনে করা হয়। বিপ্লব হিংসাত্মক না শান্তিপূর্ণ বা বৈধ না অবৈধ হবে এর সঙ্গে বিপ্লবের মূল প্রকৃতির কোন সম্পর্ক থাকে না। মার্কসীয় ধারণা অনুসারে বিপ্লব হল সমাজে এক ধরনের উৎপাদন সম্পর্ককে বিলুপ্ত করে এক নতুন ধরনের উৎপাদন সম্পর্কের সৃষ্টি। 

(৩) বিপ্লব ও প্রতি-বিপ্লব এক নয়: বিপ্লবের উদারনীতিক তত্ত্বে বিপ্লবের সঙ্গে ‘প্রতি-বিপ্লবের বা ‘প্রাসাদ-বিপ্লবের’ পার্থক্য করা হয় না। সমাজের মৌলিক প্রকৃতি সামাজিক-আর্থনীতিক ব্যবস্থার দ্বারা নির্ধারিত হয়। সুতরাং সমাজে বিপ্লব এবং প্রতি-বিপ্লব বা সংস্কার অভিন্ন হতে পারে না।

(৪) বুর্জোয়া গণতন্ত্রে বিত্তবান শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করা হয়: উদারনীতিক গণতন্ত্রের সমর্থকদের মতানুসারে প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হল শ্রেণীনিরপেক্ষ এবং আপামর জনসাধারণের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ সাধনের উপযোগী। কিন্তু এ ধারণা ভ্রান্ত। কারণ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমাজের আর্থনীতিক দিক থেকে প্রভুত্বকারী শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার জন্য রাষ্ট্র-শক্তিকে ব্যবহার করা হয়। 

(৫) পরিবর্তনের পদ্ধতিগত ধারণা ভ্রান্ত: আধুনিক উদারনীতিবাদীরা প্রচলিত সমাজের স্থিতাবস্থা, গণতান্ত্রিক সমাজবাদ এবং শান্তিপূর্ণ ও বৈধ উপায়ে সরকার পরিবর্তনের পক্ষপাতী। মার্কসবাদীরা হিংসা অহিংসা বা বৈধতা-অবৈধতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন না।

(৬) বৈপ্লবিক প্রক্রিয়া গণতন্ত্রসম্মত: উদারনীতিবাদীদের মতানুসারে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিপ্লবের মাধ্যমে রাজনীতিক পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। কিন্তু আপৃথেকারের মতানুসারে অধিকাংশ জনগণের অংশগ্রহণ যদি গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয় হয়, তা হলে বৈপ্লবিক প্রক্রিয়া ও তার ফলাফল সম্পূর্ণ গণতন্ত্রসম্মত। কারণ মৌলিক প্রকৃতির বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ায় জনগণের ব্যাপক অংশের অংশগ্রহণ অপরিহার্য।

(৭) প্রত্যক্ষ সংগ্রাম মাত্রেই গণতন্ত্র-বিরোধী নয়: বুর্জোয়া তাত্ত্বিকদের মতানুসারে যে কোন রকম প্রত্যক্ষ সংগ্রাম গণতন্ত্র-বিরোধী। কিন্তু এ ধারণা ভ্রান্ত ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্র আর্থনীতিক ক্ষেত্রে মুষ্টিমেয় প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে। তার ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের স্বার্থ অবহেলিত হয়। এই অবস্থায় জনসাধারণ তাদের স্বার্থ রক্ষার তাগিদে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের সামিল হবে এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং প্রত্যক্ষ সংগ্রাম মাত্রেই গণতন্ত্র-বিরোধী হতে পারে না।

(৮) মার্কসীয় ও অ-মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি: বুর্জোয়া তাত্ত্বিকদের আর একটি ত্রুটি হল তাঁরা বিপ্লবের মৌলিক প্রকৃতিকে পাশ কাটিয়ে অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ের উপর মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করেছেন।